“… যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংস আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।”
—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
“আমরা মনোবিশ্লেষণ থেকে জেনেছি, অবদমনের প্রক্রিয়া মূলত এমন এক ধারণার মধ্যে গঠিত, যা অপসারিত বা ধ্বংস না হয়ে ইন্দ্রিয়র (ড্রাইভ) ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়, কিন্তু ওটাকে আবার চেতনা (কনশাস) হয়ে উঠতেও বাধা দেয়। তাই আমরা বলি, এই ধারণার বাস ‘অচেতন’ (আনকনশাস) রাজ্যে এবং আমাদের কাছে জোরালো প্রমাণ আছে অচেতন অবস্থাতেও এটি বেশ সক্রিয় থাকে, এতটাই সক্রিয় থাকে যে মাঝেমধ্যে এটি শেষতক চেতনার মধ্যেও ভেসে ওঠে।”
—জিগমুন্ট ফ্রয়েড
মন কী অবদমন করে? কামনা, বাসনা, লোভ, লালসা—এসব। সেগুলো অচেতনের আড়ংয়ে জমা হয় বটে, কিন্তু ফ্রয়েড সতর্ক করে বলছেন, মনে রাখতে হবে, অচেতন মাত্রই অবদমিত জিনিসপত্রে ঠাসা কোনো ব্যাপার নয়। সেখানে আরও বিষয়বস্তু থাকে। অচেতন এক অন্ধকার জগৎ। যে জগতে পৃথিবীর আলো, অর্থাৎ মানুষের জ্ঞানের আলো এখনো পৌঁছুতে পারেনি। অনুমান পৌঁছেছে মাত্র। সেটা কীভাবে পৌঁছাল? ফ্রয়েডের বয়ান অনুসারে, অচেতনে জমে থাকা অবদমিত জিনিস মাঝেমধ্যে চেতনে ধরা দেয়। চেতন বলতে আমাদের কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা, এমনকি স্বপ্নও।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘প্রাগৈতিহাসিকে’ ডাকাত থেকে ভিক্ষুক হওয়া ভিখু যেভাবে বসিরকে হত্যা করে এবং তার শয্যাসঙ্গী আরেক ভিক্ষুক পাঁচীকে তুলে নিয়ে যায়। কিংবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দখল’ গল্পে যেভাবে রহস্যময়ী নারী দাক্ষীকে ঘিরে সন্তোষ ও ভবেন কামনা ও আশ্রয়ের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে, আর ভিটের নিচে বাসনারূপী সাপেরা খেলা করে, ঠিক তেমনি ষড়রিপুর চক্র দেখা যায় যুবরাজ শামীমের ‘আদিম’ (২০২৩) সিনেমায়।
এই গল্পে দেখা মেলে— সোহাগীকে কেন্দ্র করে তার স্বামী কালা ও মাদকবিক্রেতা ল্যাংড়ার ত্রিমুখী টানাপোড়েন। সোহাগীর স্বামী কালা নিজে ফেনসিডিলের সরবরাহকারী ও নেশাগ্রস্ত, অধিকাংশ সময় মাজারে পড়ে থাকে। সে নিষ্কর্মা ও অলস। অতিদরিদ্র সংসার টানতে তাই সোহাগীর যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অপর দিকে টঙ্গী রেলস্টেশনে গাঁজা বিক্রি করে ল্যাংড়া। মাদক বিক্রির সুবাদে কালা তার বন্ধু। ব্যবসায়িক কারণে কালা একদিন নিজের বস্তিঘরে নিয়ে আসে ল্যাংড়াকে। তখন ল্যাংড়ার চোখ পড়ে সোহাগীর দিকে। কালার ঘরে যাওয়া-আসা বাড়ে ল্যাংড়ার। সোহাগীর জন্য উপহার হিসেবে আসতে থাকে স্বস্তা অলংকার ও প্রসাধনী। তার চেয়েও বড় হয়ে আসে দুমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা, যা কালার সংসারে পাচ্ছিল না সোহাগী। ল্যাংড়ার কামনার ফাঁদে সে পা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে কালা ও কালার বস্তির লোকজন বিষয়টি জেনে যায়।
