পৃথিবীতে স্থান আছে এক ত্রিপুরা নাম্নী। সেখানে আমার বাস। আমার নাম অশোক যদিও, লোকে নানা নামে ডাকিয়া থাকে। পৃথিবীতে লোকের সঙ্গে মিশে অনেক কবিও থাকে। বিনয় মজুমদার নামক কবি ত্রিপুরাতে এসেছিলেন তো। তখন আমার বয়স কম বলে তাঁকে দেখি নাই, হায়। শুনেছি তেমন পরিচয় হয় নাই অত্রের কবিদের সঙ্গে তাঁর। যদিও তখন জীবনে তাঁর যুক্ত হয় নাই তেমন মিথ। মিথ বলতে উচ্চ কবিদের জীবনের আঁশ। কিছু তাঁরা লইয়া জন্মান, কিছু নিজেরা সংযোগ করেন, কিছু মূর্খ বাঙালি করে থাকে নির্বিচারে। বিনয়ের এইসব আঁশ স্পষ্ট হলে পরে আবিষ্কার হলো, ত্রিপুরাতে তিনি এসেছিলেন, অধ্যাপনার কাজ করতে একদা। সে কাজে থাকেননি এখানে, থাকলে তাহার মৃত্যু হতো অনেক পূর্বে। এখানে প্রকৃত কবিদের জন্য এক হাঁড়িকাঠ নির্মাণ করেছিল তারা। তাহার আসল নাম রাজনীতি জানিবেন। বিনয় থাকলে সেটায় শুইয়ে তাঁকে বলি দিয়ে কবেই উল্লাস সমাপ্ত করত এখানকার দলরক্তিম লোকেরা। ভাগ্য তাহারও ভালো, বঙ্গভাষারও।
মানুষের মাঝে কতক মানুষ থাকেন, পশ্চিমের দিকে মুখ করে তাদের জন্ম হয়। রবির উপসংহার রচনা করে জীবন লইয়া আনন্দ হেতু তাঁরা আসেন কদাচিৎ। তেমনি এসেছিলেন বিনয় মজুমদার নামে এক লোককবি। লোক শব্দটি মাঝে মাঝে folk-এর বাংলা হিসাবে ব্যবহার করেন পণ্ডিতগণ। পণ্ডিতেরা ভাষা ও সমাজের যত মন্দ করতে পেরেছেন, তাহার বেশি আর কেউ তো করতে পারেনি, সত্য। যারা সমাজে এলিট হয়েছেন, তাদের কাছে মহাত্মা লালনও লোককবি। অথচ বাংলায় এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তেমন লোককবি জন্মাল না কভু। তিনি এক নারীর কথা বলেছিলেন একদা। মাধুরী নাম্নী সেই নারীটির বাস মানুষের মনে। মনের মাধুরী বলেছেন তাকে। হিসাব করে আমরা দেখেছি, তিনি, সেই নারী, মনেরও অন্তর্গত কোনো স্থানে বাস করেন। বিনয়বাবুকে সেই গভীর নারীর কাছে নিল না বাঙালি। ওপরের মাধুরীর ছলনার কাছে ফেলে বিচার করে দেখল। ছলনা অভিধামুখর। তাই বিনয়ের সঙ্গে জুড়ে গেল কত না অভিধা, তার মধ্যে অন্যতম এক ‘জীবনানন্দ পরবর্তী’। আহারে পূর্ব, আহারে পর। ঠিক যে, জীবনানন্দকে লোকে দিনে ছয় এবং রাতে নয় বার করে মোট 69 বার ধর্ষণ করছে আজকাল। সেরকম ধর্ষণের শিকার তার ‘পরবর্তী’ বিনয়বাবুও। অথচ তাঁর কাছে আছে এক নিভৃত বাবুই।
আজিকে বিনয় মজুমদারের জন্মদিন জানিয়াছি। উদযাপনের আলোকে মনের সেই ওপর মাধুরী দিয়ে কত না আলাপ হবে আজ। সারা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের কবি, চিন্তক, ছদ্মচিন্তক, ভাবুক, ছদ্মভাবুক এবং মনগড়া আলাপ উদ্ধৃত করে করে জন্মদিনে বিনয়বাবুর যারপরনাই 69 হবে। তাহাতে আমার বিনত চোষণ আপনি গ্রহণ করুন হে, ব্যর্থ গণিতজ্ঞ। লোক শব্দটিতে কি ফিরব একটু? লোক কিন্তু ইংরেজিতে space-ও বোঝায়। ভূলোক, দ্যুলোক। তেমনি এক লোক আছে অন্তরে বিস্তারি। সেখানে অভিজ্ঞতা সিন্ডিকেট চালায়। তাকে কলার ধরে পাড়াছাড়া করতে পারেন কোনো কোনো কবি। সকলে নয়, কেউ কেউ। সেটি করে দিতে পারলে এক লোকের অধিপতি হওয়া যায়। ভাবলোক। আজ এমন এক আধুনিক অধিপতির জন্মদিন। তাঁকে আলিঙ্গন করি।
মিথ হবে মিথ্যা হবে, চোষণ হবে চাকা হবে, গান্ডুদের সমবেত গায়ত্রী হবে, দেশ হবে বিদেশ হবে, ফরাসি ও ফাংকি হবে, বিনয় ও ভুট্টা হবে, হাসপাতাল ও হাসাহাসি হবে… ছন্দ ও ছ্যাবলামো হবে… আজিকে জন্মদিনে। এসবের বাইরে একা পড়ে থাকবেন এক কবি। কে আর পড়ছে তাকে, মৃত্যু হতে কয়েকবর্ষ পরে? শিক্ষিত কোনো বাংলার টিচারকে গিয়ে তারপর জিগ্যেস করুন, বিনয় মজুমদার চেনেন? উত্তর নয়, প্রশ্ন আসবে ফিরে : অমুক পার্টি করে যে, সে বিনয়ের কথা বলছেন?
সুতরাং বিনয়ের কবিতা এক পড়তে চাইছি আমি। সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডটি লতপতে কভার নিয়ে কোথায় শুয়েছে? সেখান থেকে পড়তে গিয়ে মনে হল, অন্ধকারে পৃষ্ঠা উলটে দেখা যাক কী আছে রচিত। পেলাম। সেই কবিতাটি থাকল এখানে :
বর্তমানে চৈত্র মাস
বর্তমানে চৈত্র মাস অত্যন্ত গরম আবহাওয়া,
যদিও বসন্তকাল বর্তমানে তা সত্ত্বেও এরূপ গরম।
পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ বসন্তকাল অনেক এসেছে
যখন উত্তাপ হেতু দেহে ঘাম বের হয় আমার, সবার।
পৃথিবীর ইতিহাসে আবহাওয়া এ প্রকার ঘন ঘন হয়।
অবশ্য এ চৈত্র মাসে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হয়––
রসাত্মক মেঘ থেকে শব্দ ক’রে জল ঝ’রে পড়ে,
এসব শব্দের ছন্দ আমার মধুর লাগে খুব।
বৃষ্টির পরেই কিন্তু আবহাওয়া মনোরম হয় ইতিহাসে।
বৃষ্টির পরেই স্পষ্ট বোঝা যায় বসন্ত এখন।
কী মুশকিল, অন্ধ লোকের মত পৃষ্ঠা উলটে দেখি পৃষ্ঠার নম্বর 95। একটু গণিত : 95+1 = 96 হয়। যদি আমরা 96 সংখ্যাটিকে উলটে দিই, অর্থাৎ পার্শ্বীয় পরিবর্তন করি যদি, সেটি হয় 69।