• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কবীর সুমনকে নিয়ে কয়েক প্রস্থ


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৩, ০১:১১ পিএম
কবীর সুমনকে নিয়ে কয়েক প্রস্থ

আজ কবীর সুমনের জন্মদিন। নিজের লেখা আছে সুমনকে নিয়ে। টুকরো লেখাও আছে হাফ ডজন। সেসব আজ থাকলো না হয়। আসলে মন মানসিকতা মেজাজ ঠিক করে দেয় লেখা। অনেক সময় লেখার অবসর থাকলেও, লেখা হয় না। পড়তে আমার ভালোই লাগে। যেমন পড়ছিলাম পিডিএফ, স্মরণজিত চক্রবর্তীর, কম্পাস। কিন্তু লিখতে সবসময় মন চায় না। সার্বক্ষণিক মোবাইলে এত বেশী মনোযোগ হারাই, আর এত অপশন, লেখাও এখন ক্লান্তির। তবুও কবীর সুমন বলে কথা। কিছু না কিছু লেখা দরকার। এই যে তাড়নাটা এটা কবীর সুমনের মত মানুষদের জন্যই। যদিও পশ্চিমবাংলার তারকা ফেসবুকারদের দেখলে মনে হয় তারা সব মুনি ঋষি। তারা এসেছে আসমান থেকে। একমাত্র কবীর সুমনই তাদের ধুলোয় নামালো।

আমার স্বীকার করতে মোটেও সমস্যা নাই কবীর সুমন খুব সঠিক ব্যক্তিত্ব নন। তার হাজারটা সমস্যা ও হিপোক্রেসি। কবীর সুমনের সীমাবদ্ধতা বিপুল। কবীর সুমনের পক্ষে আজকাল কবীর সুমনই থাকেন না। আমরা থাকবো কী করে। কবীর সুমনের পক্ষে কথা বলার লোকও আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। আর নিত্য নতুন সব কার্যকলাপে আরও সমালোচিত। ওনার অবস্থা এখন আগে ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট সরকারের মতো, সবারই আছে গঠনমূলক সমালোচনা। আমি কবীর সুমনকে সমালোচনা করতে চাই না, পারবো না। এটা আমার সীমাবদ্ধতা।

কবীর সুমনকে আমি দেখি একজন অসাধারণ গায়ক ও গীতিকবি হিসাবেই। আজ থেকে ১০ বছর পর সুমন সে অবস্থানেই থাকবেন। আজকালকার ইস্যু তখন কেউ মনে রাখবে না। এটাই ভরসা ও ভুলে যাওয়ার সুবিধা। কবীর সুমনকে নিয়ে যে কথাটা বলা ভালো, সেটা হলো ওনার লেখা ও পড়াশোনা। এত সুন্দর বাংলা গান গত পঞ্চাশ বছরে কেউ লিখতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। ওনার পড়াশোনা কত গভীর, তা আমরা মধ্য-মেধার বাঙালি কল্পনাও করতে পারবো না। মীজানুর রহমান থেকে সুবিমল মিশ্র, আবুল হাসান থেকে ফাল্গুনী রায়, ডিকেন্স থেকে গ্যোটে। সব তাঁর পড়ে ভাজাভাজা। এত বিপুল পড়াশোনা আপনি সেলিব্রেটেড মানুষদের ভেতর পাবেন না। আর বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনাতেও উনি চ্যাম্পিয়ন। ধরেন আপনি স্থাপত্য নিয়ে আলাপ করতে চান, সুমন যা বলবেন বাংলার বেশীরভাগ পন্ডিত লোকজনই তা বলতে পারবে না।

