• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ম্যান উইথ মিশন


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২৩, ১০:০৫ এএম
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ম্যান উইথ মিশন

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনকে অনেক মানুষ অনেকভাবে চিনবে। কারো কাছে তিনি টকশোতে জাগ্রত বিবেক, কারো কাছে তিনি ক্রীড়াসংগঠক, স্থপতিদের কাছে তিনি আইএবির প্রেসিডেন্ট ও আর্কএশিয়া ও কমনওয়েলথ আর্কিটেক্টদের নির্বাচিত সভাপতিও। আমার কাছে তাঁর বড় পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা ও বোর্ডগুলোর একজন সমালোচক। দুর্নীতি থেকে যা ক্রীড়াঙ্গন মুক্ত নয় এইসব আলাপ তিনি বারবার করতেন। আর তাঁর আরেক ভালো দিক হলো তিনি নগর পরিকল্পনা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সবসময় বলতেন। আর এসব কিছু ছাপিয়ে ছিল তাঁর ক্রিকেট প্রেম। আমার এখনো মনে পড়ে, অস্ট্রেলিয়ার সাথে যখন বাংলাদেশ প্রথম যখন জিতলো, একটা ফ্ল্যাট বিক্রির মূল্য তিনি ক্রিকেটারদেরকে গিফট করেছিলেন। ক্রিকেটের উত্থান তাঁকে সবসময় আনন্দ দিতো। অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডে যখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রশংসা শুনতেন স্থপতিদের মুখে, তিনি এটাকে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসাবেই দেখতেন।

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ দুঃখ করে বলেন, বাঙালি সংগঠক না। মোবাশ্বের হোসেনের বেলায় সেটা খাটে না। ছোটবেলা থেকেই পিতার অকাল মৃত্যুর পর তিনি যখন বগুড়া থাকা শুরু করেন, সেই স্কুলের অল্প বয়সেই তিনি ক্লাব করতেন। সেই ক্লাবে লাইব্রেরি ছিল, মেয়েদের শেখানো হতো পড়াশোনা। ডিসি এসে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই বালক বয়সেই মোবাশ্বের হোসেনকে নাইট স্কুল করার টাকা ও নারীদের শেখানোর সেলাই মেশিন দিয়েছিলেন। তাঁর অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট নানা সেই স্কুলে ক্লাস করাতেন। এই যে দেশের মানুষের প্রতি কাজ করার আকাঙ্ক্ষা এটা তাঁর ছোটবেলা থেকেই ছিল। তিনি প্রশ্ন করতে পছন্দ করতেন। ভালো আঁকতেন ও ভালো ছাত্র ছিলেন বলে কেউ তাঁকে ঘাটাতো না। 
ষাটের শুরুর দিকে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তখন থেকেই তাঁর রাজনীতি শুরু। তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। বুয়েটে যখন ভর্তি হলেন দেখেন সেখানে রাজনীতি নাই, ময়ূখ নামের একটা সংগঠন ছিল। তাদের ব্যাচই প্রকাশ্যে ছাত্র ইউনিয়ন বুয়েটে রাজনীতি শুরু করে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির মত রাজনীতি হয় না বলে পাকিস্তান সামরিক জান্তাও কখনো বুয়েটের দিকে নজর দেয়নি। এই সুযোগে যত বাম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন সবাই কম বেশি, বুয়েটের হলে থাকতেন। পংকজ দেবনাথ, সাইফুদ্দিন মানিক—এদের মত নেতারা আশ্রয়ে থাকতেন স্থাপত্যের এই ছাত্রের রুমে। প্রথম বর্ষেই তিনি সাংস্কৃতিক সভাপতি, যা সেই সময়ে একটা বড় ব্যাপার। আরেকটা আজব ব্যাপার হলো, তিনি বুয়েটে পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাননি। তিনি ঢাকা কলেজে থাকতে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ আঁকতেন, ঈদ কার্ড বানিয়ে বিক্রি করতেন, এসব নিয়ে গেলেন বুয়েটের ডিনের কাছে। শ্বেতাঙ্গ ডিন তা দেখে অবাক, বলেছিলেন, এখন একটা এক্সাম দাও আবার। তাঁকে আঁকতে দেওয়া হলো নকশী কাঁথা, তিনি আধঘণ্টার আগেই শেষ করলেন। ডিন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ভর্তি করার নির্দেশ দিলেন।

