‘অমিত চৌধুরীকে লেখা পত্রাবলি’ গ্রন্থে মোট চল্লিশ জন পত্রলেখকের একষট্টিটি পত্র (এবং উপরিপাওনাস্বরূপ অমিত চৌধুরীর ষোলটি পত্র) সংকলিত হইয়াছে। এই চিঠিপত্রে ১৯৭১ সাল হইতে ২০২২ সালের—অর্ধশতাব্দীর—একটা খণ্ডচিত্র পাওয়া যাইতেছে। খণ্ড হইলেও চিত্রটি মূল্যবান। আমি কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে এই বক্তব্য সমর্থন করিব।
প্রথমেই বলিতেছি খোদ অমিত চৌধুরীর কথা। পত্রাবলি সম্পাদক কালাম আজাদ পাদটীকাযোগে জানাইয়াছেন, ‘অমিত চৌধুরীর সার্টিফিকেট নাম সতীন্দ্রনাথ দে। পারিবারিক ও বন্ধুমহলে তিনি সন্তোষ দা নামে পরিচিত। আর কবি-লেখক সমাজে তিনি অমিত চৌধুরী নামে খ্যাত।’ আমি তাঁহাকে একদা সন্তোষ দাঁ (চন্দ্রবিন্দুসহ দাঁ) নামেও লিখিতে দেখিয়াছিলাম। নামের এই বাহারে একদা চরম পুলক অনুভব করিতাম। এতদিনে সেই পুলক আর জীবিত নাই। তাহা বরং একটা প্রশ্নে রূপান্তরিত হইয়াছে। মানুষ নাম পরিবর্তন করে কেন? কেহ করে রাজনৈতিক কারণে বা যুদ্ধের প্রয়োজনে। কেহ বা করেন শখের বশে। এই শখের পেছনেও কোন না কোন কারণ লুকাইয়া থাকে। সেই কারণ আলোচনার সময় বা সুযোগ কোনটাই এখানে নাই। শুদ্ধমাত্র এইটুকু বলিয়া রাখি, নাম পরিবর্তনের ইচ্ছা বা তাগিদ মানবমনের গভীর গভীরতর কোন সত্যের সন্ধান দেয়। নাম ছাড়া—কিংবা নামের বিকল্প কোন সংখ্যা ছাড়া—নাগরিকের চলে না। নামই জীবনের শেষ কথা নয়। মানুষ নাম বদলাইতে পারে। কানা ছেলের নাম দাঁড়াইতে পারে ‘পদ্মলোচন’। কিন্তু জীবন একটাই।
‘অমিত চৌধুরীকে লেখা পত্রাবলি’র মধ্যে সময়ের বিচারে যেমন তেমনি আবেগের পরিমাপেও প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছে মাহমুদা বেগম সাহানার চিঠি। সম্পাদক জানাইয়াছেন পত্রলেখক সাহানা (ওরফে সানু) চট্টগ্রামের শিক্ষা কলেজে (বর্তমানে সরকারি ব্যাচেলর অব এডুকেশন কলেজ) অমিত চৌধুরীর সহপাঠী ছিলেন। এই পত্রটি ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর তারিখে চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগ সড়ক হইতে লিখিয়া কক্সবাজারের ঠিকানায় পাঠানো হইয়াছিল। বাংলাদেশ তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছে অথচ পাকিস্তান বাহিনীর দখলে। ইহার ঐতিহাসিক মূল্য তাই সবিশেষ। পত্রলেখকের জবানি বিশেষ মূল্যবান, কেননা সকল ইতিহাসই শেষ বিচারে সমকালীন ইতিহাস।
মাহমুদা বেগম সাহানা লিখিয়াছেন: ‘দাদা, আজ তোমার খবর পেয়ে বাঁধভাঙা কান্নার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে অশান্ত মনের বালুচরটাতে। তুমি আমাকে একটা চিঠি লিখলে না কেন এতদিন? যখন প্রথম চিঠিপত্র বিলি আরম্ভ হোয়েছিল, তখন কক্সবাজারের ঠিকানায় (পাবে না জেনেও মনকে প্রবোধ দিতে) লিখেছি। বেঁচে থাকার এডভেঞ্চার কি শুনবে? এরচে’ লক্ষ গুণ বেশী অভিজ্ঞতা তোমাদের হোয়েছে। সে হিসেবে শরীরে আঁচড়টি লাগেনি আমাদের। যাক্ পালিয়ে বেঁচে আছি। হ্যাঁ, দাদা, চিন্তা কোরো না, ভালোও আছি আল্লাহর রহমতে। তোমার ও করিদার জন্য শাস্তি পাচ্ছি এখনো। পাঁজী মনটা বুঝতে চায় না সব কথা।’
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বিজিত বাংলাদেশে জনসাধারণ কি অবস্থায়, কোন আতঙ্কের মধ্যে, জীবনধারণ করিতেন এই চিঠিতে তাহার সামান্য আভাস পাওয়া যায়। তাহার অধিক একটা উপরিপাওনাও আছে আমাদের। তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কি রকম বাংলা বানান লিখিতেন তাহারও একটা নমুনা পাওয়া যায়। ‘হোয়েছিল’, ‘হোয়েছি’, ‘কোরো না’ প্রভৃতি বানানই তাঁহার সাক্ষী। সেকালের বাঙালী জাতীয়তাবাদ এই বানানের সূচনা করিয়াছিল।