এবার আসি তাঁর গান শোনাশুনিতে। নিজেকে তিনি দাবি করেন, ব্লোটিং পেপার। বাংলা গান নিয়ে তার চাইতে বেশী বিজ্ঞ লোক এই ধরাধামে এখন আর কেউ আছে বলে আমার জানা নাই। তিনি যেমন আলাউদ্দিন আলীর সুর নিয়ে জানেন, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁকে  গভীরভাবে চিনেন। ফিডব্যাকের গান থেকে শিলাজিত ওনার শোনা হয় নাই এমন গান নেই। বাংলাদেশের গানকে তিনি চেনেন হাতের আঙুলের মত। আমি কবিতা গদ্যের তুলনায় কম পড়েছি। বড় পাঠকদের মত কবিতা পড়লে হয়তো বুঝতে পারতাম সুমনের কবিতার খামতি। আমি কিছু নান্দনিক ভাবনার প্রকাশে, সুমনের বাইরে কিছু মাথাতেই আসে না। আমাদের এইসব গ্লানি সুমনে ‘সুগার কোটিং’ হয়। এই লেখাটা লিখতে লিখতে যেমন ভাবছি, ‘পাড়ার ছোট পার্ক/ঘাস নেই তবু ধুলো/ ঘাসের অভাব পরোয়া করে না সবুজ বাচ্চাগুলো/ বেঞ্চিগুলোর কাঠ রোদে পুড়ে জলে ভেজে/সমকাল এসে বসেছে সেখানে আহত প্রেমিক সেজে।’ এরকম লাইন দুচারটা লিখতে পারলেই আমি নিজেকে কাব্য প্রতিভার ঈশ্বর ভাবতাম। কবীর সুমন এই গানটাও শেষ করেছে কি নিপুণ ভাবে, ‘বাস্তুহারার খুকি মেটায় খেলার সাধ/ ঘাস উঠে যাওয়া ধুসর পার্কে শিশুর সাম্যবাদ।’ একদম আচমকাই আমার মনে পড়ে আমার শৈশব, খুলনায় কলোনির এক চিলতে শিশুপার্ক। তখন বিটিভির এক বিজ্ঞাপন দেখাতো, কাজের মেয়ের হাতে থাকে বাচ্চা, চারিদিকে বাচ্চারা খেলছে, তখন ভদ্রলোক বাচ্চার বাবা কাজের মেয়েটাকে খেলতে পাঠায়। মেয়েটা কি ভীষণ খুশী হয়।

কবীর সুমন আরও একটা গানের কথা বলি। প্রবাসী বাঙালির গান। এর প্রেক্ষাপট জেনে আপনি যখন গানটা শুনবেন মনে হবে দুই বাংলাকে চেনে গভীরভাবে, শুধু সুমনই। আবার না চিনেও তিনি অনেক চেনেন। পেটকাটি চাঁদিয়ালের গল্প যেমন বন্ধুর মুখে শুনে লিখেছেন। ‘বাশুরিয়া’ লিখেছেন একজনকে বাঁশি বাজাতে দেখে পথের ধারে। কানোরিয়া জুট মিল বন্ধ নিয়েও তার গান আছে, সঙ্গে আছে সে সময়ের একটিভিজমও। আবার ‘কাঙ্গালপনা’ গানটার যে হাহাকার তা কোথাও গিয়ে, জানান দিচ্ছে নন্দীগ্রাম হয়ে বাজে। অনেক আছেন, আমার পুরোনো বন্ধু যেমন, সুমনের সব গান মুখস্থ।

সুমন আমাদের জীবনে আছে নানান ঢংয়ে। আমাদের জন্য, গানটা নিয়মিত শুনলে কলকাতা ভ্রমণ ভাগ্য হলো না বলে আফসোস, ঢাকাতেও রিলেট করতে পারবেন তা। হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে তিনি গাইয়েছেন, ‘মনে করে নাও এটাই আমার কাজ।’ সেখানে কি লাইন, ‘মনে করে নাও এরই নাম জীবন/ পাবে না জেনেও বেঁচে থাকা প্রাণপণ।’ তাঁর সব থেকে জনপ্রিয় গান তোমাকে চাই। ছিপছিপে কবিতার ছন্দে ভাষায় কিংবা ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তের সুরে। হিমাংশু দত্ত কিন্তু খুব যে ভুলে যাওয়া সেটা মনে করার কারণ নাই। তবে অবচেতনে মনে হবে সলীল হিমাংশু দত্তের গান আপনার শোনা উচিত। সুমন রেডিওর অডিশনে গেয়েছিলেন অখিলবন্ধুর গান। খুব একটা ভালো বলে নাই কেউ। সুমন বাঙালির হিপোক্রেসি জানতেন। তবে নব্বই দশক নিয়ে যদি গর্ব করার কিছু থাকে সেটা সুমন, অঞ্জন দত্ত, ফিডব্যাক, জেমস, এলআরবি নিয়েই গর্ব। এই বাংলা থেকে জন্মদিনে সুমনকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

Link copied!