• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
শিল্পের সিন্দুক ৪

গৌরবময় মৃত্যুর স্পর্শমাখা একটি অমর ছবির গল্প


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৬, ২০২২, ০৩:২৮ পিএম
গৌরবময় মৃত্যুর স্পর্শমাখা একটি অমর ছবির গল্প

বন্ধুরা, আজ  আমি তোমাদেরকে এমন একটি ছবির গল্প শোনাব যেটি আঁকতে আঁকতেই তার শিল্পী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। তিনি আমাদের বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত বিখ্যাত শিল্পী, যাঁকে সবাই একনামে চেনে। তিনি আর কেউ নন কামরুল হাসান, যিনি নিজেকে শিল্পীর চাইতেও ‘পটুয়া’ হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন। তোমরা জানো পটুয়া হচ্ছে গ্রামবাংলার সেই শিল্পীরা, যাঁরা হাটেমাঠে ঘুরে ঘুরে গল্প আর গান শোনাতে শোনাতে ছবি আঁকেন, যে ছবিগুলোকে বলা হয় পটচিত্র বা পট; আর সেই পট থেকেই ‘পটুয়া’। শিল্পী কামরুল হাসান শহুরে মানুষ হলেও তিনি মনেপ্রাণে ভালবাসতেন আমাদের হাজার বছরের গ্রামবাংলার মানুষ-প্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি,পালা-পার্বণ, গান-গল্প ইত্যাদি এবং তাঁর চিত্রকর্মে সেসবই ফুটিয়ে তুলতেন সবসময়। 


এই মানুষটিই ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখ সকালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে অনুষ্ঠিত জাতীয় কবিতা উৎসবের একটি অধিবেশনের সভাপতিত্ব করছিলেন। স্বভাবতই তিনি আর সব অতিথির সঙ্গে মঞ্চেই বসা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শামসুর রাহমান, ফয়েজ আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, সাঈদ আহমেদ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, রফিক আজাদ প্রমুখ বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকেরা। কাজপাগল মানুষ কামরুল হাসান চুপ করে বসে না থেকে কাছেই উপবিষ্ট তরুণ কবি রবীন্দ্র গোপের কাছ থেকে তাঁর কবিতার খাতাটা চেয়ে নিয়ে তাতে সবুজ কালিতে কী একটা ছবি আঁকতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর ছবি আঁকা শেষ হলে সবাই দেখলেন, সেখানে সাপ আর শেয়ালের ছবির মাঝখানে ফুটে উঠেছে তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেন মোহাম্মদ এরশাদের নিষ্ঠুর চেহারাটি, যার নিচে বড় করে লেখা ছবির নাম, ‘দেশ আজ  বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’। আর কী আশ্চর্য,এর খানিক বাদেই হঠাৎ তিনি বুকে হাত চেপে মঞ্চের পাটাতনে ঢলে পড়েন। তখন সবাই মিলে ধরাধরি করে তড়িঘড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। সেই অনুষ্ঠানে আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন দর্শকসারিতে এবং তাঁর গাড়িতে করেই শিল্পীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।


তো, খবরটা জানাজানি হয়ে গেলে প্রশাসনের লোকজন তাঁর লাশটি ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ছাত্ররা তা হতে না দিয়ে তখনকার চারুকলা কলেজের ক্যাম্পাসে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে এই মহান শিল্পীর মরদেহ। জাতীয় কবিতা পরিষদের নেতা কবি মোহন রায়হান তাঁর নিজের প্রেস থেকে তৎক্ষণাৎ সেই ছবিটির হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে এনে সবার মাঝে বিতরণ করে দেন। এতে করে দেশে চলমান স্বৈরাচাবিরোধী আন্দোলন তখন আরও বেগবান হয় এবং তার ফলে আর মাত্র দুবছর পরেই ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হয়। এমনই শক্তি ছিল তাঁর আঁকা জীবনের শেষ ছবিটির! এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহন রায়হান এ-প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেন, "কবিতা উৎসবের অনুষ্ঠানে কামরুল হাসান ভাই মারা গেলেন। পরে আমরা শুনলাম, সরকার শিল্পীর লাশ নিয়ে যাবে। তখন আমরা তাড়াহুড়ো করে মেডিকেল কলেজ থেকে শিল্পীর মরদেহ আর্ট কলেজে নিয়ে আসলাম। হলে হলে খবর দিলাম। সেই সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছিল, তাদেরও খবর দিলাম। সারারাত আমরা শিল্পীর মরদেহ পাহারা দিলাম যেন এরশাদ লাশ নিয়ে যেতে না পারে। ওই রাতে আমরা ক‍‍`জন তাঁর আঁকা স্কেচটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পুরান ঢাকার আলুবাজারে হাজি ওসমান গনি রোডে আমার নিজের বিকল্প প্রিন্টিং প্রেস থেকে এটি ছাপানো হয়েছিল। প্রথমে ১০ হাজার কপি ছাপা হয়, ছড়িয়ে দেয়া হয় সারাদেশে। এরপর আরও ছাপানো হয়েছিল। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ওই স্কেচটি ছিল একটি সত্যিকারের মোমেন্টাম।"