অমিত চৌধুরীর সহিত আমার পরিচয় বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হইবার কয়েক বছরের মাথায়। সঠিক সময়টা এতদিনে আর মনে নাই। আমি তাঁহাকে কবি পরিচয়েই চিনিতাম। ২০১১ সালের শেষাশেষি (কিংবা ২০১২ সালের প্রথম দিকে) তাঁহার বয়স ষাট বছর হওয়া উপলক্ষে ছোট একটা লেখাও আমি লিখিয়াছিলাম। ততদিনে কবি পরিচয় ছাড়াইয়া উঠিয়াছে তাঁহার সম্পাদনাকর্ম। আমি জানিতাম পেশায় বা বৃত্তিতে তিনি শিক্ষক। তবু আমি তাঁহাকে কবি বলিয়াই জ্ঞান করিতাম। অবশ্য লক্ষ করিয়াছিলাম তাঁহার চরিত্রে মনীষার আবেগও ওতপ্রোত কায়দায় জড়িত।
আজহারউদ্দিন খান বরাবর লিখিত কোন এক চিঠিতে অমিত চৌধুরী নিজের জীবনবৃত্তান্ত একদিন—তারিখটা ৮ জুন ১৯৯৫—পেশ করিয়াছিলেন এইভাবে: ‘আমার নিজ বাড়ী কক্সবাজার। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে পিতৃমাতৃহীন হই। মেজো ভাই বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের (৭৩-৭৫) খেলোয়াড় ছিলেন এবং তাঁর প্রচেষ্টায় এম.এ., বি.এড. পর্যন্ত পড়েছি। নাম তাঁর সুনীল। বি.সি.আই.সি.-এর অধীনে তিনটি কলেজ (স্কুলসহ)। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কলেজ। এখানে শিক্ষকতা করছি যে পাঁচ বছর হলো। এর আগে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। ব্যক্তিগতভাবে লেখালেখি করি। চারটি কবিতার বই আছে। গত বছর দুই বাংলার ৯৫ জন কবিদের লেখার সমন্বয়ে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবিতা সংকলন ‘শেকল ছেড়ে’ প্রকাশ করেছি ‘মূল্যায়ন’ সাহিত্য পত্রের মাধ্যমে। আর তার ভ‚মিকা লিখে দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান।’ চিঠিতে উল্লিখিত ‘বি.সি.আই.সি. মানে ‘বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন’ অর্থাৎ বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প কর্পোরেশন।
মাহমুদা বেগম সাহানার পত্রে যেমন তেমনি স্বয়ং অমিত চৌধুরীর লেখায়ও বাংলা ভাষার সমকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু খবর অজ্ঞাতসারে পাওয়া যায়। ‘দুই বাংলার ৯৫ জন কবিদের লেখা’—এই বাক্যাংশ পাঠ করিলেই বোঝা যায় এ কালের শ্রেষ্ঠ লেখকেরাও কোন জায়গায় দৃষ্টিহীন। ‘দুই বাংলার ৯৫ জন কবির লেখা’ লিখিলেই চলিত। কিন্তু গড়পড়তা কেন একালের শ্রেষ্ঠ লেখকেরাও লিখিতেছেন ‘৯৫ জন কবিদের লেখা’ জাতীয় গদ্য। এই অভিজ্ঞতা ব্যতিক্রমের প্রমাণ নয়, সামান্য নিয়মের প্রদর্শনী মাত্র। আমাদের উচ্চমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা যাহা শেখান হয় তাহা শোচনীয়। পরে আর বাংলা শেখার পাথেয় জোটে না আমাদের ছেলেমেয়ের।
শুদ্ধমাত্র মাহমুদা বেগম সাহানার পত্রেই নয়, বর্তমান পত্রাবলির সম্পাদক কালাম আজাদের (আমার সংশয় হয় ইহাও হয়ত ছদ্মনাম হইবে) লেখা পত্রের মধ্যেও অমিত চৌধুরীর জীবনবৃত্তান্ত কিঞ্চিৎ জানা যায়। কালাম আজাদ লিখিতেছেন, ‘তাছাড়া কিছুদিন আগে মোশতাক স্যারের সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানতে পারলাম আপনিও নাকি যুদ্ধের সময় উনাদের সাথে বার্মায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন আপনার বড় ভাইসহ। আপনাদের পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন মোশতাক স্যার।’ মনে রাখিতে হইবে, কালাম আজাদের পত্রটি ২২ মার্চ ২০১৫ সাল তারিখে লেখা। ইহাকেই কি বলে ইতিহাস, বর্তমানের ক্রোড়ে বসিয়া অতীতের কথা স্মরণ যাহার সংজ্ঞা?