স্টেশনে এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুককে একদিন রাতে শোয়া নিয়ে অপমান ও মারধর করেছিল ল্যাংড়া। সেই প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। কালার স্ত্রীকে ল্যাংড়া ভাগিয়ে নিয়ে গেলে সে সুযোগ হাতে আসে ভিক্ষুকটির। ভিক্ষুকটিই ল্যাংড়ার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে দেয় কালাকে। কালা গ্রাম থেকে ধরে আনে দুজনকে। কালার হাতে ধরা খাওয়ার পর ল্যাংড়া অপদস্থ হয়, সোহাগীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর হয় বিধ্বস্ত, তখন সুযোগ বুঝে ল্যাংড়াকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয় ভিক্ষুকটি। ল্যাংড়া ছিল ভিক্ষুকটির জন্য এক মূর্তিমান হুমকি। তাকে হত্যার পর স্টেশনে তাকে বিরক্ত করার কেউ রইল না। রাতে শোয়ার জায়গাটি নিয়েও আর কেউ ঝামেলা করার থাকল না। ‘আদিম’ শেষ হয় এখানেই।
নিম্নবর্গীয় মানুষের, নির্দিষ্ট করে বললে রাজধানীর অদূরে এক রেলস্টেশনে, যেখানে মাদক ও চুরি-ছিনতাই গরিব মানুষের একটি বড় অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি, যেখানে প্রশাসনকে মাসোয়ারা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মাদক ব্যবসা করতে হয়, যেখানে বড়লোক ঘরের সন্তানেরাও মাদক সংগ্রহ করতে আসে, আবার সামান্য চুরি হওয়া মোবাইলকে কেন্দ্র করে খুনখারাবি পর্যন্ত হয়, সেখানে নির্মাতা আমাদের এমন এক গল্প শোনালেন, যে গল্প রিপুতাড়িত। আদিম এসব প্রবৃত্তি মানুষকে লাইনচ্যুত করে দেয়। যেমনটা দিয়েছে সোহাগী ও ল্যাংড়াকে। সোহাগীর ট্রেন পুনরায় লাইনে উঠে গেলেও, ল্যাংড়ার ট্রেন জীবনের লাইন ছেড়ে অনন্তের পথ ধরে। রেলগাড়ি এই ছবিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ। একটু মতি খরচ করলেই বোঝা যায় রেলগাড়ি ও রেলস্টেশন এখানে এক রূপক। রেলগাড়ি এখানে আসে আর যায়, কখন কোনটা আসছে তার যেন কোনো ঠিক নেই। আসছে আবার চলে যাচ্ছে। রেলস্টশন যেন জীবন। এই চলাচলে ল্যাংড়ারা লাইনচ্যুত হয়, কালারা লাইনে টিকে থাকে। প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের মতো অনেকে আবার লাইন পরিবর্তন করে ফেলে।
সোহাগীর মনের ভেতর শুরু থেকেই একধরনের অতৃপ্তির দেখা পাওয়া যায়। কালার অকর্মণ্য জীবনযাপন ও সামান্য ফেনসিডিল বহনের অকিঞ্চিৎকর অর্থে সোহাগীর সংসার প্রত্যাশামাফিক চলছিল না। কিন্তু একজন ল্যাংড়ার অভাবে সেই প্রত্যাশা অবদমিতই ছিল। আর সোহাগীকে দেখার আগ পর্যন্ত রিরংসা অবদমিত ছিল ল্যাংড়ার মনে। ভিক্ষুকটির মনে অবদমিত ছিল ঘৃণা, দখলদার ও স্বশ্রেণিঘাতী হওয়ার বাসনা। সেসব অবদমিত বাসনার স্ফুরণ আমরা দেখি এই ছবিতে। সেই সঙ্গে দেখি কিছু চমৎকার দৃশ্য। যেমন শেষ অঙ্কে, ভিক্ষুকটি যখন ল্যাংড়াকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন ছুরির ছায়া দেখি ঘুমন্ত ল্যাংড়ার মুড়ি দেওয়া চাদরে। উপর্যুপরি আঘাতে যখন ল্যাংড়া পরপারের স্টেশনে যাত্রা শুরু করেছে, তখন চলমান রেলগাড়িকে দেখা যায় বেঁকে গেছে, কিতাবি ভাষায় যাকে বলে ‘ডাচ অ্যাঙ্গেল’। আরেকটি জায়গায় শব্দের মন্তাজও ভালো লেগেছে। ল্যাংড়া যখন কালার স্ত্রী, সোহাগীকে নিয়ে চিন্তায় মশগুল, তখন বস্তির কোনো এক দোকান বা ঘর থেকে ভেসে আসে বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক ডিপজলের কণ্ঠ এবং ডিপজল সেখানে ভাবি-সংক্রান্ত ইঙ্গিতপূর্ণ সংলাপ বলছিলেন। এমনিতে প্রায় পুরো সময়টাতেই ক্যামেরা চরিত্রদের কাছ থেকে অনুসরণ করেছে, প্রতিক্রিয়াকে ধরেছে। চরিত্ররাও বেশ স্বাভাবিক থেকেছেন ক্যামেরার সামনে। যদিও তারা কোনো প্রশিক্ষিত অভিনয়শিল্পী নন।
