• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আহমদ ছফা যেখানে অনন্য


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২৩, ১২:০৯ পিএম
আহমদ ছফা যেখানে অনন্য

‘আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারিদিকে এত অন্যায়, অবিচার মুঢ়তা এবং কাপুরুষতা ওঁত পেতে আছে যে এ ধরণের পরিবেশে নিতান্ত সহজে বোঝা যায় এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলে না।”
আহমদ ছফা। সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস

৫২ বছর পরেও এরচেয়ে সত্য কথা আর কী। শুধু মাত্র চিন্তার দায়ে, লেখার দায়ে মারা পড়ছে মানুষ। এমনকি বই প্রকাশের জন্যও খুন হচ্ছে মানুষ। প্রফেসর আহমদ শরীফ এ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “আহমদ ছফা বয়সে কাঁচা, মনে পাকা, সংকল্পে অটল। দৃষ্টি তার স্বচ্ছ, বাক্য তার ঋজু, বক্তব্য স্পষ্ট, উদ্দেশ্য তার সাধু। মাটি মানুষের প্রতি প্রীতিই তার কল্যাণকামিতা ও কর্মপ্রেরণার উৎস এবং তার প্রাণ শক্তির আকর। এ জন্যেই ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েই সে সত্য কথা বলার সৎ সাহস রাখে।”

আহমদ ছফা ব্যক্তিগত জীবনে অনেকের জন্য অনেক কিছু চাইতেন, করেও দিতেন। কিন্তু নিজের জন্যও অনেক কিছুতে সম্ভাবনা দেখতেন, কিন্তু তার কিছুই কিছুদিন পর থেমে যেত। দীপঙ্কর গৌতমের মুখে শুনেছিলাম, তিনি কাজী শাহেদকে ফোন করে মাঝেমধ্যে বলতেন, আপনি একটা লোকের নাম বলেন যাকে ধরলে একটা চাকরি হবে। আমার অমুক লোকটার একটা চাকরি ভীষণ দরকার। কাজী শাহেদ লজ্জায় পড়ে বলতেন, “কী যে বলেন ছফা ভাই, পাঠান আমার কাছে। চাকরি হয়ে যাবে। তখন বাংলাবাজারেই সৃজনশীল বইয়ের হাব, অনেকের টাকা আটকে থাকতো প্রকাশকের কাছে। তিনি রীতিমতো প্রেশার দিয়ে টাকা বের করে দিতেন। প্রতিদিন গিয়ে সকাল সন্ধ্যা হাজিরা দিতেন, টাকা দেবে না কেন। ভাইয়ের ছেলের লেখা দেখাতেন, ছেলেটার ভালো চাকরির ব্যবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকতেন। দু তিন বার পত্রিকা চালাতে গিয়ে ওনার থামতে হয়েছে। নিজের লোকসান তো ছিলোই, যে যে বন্ধু পার্টনার ছিল তাদের প্রতি খুব ব্যথিত ছিলেন। মরণের আগ পর্যন্ত তাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা বারবার বলেছেন। কারো বেতন তিনি মেরে দেওয়ার চিন্তা কখনোই করেননি, উল্টো কাজ না করেই বেতন দিয়েছেন।

বিভিন্ন দশকে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে ছফার বিয়ের কথা উঠতো। উনিও দু-একবার ঘোষণা দিতেন। ঘোষণার মতো ঘোষণা থাকতো, বিয়ে আর এগোতো না। ম্যারি ড্যানহাম নামের এক মার্কিন নাগরিক বাংলাদেশে এসে খুব অবাক হয়েছিলেন, একজন মানুষের বিয়ে নিয়ে সবাই কেন  এত বিরক্ত করে? পত্রিকায় কলাম লিখতে তিনি হুট করে মজা পাওয়া শুরু করলেন। টাকা আসতো তাতে কিছু। দুদিন বিশাল বাজার সদাই করে সবাইকে খাওয়াতেন। তারপর আবার সেই আগের মতো। তারুণ্যে ওনার পকেটে টাকা পয়সা থাকতো না খুব। শরীফের ক্যান্টিনে চা নাস্তা করে বই পড়তেন। এত মনোযোগ দিয়ে তিনি পড়তেন লাইব্রেরিতে, সারাদিন খাননি তা নিজেই মনে রাখতেন না। বিখ্যাত সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তান আর তিনি মিলে যখন স্কুল খুলেন বস্তির ছেলেদের জন্য তখন ওনার রুল ছিল একটাই, বড়লোকদের কাছ থেকে টাকা নেবো না। টাকা যদি নেই মধ্যবিত্তের কাছ থেকেই নেবো। কারণ বড়লোকের দেওয়া বেশুমার টাকায় কাজ করলে প্রতিষ্ঠানে দায়বদ্ধতা থাকে না কাজের। অল্প টাকায় কাজ করলে রেসপন্সিবল ভাবে কাজ করা যায়। অনেক কিছু লেখার প্ল্যান করতেন, খসড়া করেও তা আর ফাইনাল করতেন না, লেখা পড়ে থাকতো সেভাবেই। ওনার ধারনা ছিল আরও বেশ কিছুদিন থাকবেন, তাই অনেক কিছু লেখাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু অকালমৃত্যু সব শেষ করে দেয়।  

