“এই সময়ে মোস্তানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।...কী করে পরিচয় হলো, উপলক্ষটার কথা বলি। পাকিস্তানি পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বের ওপর একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতা শোনার ভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে আমার মনে হলো, প্রফেসর সালামের তত্ত্বটি বুঝতে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। এটা তো বড়ই আশ্চর্যের কথা। এমন সাংবাদিক আমাদের দেশে আছেন, সালাম সাহেবের দুরূহ তত্ত্বকে অ-তে অজগর এ রকম সহজ করে বোঝাতে পারেন। ঠিক করলাম সেদিনই সন্ধ্যে বেলায় ইত্তেফাক অফিসে যেয়ে খোঁজ করব। এ রকম একজন কামেল মানুষ আমাদের দেশে আছেন। সশরীর গিয়ে যদি সালাম না করি নিজেকেই অসম্মান করব। গেলাম ইত্তেফাকে।...টেবিলে ঝুঁকে পড়ে রিপোর্ট লিখছেন। শুধু মাথাটাই দেখা যাচ্ছে। এই একটুখানি মানুষ!”
ছফা লিখেছিলেন নাজিমুদ্দিন মোস্তানকে নিয়ে। ছফা কে তো আর পাবো না, তার বন্ধুদেরও পাওয়া সম্ভব না, কারণ নাজিমুদ্দিন মোস্তানের মতো সাংবাদিকেরা আর এই শহরে আর কাজ করে না।
কিন্তু তখনো নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সঙ্গে আহমদ ছফার সুগভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়নি। বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হয় একটা বই পড়ার সূত্র ধরে। ১৯৮২ সালের দিকে লেখক আনতান মাকারেঙ্কোর বই ‘রোড টু লাইফ’ পড়েন আহমদ ছফা। সেটি তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের তখনকার সিনিয়র রিপোর্টার নাজিমুদ্দিন মাস্তানকেও পড়তে দেন। এ বই পড়ার পর তারা ছিন্নমূল শিশুদের পড়াশোনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যেখানে বঙ্গবন্ধু, জিয়া এবং বিজয় একাত্তর হল সেখানে একসময় বস্তি ছিল। এই বস্তির একটি অংশে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। অদ্ভুত তাদের খেয়াল ছিল স্কুল চালানোর ব্যাপারে। বড়লোকদের টাকা নিতে চাইতেন না। চাইতেন মধ্যবিত্তের শ্রমে ঘামে তৈরি হোক স্কুলটা। যারা টাকা দেবেন তারা যেন সময়ও দেন স্কুলটার পেছনে। নাজিমুদ্দিন মোস্তান তার ছেলেকেও সেই স্কুলে ভর্তি করান। আপনি যদি আহমদ ছফার `পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ` পড়ে থাকেন তাহলে এ স্কুল নিয়ে অনেক গল্প পেয়ে যাবেন।
ফিরি নাজিমুদ্দিন মোস্তানের গল্পে। ধরেন চাইলেই আমরা নেটে সার্চ করে কোন বিষয় নিয়ে জানতে পারি এমনকি চ্যাটজিপিটি দিয়ে আস্ত একটা লেখা লিখিয়ে নিতে পারি। নাজিমুদ্দিনরা সেই যুগে এসব করতেন বিচিত্র সব বই ও বাইরের ম্যাগাজিন পড়ে পড়ে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকতার যদি কোনো গুরু থাকে তবে সেটা নাজিমুদ্দিন মোস্তান। তিনি পত্রিকায় ফিচার লিখে লিখে কম্পিউটার বাংলাদেশে জনপ্রিয় করেন। এর স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছিলেন ২০০৩ সালে একুশে পদক পেয়ে। কম্পিউটার মেলা, কম্পিউটারের সেই যুগে বাংলা লেখনী কিংবা কখনো কম্পিউটারের শুল্ক প্রত্যাহার আন্দোলনেও ছিল তার অগ্রণী ভূমিকা। তার রিপোর্ট ও ফিচার লেখার বৈশিষ্ট্য ছিল, দীর্ঘ বাক্য লিখতেন, তবে তা সহজ ও ঝরঝরে।
সাংবাদিকতা তার পেশা হলেও তার লেখায় একধরনের সাহিত্যের মিষ্টতা ছিল। দীর্ঘদিন তিনি ইত্তেফাকে কাজ করেছেন। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন। কাজ করতে করতেই তিনি স্ট্রোক করেন, দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে প্যারালাইজড হন। তার ছুটি শেষ কিন্তু বেতনের জন্য অফিসে আসতে হয়। ইত্তেফাকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে খুব পছন্দ করত, তাকে প্রতি মাসে অফিসে না এলেও বেতন দিয়ে দিত। কিন্তু বসে বসে বেতন নেবেন, এ জন্য তিনি অসুস্থ হয়েও অফিসে আসতেন, এক সহকারী তাকে সাহায্য করত কাজে। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তার এই চাকরি ও বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। খুবই সাদামাটা এক জীবন নিয়ে বেঁচেবর্তে ছিলেন। তার যে ক্ষমতা ও চেনাজানা ছিল চাইলে তিনি লাখ লাখ টাকা আয় করতে পারতেন খুব সহজে। কিন্তু তিনি দেশপ্রেমিক এক মানবতাবাদী মানুষ। তরুণদের জন্য কাজ করতে চাইতেন আর প্রচুর পড়তেন। বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে সংগ্রহ করা ব্রশিওর পর্যন্ত তার দৃষ্টি এড়াত না। এই মানুষটা নেই এগারো বছর হয়ে গেল।