আরেকটি পত্রে অমিত চৌধুরীকে দেওয়া কোন এক সংবর্ধনার তথ্য আছে। ১০ অক্টোবর ২০১১ তারিখে নিউ ইয়র্ক হইতে বদিউল আলম লিখিয়াছেন, ‘সম্প্রতি কক্সবাজারে আমার স্ত্রী খালেদার কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, আপনার ৬০ বছর বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে প্রফেসর ড. সলিমুল্লাহ খান প্রধান অতিথি হয়ে আসছেন। তাতে আমি অতি প্রীত হয়েছি। ওই রকম পণ্ডিতজনের উপস্থিতি আপনার অনুষ্ঠানকে ধন্য করবে। উল্লেখ্য যে, আপনার সাহিত্য কর্মের উঁচু মান আছে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। গুণীজনেরা আপনার মূল্যায়ন নিশ্চয়ই যথাসময়ে করবেন।’ এই চিঠিতেও বাংলা ভাষার জবর খবর আছে, যেমন ৬০ বছর বর্ষপূর্তি অথবা ‘উপলক্ষ্য’ শব্দের বানান।
পরিশেষে ২০ এপ্রিল ২০১৮ নাগাদ (এই পত্রাবলির ৫৮ নম্বর পত্রযোগে) রুহুল কাদের বাবুল জানাইতেছেন, ‘আদাব জানবেন। আপনার অবগতির জন্য জানানো হচ্ছে যে, ককসবাজার সাহিত্য একাডেমী নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনাকে ২০১৬ সালের একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। সাহিত্য পুরস্কারটি প্রদানের জন্য ২৭ এপ্রিল ২০১৮ বিকাল তিনটায় কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মিলনায়তনে এক সভার আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।’
শামসুজ্জামান খান ভাগ্যবান, তিনি দফায় দফায় বেশ কয়েকবার বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনোনীত হইয়াছিলেন। মহাপরিচালক পরিচয়ের প্রথম দফায়—৫ আগস্ট ২০০৯ সালের এক পত্রযোগে—তিনি অমিত চৌধুরীর কীর্তি—বিশেষ তাঁহার সম্পাদনাযজ্ঞের—ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন। সেই প্রশংসার অংশবিশেষ এই রকম: ‘কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকা থেকে প্রকাশিত ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকায় মনীষী শিবনারায়ণ রায় স্মারক সংখ্যাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উঁচুমানের লেখায় সমৃদ্ধ সংকলন গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। সংকলনটি শিবনারায়ণ রায়ের গুরুত্বপূর্ণ লেখা, সাক্ষাৎকার, মন্তব্য ও পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় সমৃদ্ধ। অন্যদিকে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট লেখক এবং চিন্তাবিদগণ শিবনারায়ণ রায়ের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও দর্শনকে বহুমাত্রিকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। ফলে এই ব্যতিক্রমী সংকলনটি শিবনরায়ণ রায় সংক্রান্ত একটি আকর সংকলনে পরিণত হয়েছে। এর গুরুত্ব অসাধারণ। আমি এ সংকলনের সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই।’
লোকে বলে চাঁদেরও একটা অপর পিঠ আছে। মাহমুদ শাহ কোরেশীকে লেখা ৮ জুন ১৯৯৫ তারিখের পত্রে অমিত চৌধুরী সেই পিঠটাও খানিক দেখাইয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, ‘যা হোক, আপনার লেখা পেয়ে গর্ববোধ করছি, স্যার। আমি সরাসরি আপনাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইনি। (আপনি) যে বছর রাজশাহী চলে গেলেন ঠিক সে বছরই প্রিলিমিনারীতে ভর্তি হই বাংলা বিভাগে। আর পাশ করে স্কুলে ও পরে বর্তমান কর্মস্থলে শিক্ষকতা করছি মাত্র। অনার্স না থাকায় যন্ত্রণায় বিদ্ধ। (আমার কীর্তির মধ্যে) চারটি কবিতার বই আছে। গত বছর কবি শামসুর রাহমানের ভ‚মিকা সহযোগে দুই বাংলার সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবিদের লেখায় ঋদ্ধ একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলাম। বইটির নাম “শেকল ছেড়ে”।’
