কয়েক দিন আগেও আমি অ্যালিস ওয়াকারের নাম শুনিনি, বই পড়া তো দূরের ব্যাপার। সেবা প্রকাশনীর ক্ল্যাসিক অনুবাদ ছাড়া আমার ইংরেজি অনুবাদ পড়াই হয়েছে কম। তবু দেরি হয়ে গেলেও কিছু বই মন ছুঁয়ে যায়। মনে হয় খুব বেশি দেরি হয়নি, বরং পড়তে পারার আনন্দটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলায় অনূদিত অ্যালিস ওয়াকারের ‘দ্য কালার পার্পল’ সবার জন্যই পড়া জরুরি।
পড়তে পড়তে আর অনুসন্ধানে জানা গেল, অ্যালিস ওয়াকার বিশাল এক মানুষ। রীতিমতো জীবন্ত কিংবদন্তি লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। অ্যালিস ওয়াকার ‘দ্য কালার পার্পল’-এর জন্য প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী লেখক হিসেবে পুলিৎজার পর্যন্ত পেয়েছেন। এই উপন্যাসটি প্রায় দুই ডজন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আমি পড়েছি বাংলায় অনুবাদ, মোস্তাক শরীফ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করেছেন। মূল উপন্যাসটি পঞ্চাশ লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে। তবু স্কুলের লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ ছিল ত্রিশ বছর। বিবিসি এই বইটিকে একশ অনুপ্রেরণাদায়ী বইয়ের তালিকায় রেখেছে। এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা মিউজিক্যাল কত কী হলো।
অ্যালিস ওয়াকার ষাটের দশক থেকেই সিভিল রাইটস আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। ২০০৩ সালেও তিনি ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আমেরিকার শত শত সেলিব্রেটি তার বই থেকে অনুপ্রাণিত।
দ্য কালার পার্পল পড়ার শুরুর দিনগুলো খুবই বিষণ্ণ কেটেছে। এক কিশোরী মেয়ে তার বাবার হাতে দিনের পর দিন ধর্ষিত হচ্ছে, তাদের দুটো বাচ্চাও হয়েছিল। ছোট বোন তার একমাত্র বন্ধু, তাকে বাঁচানোর জন্য সে এক কালো সাহেবের বউ হচ্ছে। যে বয়সে অনেক বড়। যার আগ্রহ অবশ্য তার ছোট বোন নেলির প্রতি। পরে দুই বোন আলাদা হয়ে যায় ভাগ্যের নির্মমতায়। কালো সাহেবের অনেকগুলো সন্তান, তাদের বাঁচিয়ে রাখা ও মানুষ করা—এসব কিছু নিয়ে সে খোদার কাছে চিঠি লেখে। সেই চিঠিতে অভিশাপ নেই, আছে ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার ও সমাজ সভ্যতা এসব নিয়ে শ্লেষ। আমেরিকান ব্ল্যাক হিস্ট্রিতে কেন এই বই এত গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা যায়। অনেক হেরে গিয়েও উপন্যাসের চরিত্র সেলি, নেলি, সোফিয়া, শাগ এরা হারটা স্বীকার করে না। কোনো এক নতুন দিনের জন্য লড়াইটা চালিয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকার সমাজ কেমন ছিল, কতটা বঞ্চিত ছিল কালোরা, কী অবর্ণনীয় পুরুষতান্ত্রিকতা ছিল সেই সময়, সেই গল্প আছে নিখুঁতভাবে।
এত বঞ্চনার ভেতরেও উপন্যাসের মুখ্য নারী চরিত্রগুলো সৎ ও সাহসী। জীবন থেকে তারা পালিয়ে যায় না। এত বাচ্চাকাচ্চা লালনপালনে ও সংসারে বিপুল সহিংসতার শিকার হয়েও তারা ভালোবাসতে চায়, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের সান্নিধ্য চায়। আফ্রিকান আমেরিকানদের যে লড়াই করে যাওয়ার বাসনা সেটা প্রতীয়মান হয় বারবার। অ্যালিস ওয়াকারের ‘দ্য কালার পার্পল’ সব সময় মনে করিয়ে দেয়, নারীর পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধু হবে নারী, নয়তো সেই সমাজে টিকে থাকা হবে আরও যন্ত্রণাদায়ক। আরও জানানো হয়, এত দুর্বিষহ এক জীবনের পরেও নারীর পক্ষেই সম্ভব প্রতিহিংসায় সবকিছুকেই জ্বালিয়ে না দেওয়া। কারণ নারী নির্মাণ করে, প্রকৃতির মতোই টিকে থাকে এই বিরূপ পুরুষতান্ত্রিকতা ও অসহনীয় সামন্তবাদের ভেতরেও।
দ্য কালার পার্পল অবশ্যপাঠ্য একটা বই। যাদের মূলটা পড়া নেই তারা পড়তেই পারেন এবারের বইমেলায় আসা মোস্তাক শরীফের অনুবাদ। আমেরিকার ব্ল্যাকদের ইংরেজি আমাদের জন্য কিছুটা দুস্পাঠ্য। তবে মোস্তাক শরীফের প্রাঞ্জল অনুবাদে বাংলায় পড়তে খুবই সহজ লাগে। আর চিঠির মতো করেই মূল উপন্যাসটি লেখা, তাই কোনো ধরনের একঘেয়েমি নেই। দ্য কালার পার্পল পড়তে পড়তে মনে হলো, ওখানের মতোই তো আমাদের দেশের অসংখ্য মা-মাসিদের জীবন ছিল, চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ছিল, চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ছিল এবং এখনো আছে। তাদের গল্প কোথায়?
বইয়ের নাম : দ্য কালার পার্পল
মূল লেখক : অ্যালিস ওয়াকার
অনুবাদ : মোস্তাক শরীফ
প্রকাশক : বাতিঘর
মূল্য : ৬৮০ টাকা