আমাদের সমাজে তাৎক্ষণিকতার মূল্য দেওয়া হয় না। যারা পলায়নপর, তাদের অনেক মূল্য দেওয়া হয়। মোবাশ্বের হোসেন কখনোই গাঁ বাঁচিয়ে চলা মানুষ ছিলেন না। তাঁর মা বিলাতে চাকরি করতেন, ভাইও থাকতেন ওখানে। একাত্তরে এসে নিয়ে যেতে চাইলেন মোবাশ্বের হোসেনকে পরিবার সমেত। তিনি যাবেনই না, দেশের এই অবস্থায়। তিনি যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে গেছেন নিজের একমাত্র বাচ্চাকে রেখে। বাচ্চা থপ থপ করে হাঁটছিল, আর জিগ্যেস করছিলো, কই যাও বাবা? তিনি তাকাননি। স্ত্রী আর ছেলেকে রেখে গিয়েছিলেন এক মুসলিম লীগ অধ্যুষিত অঞ্চলে। তিনি ছিলেন সফল গেরিলা যোদ্ধা। ট্রেনিং থেকে ফিরেই তিনি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এলাকায় ঘুরতেন। বাচ্চা সঙ্গে থাকার কারণে তাঁকে কেউ সন্দেহ করতো না।

একটা সরকারি অফিস ছিল তাদের বাড়িতে ভাড়া। সেটাও ছিল আরেকটা সুবিধে। তিনি দিব্যি ধীরেসুস্থে অপারেশন শেষে বাসায় আসতেন। তাঁর স্ত্রী বিরক্ত ছিলেন, বলতেন, তাদের পরিবারের সবাই মারা পড়বে মোবাশ্বের হোসেনের কারণে। চিন্তা করেন কী পরিমাণ সাহস থাকলে একটা মানুষ এরকম করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তাঁকে স্থপতি মাযাহারুল ইসলাম নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। পরিচয় করানোর সময় নাকি বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটার সুযোগ ছিল লন্ডনে চলে যাওয়ার। তাও সে থেকে গেছে, যুদ্ধ করছে।’ বঙ্গবন্ধু মাযহারুল ইসলামকে খুব পছন্দ করতেন। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘সেক্রেটারিদের মত সব প্ল্যান ঢাকাতেই কইরেন না, ঢাকার বাইরে আমাদের যেতে হবে, এই এত বস্তিবাসীর জন্য কিছু করতে হবে।’

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন যুদ্ধটা করেই গেছেন। তিনি সংগঠন গড়েছেন, খেলাধুলার ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাসযোগ্য ঢাকার জন্য অনেক চেষ্টা করছেন। ঢাকার ভালো সিস্টেম নাই ট্রাফিকের, দুর্যোগ হলে ঢাকার কী হবে, ঢাকার ওপরে চাপ কমানো—এসব নিয়ে তাঁর চাইতে বেশি আর কেউ বলতেন না টিভিতে।

তিনি ছিলেন মাঠের পক্ষে ও খেলার করপোরেট আগ্রাসনের বিপক্ষে। তাঁকে এক ক্লাবে বিশাল বড় পোস্ট দেওয়ার কথা বলেছিলো তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা। তিনি নেননি। এই যে ওয়াকওভার দেওয়া কিংবা প্রথম বিভাগে পয়েন্ট গিফট দেওয়া—এ সবের তিনি ছিলেন ঘোরবিরোধী। স্পোর্টসে অনেকেই আসে কিন্তু ক্রীড়ামূল্যবোধটা নেয় না, তাঁর সেটা ছিল। তিনি মিথ্যা বলতেন না, দেশকে ভালোবাসতেন, দেশকে লাভ লোকসানের বাইরে দেখতেন। কিছু পথশিশুকেও তিনি পড়িয়ে শুনিয়ে জীবীকার ব্যবস্থা করেছেন। চিকিৎসার সংকটে কোনো মুক্তিযোদ্ধা থাকলে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। সব সময় ক্ষমতাবান ডেভোলাপারদের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। তিনি নিজের দেহটা পর্যন্ত দান করে গেছেন হাসপাতালে। এই সমস্ত মানুষ সমাজে এমনিতেই কম ছিল, তাঁর অকালে চলে যাওয়াটা আসলেই বড় ক্ষতি।

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!