অনার্স না থাকার যন্ত্রণাবিদ্ধ অমিত চৌধুরী সেই যন্ত্রণা উপশমের চেষ্টা অল্পস্বল্প করিয়াছিলেন বলিয়াই মনে হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সেই চেষ্টার সাক্ষী। অমিত চৌধুরীকে দৃশ্যত তিনি হতাশই করিয়াছিলেন। ৩০ অক্টোবর ১৯৯৭ তারিখ—রাত ১১টা নাগাদ—তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘এম.ফিলের নিয়ম জানিয়ে দিচ্ছি: অনার্স না থাকলে ডিগ্রি বা প্রিলি বা মাস্টার্স ফাইনালে একটা ফার্স্ট ক্লাস থাকতে হবে। এর অন্যথা গ্রাহ্য নয়।’ এই সেই পদার্থ যাহাকে বলে ‘তবুও বিশ্ববিদ্যালয়’। বিশ্ববিদ্যালয় আজও সেই বন্ধ্যা ও সৃষ্টিহীন কতিপয় আমলার আলয় বৈ নয়।
অমিত চৌধুরীর মতন মরার উপর খাড়ার ঘাও দেখিতেছি পড়িয়াছিল কয়েকটা। তাহার খানিক চিহ্ন ৬ জুন ২০০৪ তারিখে লেখা জনৈক সরকারি কর্মচারির পত্রে বিধৃত আছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের জনৈক উপ-পরিচালক—নাম শফিকুল আলম খান—এক পত্রযোগে জানাইয়াছিলেন: ‘মূল্যায়ন’ এর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৪১১ বাংলা, মে-জুন ২০০৪ ইংরেজী সংখ্যায় রেল কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে এবং বিজ্ঞাপন বাবদ একটি বিল পরিশোধের (আবেদন) জানিয়ে নিম্নস্বাক্ষরকারীর নিকট পাঠানো হয়েছে। আমাদের সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় আপনাদের উপরিলিখিত প্রকাশনায় রেলওয়ের কোন বিজ্ঞাপন দেয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোন প্রকাশনায় রেলওয়ের কোন বিজ্ঞাপন ছাপানো শুধু আপত্তিজনক নয় মারাত্মক অন্যায়ও বটে।’ এই ঘটনার পটভ‚মি সম্পাদকের টীকায় লেখা হইয়াছে।
এই পর্যন্ত গেল অমিত চৌধুরীর জীবনবৃত্তান্ত লেখকের পক্ষে অপরিহার্য কিছু প্রয়োজনীয় সংবাদ। তাঁহাকে লেখা মনীষী ও যশস্বী লেখকদের নানাবিধ পত্রে গত পঞ্চাশ বছরের সমাজচিত্রও খানিক লভ্য হইয়াছে। এক্ষণে এই দ্বিতীয় প্রসঙ্গের কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থিত করিতে হইবে। সমাজচিত্রেরই অপরিহার্য অংশ ভাষাচিত্র। তাহার খানিক ইঙ্গিত আমি উপরে দিয়াছি।
অমিত চৌধুরী বহু গুণীজনের নামে নিজের সম্পাদিত ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকার বিশেষ বা স্মারক সংখ্যা প্রকাশ করিয়াছেন। আবুল ফজলের নামে প্রস্তাবিত সংখ্যাটির জন্য তিনি একদা আহমদ শরীফকে লেখার অনুরোধ জানাইয়াছিলেন। আহমদ শরীফ উত্তরে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহাতে শিক্ষার উপাদানও আছে। শরীফ সাহেব লিখিয়াছিলেন, ‘আবুল ফজল সাহেব আমারও অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাঁর সম্বন্ধে মূল্যায়নমূলক দুটো লেখা আমার রয়েছে। নতুন কোন বক্তব্য না থাকলে আমি সাধারণত কারো সম্বন্ধে বারবার লিখি না।’ এই পত্রের তারিখ ৮ জুলাই ১৯৯৬।