ভিত্তোরিও ডি’সিকার ‘বাইসাইকেল থিভসে’ যেমন প্রকৃত লোকেশন ব্যবহার করে, অপেশাদার মানুষদের দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছিল, ‘আদিমে’ও তাই হয়েছে। তবে কিছুটা নির্মাণের অভিজ্ঞতার অভাবেই বোধ হয়, চরিত্রদের দিয়ে সংলাপগুলো আরও একটু বাস্তবের কাছাকাছি করা যায়নি। চরিত্রদের সংলাপে একই বক্তব্য পুনরাবৃত্তি কানে লাগে। যেমন সোহাগী যখন কালাকে সংসারের ব্যাপারে ভর্ৎসনা করে, তখন দেখা যায়, কালা কেন এমন সংসারযাপনে লজ্জা পায় না, সেই প্রশ্ন সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার করছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়াতেও একই গালি বারবার শোনানো হচ্ছে।
ছবির ভেতরে ব্যবহৃত সংলাপে গালাগালি নিয়ে অনেকেই আপত্তি করতে পারেন, তবে সেটা আমি বলব ছবিটিকে দেখতে হবে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় নিয়ে। ২০১৮ সালে নির্মাতা যখন আমার কাছে চিত্রনাট্যটি নিয়ে এসেছিলেন, এবং গালাগালি থাকা নিয়ে তার অস্বস্তির কথা বলছিলেন, তখন আমি বিশ্ববরেণ্য ইংরেজ পরিচালক কেইন লোচের উদাহরণ দিয়েছিলাম।
এই ছবিতে কালা-সোহাগী-ল্যাংড়া—এই ত্রিভুজ ছাড়াও আরও কিছু চরিত্র রয়েছে, যেমন বস্তির প্রতিবেশী, মোবাইল ছিনতাইকারী, ভাঙারি দোকানের কর্মচারী ও মালিক, ল্যাংড়ার গ্রামবাসী ইত্যাদি। এসব চরিত্রের ভেতর সবচেয়ে দুর্বল লেগেছে ওই মূল ত্রিভুজের সঙ্গে ছিনতাইকারীদের যোগ। কালা ওদের কাছ থেকে চোরাই একটি মোবাইল ফোনসেট কেনে। এ ছাড়া আর কোনো যোগ নেই ওদের সঙ্গে। কিন্তু ছবিতে ছিনতাই কর্মকাণ্ড অনেকবার দেখানো হয়। ও রকম লোকে লোকারণ্য একটি রেলস্টেশনে এ ধরনের চরিত্র থাকে, তবে এদের সঙ্গে মূল ত্রিভুজের সম্পর্কটা আরেকটু জোরালো হলে ওদের উপস্থিতিটা আরও বেশি ন্যায্যতা পেত।
পরিচালক যুবরাজ শামীমের ছবিটি শুরু হয় কুকুরের ডাক দিয়ে, শেষও হয় মানুষ ও কুকুরের সহাবস্থান দিয়ে (খুন শেষে ভিক্ষুক বেঞ্চিতে নির্ভাবনায় যখন শোয়, তখন পাশে একটি কুকুর বেশ নিশ্চিন্তে ভক্ষণ করে যাচ্ছিল)। নিম্নবর্গের মানুষের জীবন যেন পশুর মতো আদিম নিয়মে চলে, তারা সামান্য কিছু পাওয়ার জন্য ঝগড়া-ফ্যাসাদ, এমনকি রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। পুরো ছবিতেই কুকুরের সঙ্গে বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষের সহাবস্থান লক্ষ করার মতো।
নগরের এক কোনায় অন্ধকারে পড়ে থাকা, দারিদ্র্যক্লিষ্ট এই ল্যাংড়া, সোহাগী ও কালারা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ (মাদক) ও মাৎসর্য (ঈর্ষা, হিংসা, হনন)—এই ছয় রিপুর দ্বারা তাড়িত, ভিক্টোরিয়ো নৈতিকতার তোয়াক্কা তারা করে না। সমাজে এই মানুষগুলোর টিকে থাকার লড়াইটা চলছে পাদপ্রদীপের আলোর নিচে অন্ধকার এলাকাতে। সেখানেই আলো ফেলার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। এমন এক অন্ধকার জগৎ সেটি, যেখানে পুরোপুরি আলোকপাত করা দুঃসাধ্য কাজ। কারণ, আমাদের চলচ্চিত্রে মাদক বহন, বিক্রি ও গ্রহণকে দেখানো যতটা সহজ, মাদক নিয়ন্ত্রণের হোতাদের দেখানো ততটাই কঠিন। নির্মাতা সাধনা করেছেন। তিনি তার ইচ্ছাশক্তির পরাকাষ্ঠা ছোঁয়া সফল হয়েছেন।
সহায়
১. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগৈতিহাসিক, প্রেম অপ্রেমের গল্প, (কলকাতা: চিরায়ত প্রকাশন, ২০০৮)
২. শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দখল, শ্রেষ্ঠ গল্প, (কলকাতা: দে’জ, ২০১৫)
৩. জিগমুন্ট ফ্রয়েড, দ্য আনকনশাস, ইংরেজিতে গ্রাহাম ফ্র্যাংকল্যান্ড অনূদিত, (লন্ডন: পেঙ্গুইন বুকস, ২০০৫)