• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যের অর্জুন!


তাপস কুমার দত্ত
প্রকাশিত: মে ১০, ২০২৩, ১২:২১ এএম
বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যের অর্জুন!

তখন বয়স সতেরো কি আঠারো। কয়েক বছরের মধ্যে বড় ক্যানভাসের দুই ডজনের বেশি উপন্যাস পড়ে ফেলে নিজেকে বেশ তালেবর পাঠক বলে মনে করছি। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় সমরেশকে নিয়ে কাটাছেড়া হচ্ছে। একজন আঁতেল বন্ধু বলল, কোন সমরেশ? আরেকজন বলল, সমরেশ আবার কজন? সমরেশ মজুমদার! আঁতেল বন্ধুটি বলল, সমরেশ মজুমদার কোনো লেখক হলো? লেখক ছিল সমরেশ বসু। সমরেশ বসু তখন আমাদের কম পড়া ছিল, ফলে ঐ আঁতেল বন্ধুটির ওপর সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার শুধু মনে হলো, কে বড়, কে ছোট—এই কাটাছেড়ার মধ্যে চায়ের কাপে ঝড় তোলা যায় মাত্র, কিন্তু বিচারটা আসলে মহাকাল করে। গত সোমবার, সমরেশ মজুমদার মারা যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ সমরেশের সাহিত্যমান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁর জনপ্রিয়তার নৌকার পালে নিজেকে বেঁধে নিয়ে এগিয়ে নিতে চাইছে।

বাঁ থেকে লেখক, লেখকের বন্ধু বুলবুল হাসান, সমরেশ মজুমদার। ২০০৬ সাল।

আমি যখন কলকাতায় চলচ্চিত্রের ওপর পড়তে যাই, তখন আমার স্বপ্নের তিন লেখকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়। এঁদের মধ্যে সমরেশ মজুমদার ছিলেন সবচাইতে ঠোঁট কাটা। ওনার মনে যা আসত, মুখে তা বলে দিতেন। ২০০৪ সালে সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের নির্বাহী সম্পাদক বিভুদা (বিভুরঞ্জন সরকার) দায়িত্ব দিয়েছিলেন কলকাতায় জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার। সেই সূত্রে একদিন দুপুরবেলা সমরেশ মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিতে তাঁর টেলিসিরিয়াল নির্মাণের টালিগঞ্জের অফিসে চলে যাই আমি ও শর্মিষ্ঠা। আমার প্রেমিকা শর্মিষ্ঠা তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ত, আর সমরেশও ঐ কলেজে পড়েছেন, আমি সমরেশকে খুশি করার জন্য বানিয়ে বললাম, শর্মিষ্ঠা আপনার লেখা এতই পছন্দ করে যে আপনি স্কটিশে পড়েছেন বলেই সেখানে সে ভর্তি হয়েছে। উনি বললেন, কেন বাড়িয়ে বলছ?

আমি থতমত খেয়ে যাই। গত ১৮ বছরে সমরেশদার শ্যামপুকুর স্ট্রিটের তিনতলা বাড়িতে কম করে ২০/২৫ বার গিয়েছি। তবে আজো তার নেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার আমার কাছে অমূল্য মনে হয়।  আমি সেই প্রথম সাক্ষাতে একের পর এক স্পর্শকাতর প্রশ্নের ডালা মেলে ধরি তাঁর দিকে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে সমরেশের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন। এই প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয় কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।’ 
 

বাঁ থেকে লেখকের স্ত্রী শর্মিষ্ঠা, সমরেশ মজুমদার, কোলে লেখকের কন্যা মুক্তমন। ২০১৫ সাল।

আমি বললাম, কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন... কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সমরেশ মজুমদার বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তান-সন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে, বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠকের সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপি গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালি’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?’
আমি আরো প্যাঁচ দিয়ে বললাম, ধরুন, হাইপোথেটিকালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন? 
সমরেশ মজুমদার বললেন, ‘চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনও অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝে-মধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই তা আমি নেব না কেন?’ 
 

সমরেশ মজুমদারের স্নেহের হাত লেখকের কন্যা মুক্তমনের মাথায়। ২০১৫ সাল।

আমি আরেকটা এগিয়ে বললাম, দাদা আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার বললেন, ‘শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।’

মৃত্যু নিয়ে প্রায় সবাইকে আমি একটি কমন প্রশ্ন করতাম। সমরেশেকেও বললাম,  বয়স তো যথেষ্ট হলো (তখন, ২০০৪ সালে, উনার বয়স ৬২ বছর) একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে... কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশদা অকপটে বললেন, ‘না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি। আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।’

Link copied!