অবশ্য শিল্পী কামরুল হাসানের এরকম প্রতিবাদী ছবি আঁকার ইতিহাস নতুন নয়। তোমরা অনেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার খুব বিখ্যাত একটি পোস্টার দেখে থাকবে, যেখানে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি দৈত্যের মতো ভয়ংকর ছবির নিচে লেখা আছে, ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’।  এই ছবিটিও কিন্তু তাঁরই আঁকা; সেটি তিনি এঁকেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে আগে,১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ এবং সেদিনও এই টিএসসিতেই তাঁর সেই ছবিগুলোর প্রদর্শনী হয়েছিল। তিনি কিন্তু তখনই বুঝতে পেরেছিলেন কারা আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু এবং কাদেরকে নিধন করা ছাড়া বাঙালি জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। তাঁর আঁকা অন্য আরও অনেক ছবির সঙ্গে বিশেষভাবে এই ছবিটি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ডভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল দেশমাতৃকার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে। কামরুল হাসান নিজেও তখন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন; তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের শিল্প বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই নয়টি মাস।  এখানে বলে রাখি,১৯৭১ সালে শিবনারায়ণ দাশের নকশা করা আমাদের জাতীয় পতাকাটি স্বাধীনতার পরে শিল্পী কামরুল হাসানের হাতেই আজকের এই চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল।  এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি মনোগ্রাম তৈরি করার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। কর্মজীবনে তিনি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন তথা বিসিক নকশাকেন্দ্রের প্রধান নকশাবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন বিমান বাংলাদেশের লোগোসহ প্রায় চার হাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ নকশার কাজ নিজ হাতে করেছেন তিনি। 


সে যাকিএই লেখাটি শেষ করার আগে বিশালহৃদয় ও বড়মাপের এই শিল্পীর জীবন নিয়ে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলতে চাই তোমাদের। তিনি জন্মেছিলেন আজকে আমরা যে দেশটিকে ভারত বলি, তারই একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে, ১৯২১ সালে। তোমরা তো জানো তখন আমাদের এই বাংলাদেশ ও আজকের ভারত, সবটা মিলে একটিই দেশ ছিল। তাঁর বাবা কলকাতায় একটি ছোটখাট কাজ করতেন, তাই শিশু কামরুলের হাতেখড়ি হয়েছিল সেখানকার সাধারণ স্কুল, মাদ্রাসাতেই।  ছাত্রজীবনে তিনি বয়স্কাউট, শরীরচর্চা, ব্রতচারী আন্দোলন, শিশু সংগঠন মণিমেলা, মুকুল ফৌজ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  ১৯৪৫ সালে তিনি শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় হয়েছিলেন ‘অল বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন’। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠকও। সেসময়েই হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করতেন তিনি। হাতে লিখে লিখে বের করেছেন এমনকি পত্রিকার ইদ সংখ্যাও। তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তিনি ছবি আঁকতে। তাই রক্ষণশীল সমাজের বাধা সত্ত্বেও তিনি একপ্রকার বিদ্রোহ করেই ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্টস স্কুলে ভর্তি হয়ে চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সেটা ১৯৪৭ সালের কথা, যেবছর দেশভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। 


সেইসময়ই পিতাকে হারিয়ে কামরুল হাসান পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সাথে মিলে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট স্কুল, যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হিসেবে পরিচিত। সেখানেই ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তিনি। পাশাপাশি ছবি আঁকার কাজ তো ছিলই।  দেশে-বিদেশে তিনি বহু একক এবং যৌথ চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকায়, ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুন, মিয়ানমারে; ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭৯ সালে লন্ডনের প্রদর্শনীসমূহ। ছোটবেলা থেকেই শরীরগঠন ও শুদ্ধাচার চর্চার জন্য মনীষী গুরুসদয় দত্ত কর্তৃক প্রবর্তিত ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে তাঁর মধ্যে বরাবরই জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবল অনুরাগ কাজ করত।  সেই প্রণোদনা থেকেই তিনি ৫২র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শামিল হন।  একই ধারাবাহিকতায় গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষদিকে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে যে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন জেগে উঠেছিল, তাতেও যুক্ত হতে দ্বিধা করেননি আজন্ম প্রতিবাদী শিল্পী কামরুল হাসান। এবং এই আন্দোলনের মাঠেই তিনি ঘৃণিত সেই স্বৈরাচারের ছবি আঁকতে আঁকতেই জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এমন মহৎ ও গৌরবময় মৃত্যুর সৌভাগ্য ক’জন শিল্পীর হয় তোমরাই বলো?  প্রিয় বন্ধুরা, মহান বিজয়ের মাসে চলো আমরা সবাই মিলে দেশমাতৃকার বীর সন্তান এই অসমসাহসী, সংগ্রামী শিল্পীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। সেইসঙ্গে জানাই আমাদের সম্মিলিত, আনত অভিবাদন।


পুনশ্চ: বন্ধুরা, তোমরা এই শিল্পীর মহাকাব্যিক জীবন নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত লেখক হাসনাত আবদুল হাইয়ের তাঁকে নিয়ে লেখা ‘লড়াকু পটুয়া’ বইটিও পড়ে নিতে পারো।

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!