আবুল ফজল বিষয়ে বেশ পশরা খুলিয়া লিখিয়াছেন প্রতাপ মুখোপাধ্যায়। তাঁহার ২৩ জুলাই ১৯৯৬ সালের পত্রটি বেশ তথ্যবহুল। তিনি জানাইয়াছিলেন: ‘আবুল ফজল সাহেবকে আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত করে বোধ হয় ১৯৭৪ সালে একটি পত্র লিখেছিলুম। পত্রের উত্তরে তিনি আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়ে একটি সুন্দর পত্র পাঠিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির অন্যতম উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করেছেন সংবাদ পেয়ে পরের বছরের শেষ দিকে তাঁকে একটা অভিনন্দন পত্র লিখেছিলাম, সে চিঠিরও তিনি উত্তর দিয়েছিলেন অত্যন্ত বিনীতভাবে। এই বিনয় যে লোকদেখানো বা তথাকথিত বৈষ্ণবীয় ছদ্ম বিনয় মাত্র নয়, সেটার প্রমাণ বছর পাঁচ পরে, চট্টগ্রামে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎদর্শন ও বাক্যালাপে পেয়ে আমার মন শ্রদ্ধাভক্তিতে নত হয়ে গিয়েছিল।’ প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের পত্র তাঁহার স্বভাবের অনুগামী অর্থাৎ বরাবরের মতই দীর্ঘ ও তথ্যবহুল। যাহারা পছন্দ করেন না তাহারা বলিবেন খানিক প্রগলভ। অধ্যাপকদের লেখা সচরাচর এই দোষে দুষ্টই হইয়া থাকে।
আবুল ফজলের বিখ্যাত অবৈষ্ণব বিনয়ের আরো পরাকাষ্ঠা ধরা পড়িয়াছে প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের পত্রে: ‘এতক্ষণের আলোচনায় আমি প্রসঙ্গত দুএকবার তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে কথা তুললে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও কথা থাক্। আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করার সময় এখনও আসেনি। শশাঙ্ক মোহনের মতো আমিও সে সব মহাকালের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আছি। বরং আপনি এত বছর ধরে যা নিয়ে মেতে আছেন, যা আমার কাছে একান্ত অজ্ঞাত, সেই সব কথা শোনান।’ এই পত্রব্যবহারের ভাষায়ও বাংলা গদ্য প্রকরণের সমস্যা প্রকট। পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিকতা তো আছেই—‘দুএকবার’ প্রভৃতি বানান সেই আবহের অধিক দুঃসংবাদ বহন করে।
অবৈষ্ণব বিনয়ের আরেক সহৃদয় উদাহরণ সাইয়িদ আতীকুল্লাহ। ১৯৮০ সালের ৩ জুলাই তারিখে লিখিত পত্রে তিনি লিখিয়াছিলেন: ‘আপনাদের পত্রিকা মূল্যায়নের “শারদীয়-ঈদ” সংখ্যার তোড়জোড় চলছে বোঝা গেল। আমাকেও লিখতে বলেছেন। এ হুকুম তামিল করার সামর্থ্য আমার আছে কিনা সে সম্পর্কে এ মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়। আমি তেমন লেখকও নই। তবে চেষ্টা করব। যদি লেখা হয় পেয়ে যাবেন। এর চেয়ে বেশী আমি কাউকে কিছু কোনদিন বলিনি। নিজের সীমাবদ্ধতার কথা জানি বলেই এ ব্যাপারে আমি সতর্ক। লেখার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।’
বাংলাদেশের ধুরন্ধর সমাজে অবৈষ্ণব বিনয় নিয়ম না নিয়মের অতিক্রম তাহা বলা এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ব্যতিক্রমের একটি উদাহরণ পাওয়া গেল মাহমুদ শাহ কোরেশীর পত্রে। ১২ জুন ১৯৯৫ তারিখে মাহমুদ শাহ কোরেশী যাহা লিখিয়াছিলেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধার করা যাইতে পারে: ‘ওহীদুল আলম সাহেব হয়তো বার্ধক্যজনিত কারণে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। এমনিতেও তাঁর মূল্যায়নের