আমি ছফার লেখা নিয়ে কিছু লিখি না, আগে লিখতাম। আসলে ভক্তিবাদ থেকে কিছু লিখলে সেটা যুৎসই কিছু হয় না, নির্মোহ থাকা জরুরি। তাই আমি লিখি মানুষ ছফাকে নিয়ে, যাকে আমি দেখিনি। কিন্তু লেখা পড়ে মানুষের কথা শুনে উপলব্ধি করি। এখানে ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু যে দীপ্তিময় মানুষ তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। প্রফেসর আহমদ শরীফ একবার লিখেছেন, “ছফার মতো আরও কিছু মানুষ পেলে বাংলাদেশটা পাল্টে দিতাম।”

পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ যখন সরকারি রোষানলে, তখন আহমদ ছফা আর তার দুই এক বন্ধুই উদ্যোগ নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই দেশের বুদ্ধিজীবীদের মননশীল প্রবন্ধের এক সংকলনের। বইটা পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মুগ্ধ করে, ছফা আর আহমদ শরীফের প্রবন্ধ প্রশংসিত হয়, বাজারে চলেও ভালো। আর সেই ছফাকে এখন অনেকে বলে ভারতের পুস্তক বিরোধী। রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণার দিন উনি আর বদরুদ্দীন ওমর মিলে যে পত্রিকা বের করেন তার সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। যাতে খোলাখুলি ভাবে বলা ছিল, মুক্ত বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা।

বেঁচে থাকলে আহমদ ছফার আজ বয়স হতো ৮০-৮১ বছর। বাংলাদেশে প্রচুর বুদ্ধিজীবী অবলীলায় ৭০-৮০ বছর বাঁচেন। অথচ আপনি গত হয়েছেন সেই দুই দশক আগে। আহমদ ছফাকে নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন হয়তো, আপনার প্রিয় আজিজ মার্কেট এখন বঙ্গবাজার, যে বাংলাবাজারকে নিয়ে আপনার এত আশা ভরসা ছিল, তা এখন পাঠ্যপুস্তক থেকে দূরে গিয়ে সৃজনশীল গাইড বই বিক্রির জায়গায়। আপনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের যেমন দেখে গিয়েছিলেন, অবস্থা এখন সেই তুলনায় আরও বেশী সংকটাপন্ন!

গড়পড়তা আমজনতার রুচি আরও বেশী নিম্নমুখী। জাতীয় সাহিত্যের অবস্থা করুণ। আমাদের পড়াশোনা আরও বেশী সেকেলে। ফেসবুক ইন্টারনেটে নোংরামি ও গোঁড়ামির মচ্ছব। আপনার প্রিয় জাতীয়তাবাদের অবস্থা মর্মান্তিক। তাই ভালোই আছেন, দূরে চলে গেছেন। আমার মতো কতিপয় বোকাদের ভক্তিতে, কিছু প্রোফাইল পিকচারে, খান পাবলিকেশন্সের সমগ্রে আর সলিমুল্লাহ খানের এক্টিভিজমেই টিকে আছেন। উইকির পেইজে সুন্দর একটা কথা এক লাইনে লেখা—জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী, নির্মোহ, অকপট দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন।

জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ এরকম একটা অসাধারণ মানুষকে।

Link copied!