• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর ৫২তম বার্ষিকী আজ


হাসান শাওন
প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৩, ১১:৩৫ এএম
‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর ৫২তম বার্ষিকী আজ
ছবি : সংগৃহীত

১৯৭১ সাল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে কোটি কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছেন। উদ্বাস্তু হওয়া এই মানুষদের সাহায্যের জন্য আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ছিল সংগীত ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এই কনসার্টে প্রায় ৪০ হাজার দর্শক-শ্রোতা অংশ নেন। এর একটি ভিডিও সংস্করণও পরে প্রকাশিত হয়। আয়োজন থেকে সংগৃহীত অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যে ব্যয় হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন। কিন্তু মার্কিন জনগণেরই বড় একটা অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেন। ইতিহাসের অংশে পরিণত হওয়া ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনটি পরিণত হয়েছিল রক্তাক্ত একটি জনপদের প্রতি বিশ্বের সব সংবেদনশীল মানুষের সংহতির বহিঃপ্রকাশ।

মূলত পণ্ডিত রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসন ছিলেন এ আয়োজনের উদ্যোক্তা। এতে অংশ নিয়েছিলেন বিশ্ব সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে ছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লারাখা খান, বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন, এরিক ক্ল্যাপটন প্রমুখ।

পৃথিবীজুড়ে তখন স্নায়ুদ্ধের তীব্রতম পর্যায়। উপনিবেশবিরোধী মুক্তির সংগ্রাম চলছিল আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার অনেকগুলো দেশে। তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু আমাদের বিষয় ছিল না। বরং পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম একটি বৈশ্বিক মাত্রা পায়। মার্কিন-ব্রিটিশ ও ফরাসি সরকার অধিকাংশ জায়গাতেই চেষ্টা করছিল নিজেদের দখলদারত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু এ দেশগুলোর জনমানসের ভেতরে একটা বড় ধরনের বদল ঘটে গিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জুড়েই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশের দিকে। একটি দিনও বাদ যায়নি, যেদিন যুদ্ধের কথা সংবাদ শিরোনাম হয়নি। গণমাধ্যমের এমন ভূমিকা গোটা পৃথিবীর মানুষকে প্রভাবিত করে। দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থনের জোয়ার তৈরি হয়। জনসমর্থনের অনেক বড় নজির ছিল যুক্তরাষ্ট্রেই।   

ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন তরুণরাই তখন প্রতিদিন রাস্তায় মিছিল করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তখন বর্ণবাদ বিরোধী নাগরিক অধিকারের সংগ্রামেও জোয়ার এসেছে। সমান অধিকার ও বৈষম্যহীনতার দাবিতে প্রবল সংগ্রামে জেগে উঠেছেন দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’কে বুঝতে হলে তাই তখনকার বিশ্বরাজনীতি ও পশ্চিমা তারুণ্যকেও বুঝতে হবে। বৈশ্বিক আগ্রাসন, যুদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কবিরা লিখছেন, গায়করা গাইছেন, চিত্রকররা আঁকছেন। বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা লিখেছেন সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কবি অ্যালান গিনসবার্গ।

সংগীতের ইতিহাসেও এটি ছিল অবিস্মরণীয় ঘটনা। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে এ কনসার্টে মেলবন্ধন ঘটে পশ্চিমা রকের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বসংগীত মহারথীদের সংহতির নজির এই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।  

শুধু গানের আয়োজন করেই এ কনসার্ট শেষ হয়নি। পরে এই কনসার্টের একটি ভিডিও ভার্সন প্রকাশ করা হয় এলপি ডিস্কে। এটিও বিপুল সমাদৃত হয়।

কোনো একটি দেশের মুক্তির সংগ্রাম যে পৃথিবীর সকল মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তার অনন্য উদাহরণ। প্রায় একই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষায় জহির রায়হান নির্মাণ করছিলেন তার বিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। সেখানেও দেখা যায়, সব দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে একাকার করা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে। এই সংহতির বোধই ছিল ৭০ দশকের আন্তর্জাতিক তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য। ফলে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ বিপুল জনসম্পৃক্ততা অর্জন করে।

এ কনসার্ট মুক্তির আকুতিকে দিয়েছে বিশ্বজনীন ভাষা। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তাই যেমন তার সাংগীতিক গুরুত্বের জন্য অনন্য, তেমনি তা আন্তর্জাতিক সংহতিরও মহান এক প্রতীক। 

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর উদ্যোক্তা ও শিল্পীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হয়নি। ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন এ কনসার্টের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই।  

২০০১ সালে প্রয়াত হন জর্জ হ্যারিসন। কিন্তু তিনি এবং ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর পরম্পরা এখনো অব্যহত আছে ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’ নামে শিশুদের মঙ্গলের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি তহবিলে। সেখানে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অ্যালবাম বিক্রির অর্থ জমা হয়, যা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিশুদের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়।

Link copied!