ব্যাপারে কিছু সমস্যা ছিলো। আপনি শুনে অবাক হয়ে যাবেন, তাঁর বড় ভাই মাহবুব-উল-আলমের জীবনী লিখতে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটা খাতা পেয়েছিলাম বটে কিন্তু পুরো পরিবারের কাছ থেকে খুব একটা সাহায্য পাইনি। যদিও পরিবারটি সব সময় Clanish (ক্ল্যানিশ অর্থাৎ কুলকেন্দ্রিক) মনোভাবাপন্ন, কিন্তু (তাদের) নিজেদের বৈশিষ্ট্য (এই যে) আনলে ধরে খেতে তারা পারেন। মাহবুব উল আলম একজন অসাধারণ কথাশিল্পী। ওটা ওঁরা এবং আমাদের সাহিত্যের অধ্যাপক, ইতিহাসকার অনেকেই জানেন না। আমার জীবনীটির জন্য এখন অবশ্য তাঁরা গর্বিতবোধ করেন (বাংলা একাডেমী প্রকাশনা-১৯৮৬)।’
কোরেশী সাহেবের এই স্বীকারোক্তির উপলক্ষ অবশ্য দেখা যাইতেছে সপ্তাহখানেক আগে লেখা অমিত চৌধুরীর—৮ জুন ১৯৯৫ তারিখের—পত্র। ঐ পত্রযোগে চৌধুরী অভিযোগ করিয়াছিলেন: ‘কিন্তু একটা কথা থেকে যায় ওহীদুল আলম সম্পর্কে, তাঁকে গবেষক চৌধুরীর (আবদুল হক চৌধুরীর) উপর লিখতে বললে তিনি আমাকে জানান—“উনার ছেলেরাই যদ্দূর নয় গবেষক চৌধুরীকে নিয়ে তদ্দুর করছেন। এমন করে উনাকে নিয়ে লেখার কী আছে?” আমাকে বিস্মিত করেছে ৮৫ বছরোর্ধ্ব ব্যক্তির কথায়।’ এইখানেও বাক্য গঠনের—অন্বয়ের—সমস্যা দৃশ্যমান।
ওহীদুল আলমের অভিমত যদি বাংলাদেশের নিয়ম বলিয়া ধরা হয়, তো সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের বিনয় কি পশ্চিমবঙ্গের অতিক্রম? সৈয়দ মহাশয় লিখিয়াছেন, ‘চাচাজী (অর্থাৎ আবদুল হক চৌধুরী) একবার আমার বাসায় এসেছিলেন। অসাধারণ হৃদয়ের এবং সজ্জন মানুষ। সেই মানুষের স্মৃতি মনে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতির যুক্তিনিষ্ঠ ও সতথ্য বিশ্লেষণ প্রকৃতপক্ষে অ্যাকাডেমিক ছকের বাইরে থেকেই যে সম্ভব, এবং সেই সঙ্গে সিদ্ধান্তের নিরপেক্ষতাও সাব্যস্ত হয়, চাচাজী তাঁর গবেষণায় এসবের প্রমাণ দিয়ে গেছেন। বিশ্বাস করুন, তাঁর তুল্য অসাম্প্রদায়িক, নিষ্ঠাবান ও জ্ঞানবতী মানুষ আমি এ পর্যন্ত আর দেখিনি। তাঁর বইগুলি আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি এবং প্রয়োজনে কাজে লাগাই।’ এই চিঠির তারিখ দেওয়া আছে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫। বলা বাহুল্য নয়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ততদিনে আনন্দবাজার পত্রিকা হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন।
একটুখানি ভাবিয়া পড়িলে চোখে না পড়িয়া যাইবে না যে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের বাক্যরচনাও খানিক অবসাদের শিকার হইয়া পড়িয়াছে। আমি দুই আনার ভাষা-ব্যবসায়ী। তাঁহার রচনায় প্রযুক্ত বিশেষণ ‘জ্ঞানবতী’ আমাকে খানিক মজা আর খানিক শিক্ষাও দিয়াছে। কিন্তু মানুষে যাহা বলে তাহাতে নয়, সে যাহা করে তাহাতেই প্রকৃত পরিচয়—এই আপ্তবাক্য সৈয়দ সাহেবের ক্ষেত্রেও ভালো ফসল ফলাইয়াছে। আবদুল হক চৌধুরীর বইগুলি তিনি যত্ন করিয়া রাখিয়া দিয়াছেন এবং প্রয়োজনে কাজেও লাগাইয়া থাকেন। এই এলানের প্রকৃত পরিচয় মিলিয়াছে কার্যক্ষেত্রে, একই চিঠির পরের অনুচ্ছেদে তাহার খবর জানাইতেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: ‘দুঃখের বিষয়, আমি চিঠিপত্রের বিষয়ে যেমন অগোছাল, তেমনই অলস। তাঁর মূল্যবান চিঠিগুলি খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো অভ্যাসবসে ফেলে দিয়েছি। আপনার চিঠি পাওয়ার পর এবং ‘চেতনা’ পত্রিকায় ছাপানো আমার একটি চিঠি দেখে নিজেরই অবাক লাগছে। কারণ জীবনে অমন একজন মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম, অথচ যেন নিজেরই উদাসীনতায় তাঁর স্মৃতিগুলি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু থেকে গেছে মুদ্রিত বর্ণমালায় তাঁর স্বরূপ। এটাই সান্ত্বনা।’
এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা—এখন আমার আর জানিয়া খারাপ বা ভালো কোনটাই লাগে না। এই নিয়মটাই এখন ব্যতিক্রমের প্রমাণ হইয়া উঠিয়াছে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে এই প্রশ্নে ছাড়াইয়া উঠিয়াছেন আরেক মনীষী। তাঁহার নাম আজহারউদ্দিন খান। বাড়ি মেদিনীপুর। ৫ অক্টোবর ১৯৯৫ তারিখে লেখা পত্রে আজহারউদ্দিন খান লিখিয়াছেন: ‘হক সাহেবের বহু চিঠি আমার কাছে আছে তবে কোথায় আছে সেটা সঠিকভাবে বলা কঠিন। পত্র-পত্রিকা গ্রন্থের স্তূপের মধ্যে কিছু রয়ে গেছে, কিছু বান্ডিলের মধ্যে রয়েছে। প্রথম থেকে আমি সচেতন হতে পারিনি বলে এই বিপত্তি (ঘটেছে)।’
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজচরিত বিচার করিয়া আজহারউদ্দিন খান যাহা বলিয়াছেন তাহা হয়ত খানিক তাঁহার আপন বৃত্তান্ত বা আত্মচরিত বিচারেও উপাদেয় হইবে। আমরা ৫ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে লেখা তদীয় পত্রের শেষাংশে পড়িতে পাইতেছি: ‘তোমার বইয়ের প্যাকেট সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে পাঠিয়ে দিয়েছি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। তাঁকে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিলাম তিনি যেন প্রাপ্তিসংবাদ তোামকে জানিয়ে দেন কিংবা আমাকে (জানান) জানালে তোমাকে জানিয়ে দেব। তিনি আমাকে কোন চিঠি দেননি—তোমাকে চিঠি দিয়ে প্রাপ্তিসংবাদ দিয়েছেন কিনা জানি না। আজকাল কেউ যদি বিখ্যাত হয়ে পড়েন তখন তাদের অহমিকা বা দম্ভ এমন আকাশস্পর্শী হয়ে পড়ে যেন অনতিখ্যাত ব্যক্তিদের তাচ্ছিল্য করা তাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়।’ আজহারউদ্দিন খানের বাক্যগঠনেও সেই একই শিথিলতা—যে শিথিলতার আভাস সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখায় সুলভে পাওয়া গিয়াছিল।
‘অমিত চৌধুরীকে লেখা পত্রাবলি’ গ্রন্থে মাহমুদা বেগম সাহানা হইতে দেবেন্দ্র মালাকার পর্যন্ত খ্যাতিমান, নাতিখ্যাতিমান ও খ্যাতিবঞ্চিত মিলাইয়া সর্বমোট চল্লিশ জন লেখকের পত্র ছাপা হইয়াছে। একথা আগেই বলিয়াছি। সর্বাধিক পত্রব্যবহার করিয়াছেন প্রতাপচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। অকপটচিত্তে স্বীকার করিয়া বলি, ইঁহার লেখার সহিত আমার বিশেষ পরিচয় ছিল না। তাই আমিও এই সংকলনের দেনাদার হইলাম। আরও জানিতে পারিলাম, প্রতাপ মুখোপাধ্যায় ২০০১ সালে পরলোকগমন করিয়াছেন। জানিয়া আরো বাধিত হইলাম তিনি—অন্যান্যের মধ্যে—‘কলকাতার গুপ্ত সমিতি: উনিশ শতক’ বইয়ের লেখক।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পত্রব্যবহারকারীর নাম সুবোধ রঞ্জন রায়। ইনি ২০০৬ সালে ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘নবীনচন্দ্রের কবিকৃতি’ এবং ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন: স্মৃতিকথা’ (ইংরেজিতে)। ইঁহার লেখাও আমি আগে কোনদিন পড়ি নাই। আমার এই অজ্ঞানতা হয়ত সর্বজনীন নয়, তবুও বলিব এই সংকলনের পাঠকসমাজে অনেকেই আজ অমিত চৌধুরীর অধমর্ণ হইবেন।
তৃতীয় সর্বোচ্চ পত্রকার দুইজন—যথাক্রমে হেমেন্দু বিকাশ চৌধুরী এবং আজহারউদ্দিন খান। হেমেন্দু বিকাশ চৌধুরী এবং আজহারউদ্দিন খান—দুইজনেই ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। শুমার করিয়া দেখিতেছি তাহা করিয়াছেন ২০২১ সালে। চৌধুরী মহোদয় বৌদ্ধ দর্শন ও সাহিত্যের উপর তিরিশের বেশি বহি হয় লিখিয়াছেন নয় সম্পাদনা করিয়াছেন। আজহারউদ্দিন খান ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ ছাড়াও আরও অনেক বই লিখিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স দাঁড়াইয়াছিল নব্বই বছর।
চতুর্থ সর্বোচ্চ পত্র ব্যবহার করিয়াছেন মনিরুজ্জামান এবং রুহুল কাদের বাবুল। তাঁহারা দুইজনেই দুইটি করিয়া পত্র লিখিয়াছেন। মনিরুজ্জামান সাহেবের জন্ম ১৯৪০ সালে আর রুহুল কাদের বাবুল সাহেবের জন্মকাল ১৯৫৬।
উপরের ছয় মনীষীর প্রত্যেকেই একাধিক চিঠি রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের লেখা পত্রের সংখ্যা গণিয়া দেখিলাম মোট সাতাশটি। বাকি তেত্রিশ জন লেখকের প্রত্যেকেই একটি করিয়া পত্র পাঠাইয়া পত্রসংখ্যা মোট ষাটে উন্নীত করিয়াছেন। উপরে মাহমুদা বেগম সাহানা, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মাহমুদ শাহ কোরেশী, আহমদ শরীফ, শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মনিরুজ্জামান, বদিউল আলম, শফিউল আলম খান, রুহুল কাদের বাবুল এবং কালাম আজাদ প্রমুখের চিঠি হইতে অংশবিশেষ উদ্ধার করা হইয়াছে।
অন্যান্য যে সকল মহাজন তাঁহাদের কাছে লেখা পত্রাদি ছাপাইবার সুযোগ দিয়া আমাদের নতুন নতুন জ্ঞান ও আনন্দ দান করিয়াছেন সেই দানেশমন্দ মহলে আছেন: জাফর আলম, মাহমুদ উল আলম, বরুণ বসু, বিশ্বজিত চক্রবর্ত্তী, উত্থানপদ বিজলী, শ্যামলকান্তি দাশ, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, মো. আবুল কাশেম, প্রীতি মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ, শান্তনু কায়সার, মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন, অনুপম ঘোষ, হাসানআল আব্দুল্লাহ, গীতা রায়, মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন, পরেশ কান্তি দে, অভিজিৎ রায়, জাকের হোসাইন, নিতাই সেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, তাপস রায়, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল কান্তি দত্ত এবং দেবেন্দ্র মালাকার।
আগেই বলিয়াছি মাহমুদা বেগম সাহানার পত্রটাই এই সংকলনের নামপত্র। কেহ আমাকে এই বিচারকার্যে নিয়োগ দেন নাই তবু মাহমুদা বেগম সাহানার চিঠিটাকেই আমি বলিব এই সংকলনের শ্রেষ্ঠ পত্র। আমি এই সংকলনের বহুল বিতরণ প্রার্থনা করি। অমিত চৌধুরী শুদ্ধমাত্র কবি নহেন, রাজনীতিতেও তিনি চিরকাল আগ্রহী। রাজনীতিতে আমি কখনো তাঁহার অনুসারী ছিলাম না কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্য-সাধক বলিয়া তাঁহাকে দূর হইতে ভক্তি নিবেদন করিয়াছি। আজও তাহাই করিলাম। প্রার্থনা করি তিনি শতায়ু হউন। আমাদের নিত্যনতুন আরো জ্ঞান, আরো আনন্দ দান করুন। আমিন।
১৮ জানুয়ারি ২০২৩