১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় ঘটনা বিশ্ববাসীকে স্তব্ধ করে দেয়। শিল্পী-সাহিত্যিকরা উদ্বেলিত ও স্তব্ধ হন ঘটনার আকস্মিকতায়। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র যে সাংস্কৃতিক চর্চার দ্রুত বিকাশ ঘটেছিল, তা থমকে দাঁড়ায় পঁচাত্তরের খুনিদের উল্লাসের নিচে। একাত্তরের ষড়যন্ত্রকারী পরাজিত শক্তির চক্রান্ত স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে নিয়ে যায় সন্ত্রাসের করতলে, স্বৈরশাসকের হাতের মুঠোর ভেতর। বন্ধ হয়ে যায় মুক্তিবুদ্ধির সব শিল্পচর্চা। এমনকি বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের পর ভীতসন্ত্রস্ত খুনিরা রাষ্ট্রপতির জনপ্রিয়তাকে মুছে ফেলার জন্য তড়িঘড়ি জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় কবরস্থ করে। ৩২ নম্বর থেকে জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় তাঁকে পাঠানো হলো ঠিকই, কিন্তু জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরও বেশি প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়ে উঠলেন। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসহ সব সুকৃতি। তবে ১৫ আগস্ট পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুই প্রকাশিত হয়েছেন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে, রেখা-ভাষা-ছন্দে-সুরে। উল্লেখ্য, কেবল বাংলা নয়, ইংরেজি, উর্দু, মণিপুরি, জার্মান ভাষায় মুজিববন্দনা রচিত হয়েছে। দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে মুজিবের আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত আছে তাঁকে কেন্দ্র করে অন্য ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের রচনায়।
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁকে কেন্দ্র করে গান লেখা হয়েছে, রাজনৈতিক পোস্টারে মুদ্রিত তাঁর প্রতিকৃতি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। একাত্তরে গণসংগীতের মূল স্তম্ভ ছিলেন তিনি। ১৫ আগস্টের পর চিত্রকলার অজ¯্র তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো আর মুখাবয়বের পেলবতা। ডাকটিকিট আর ম্যুরাল-ভাস্কর্যে তাঁর উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। ছোটগল্পের বিষয়বস্তুতে সচেতনভাবে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছে। শাহাদাতবরণের পর গল্পের উপাদান হিসেবে কেবল পটভ‚মি নয়; ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানবিকতার উন্মোচনে কল্পনার রঙে রাঙানো হয়েছে তাঁকে। অবশ্য চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনের দ্ব›দ্ব ও সমস্যা বড় হয়ে ওঠেনি অধিকাংশ গল্পের প্লটে। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে আশ্রয় করাতে অন্য চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনের সংকটগুলো ইতিহাসের অনুবর্তী। সাহসী মুজিবের ঐতিহাসিক কাহিনি গল্পের কল্পনায় মহিমান্বিত করেছেন লেখকরা। বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকে সাধারণ মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নিবিড় স্পর্শে স্পন্দিত করা হয়েছে। গল্পকাররা সর্বত্রই ইতিহাসের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকবেন, এমনটি আমরা কেউ আশা করি না তবে ইচ্ছেমতো অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কল্পনার আশ্রয় নিতে গিয়ে মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন, এটাই প্রত্যাশা।
‘আগস্টের একরাত’ উপন্যাসের রচয়িতা সেলিনা হোসেন একটি যুগের সমগ্র ইতিহাস পরিবেশন ও পর্যালোচনা করতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর শক্তিমান, তীক্ষèধী, ক‚টনৈতিক ও সাহসী ভ‚মিকা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও জাতির জীবনে মুক্তি-অন্বেষী মুজিবকে ঐতিহাসিক করে তুলেছেন তিনি। উপন্যাসের প্রধান ঘটনা ও তার পটভ‚মি ঐতিহাসিক। ‘আগস্ট আবছায়া’ উপন্যাসে কবি-অনুবাদক-ঔপন্যাসিক মাসরুর আরেফিন অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আনিসুল হকের মুখ্য চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। ঐতিহাসিক চরিত্র অনেক সময় ইতিহাসসম্মত আচরণ না-ও করতে পারে। কারণ, ঔপন্যাসিক গল্প লিখতে বসেছেন। উপন্যাসের সবই ঐতিহাসিক হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে সত্যকে জীবন্ত আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন কোনো কোনো লেখক। উপন্যাসে প্রধান ঐতিহাসিক চরিত্র বঙ্গবন্ধুর পাশে কিছু অপ্রধান চরিত্র এসেছে অনৈতিহাসিক। ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যাসত্য বিবেচনা না করে কল্পনার স্বাধীনতাকে শিল্পের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন ঔপন্যাসিক। ইতিহাসের তাগিদে যেন উপন্যাস তার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত না হয়। কোনো কোনো চরিত্র আধা ঐতিহাসিক, আধা কাল্পনিক হতে পারে। যেমন আনিসুল হকের উপন্যাসে ইতিহাসের ঘনঘটার পাশে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির কথোপকথন ব্যক্তিগত জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক বিষয়ের সঙ্গে কাল্পনিক প্রেমকাহিনি বুনে দিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘দুধের গেলাশে নীল মাছি’ উপন্যাসে। ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্তে ব্যক্তি মাহতাব অনন্য হয়ে উঠেছেন। ইতিহাসের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন। তাঁদের উপস্থাপনে ঐতিহাসিকতা বজায় রেখেছেন মোস্তফা কামাল, মহিবুল আলম, শামস সাইদ, সমীর আহমেদ, হুমায়ূন মালিক, আবদুল মান্নান সরকার, মাসরুর আরেফিন প্রমুখ। ১৫ আগস্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাহিনিতে বঙ্গবন্ধু কালের গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বকালের হয়ে উঠেছেন। নির্মাণকুশলতায় ঐতিহাসিক বিষয় ও চরিত্রসমূহের কাঠামোটিকে লেখকরা উপন্যাসের প্রাণস্পন্দনে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আত্মত্যাগকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেছেন কবিরা।
আসলে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দেশের মানুষের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধু বীর, শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহানায়ক, মহামানব। এই মহামানবকে বন্দনা করে কবিতা রচিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। মানব-মানবতা ও মুক্তির দিশারি বঙ্গবন্ধু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিককে উৎসাহী করেছেন স্বাভাবিকভাবে। কারণ মানবমুক্তির গান কবি-সাহিত্যিকদের প্রধান অবলম্বন। এ জন্য মহামানবের মাঝে প্রেরণা অন্বেষণ করে জাতি ও জনতাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে কবিতা ও ছড়ায় বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের মাধ্যমে। শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হওয়ার আগেই তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখা শুরু হয়। নির্মলেন্দু গুণ ও জসীমউদ্দীন ষাট-সত্তর দশকে তাঁকে কাব্যের ভেতর দিয়ে বাঙালির মুক্তির আকাক্সক্ষাকে পরিস্ফুট করেছেন। কবিদের কাছে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক হয়ে গিয়েছিল। ষাট ও সত্তর দশক ধরে বিশ্বব্যাপী মুক্তিপাগল মানুষের তেজোদীপ্ত প্রতীক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর দেশের বৈরী পরিবেশে কবিরা স্মরণ করেছেন তাঁকে। পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক পট পাল্টে গেলেও মুজিবের অনুপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মেনে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবিরা।
কবি বলেছেন-- ‘বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান’। আমাদের গৌরব ইতিহাস লুণ্ঠিত করার প্রতিবাদই উচ্চারিত হয়েছে তাঁকে নিয়ে রচিত কবিতায়। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের সমাজ-সংস্কৃতিতে স্বৈরশাসকের অনিবার্য প্রভাব থাকলেও প্রতিবাদী কবিতার ধারার শক্তিশালী বিকাশ বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই বিস্তৃত হয়েছে। কবিতা রচিত হয়েছে-- ৭ই মার্চের ভাষণকে নিয়ে, তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ড, তাঁর বাসগৃহ ৩২ নম্বর বাড়ি, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে একীভ‚ত করে। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যে সময়ে বঙ্গবন্ধু একটি নিষিদ্ধ নাম, বিশেষত সামরিক শাসকদের সময় যখন তাঁর নাম উচ্চারণই রাষ্ট্রদ্রোহিতা মনে করা হতো; সেই সময় রচিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা, ছড়া, গল্প, সংগীত, চিত্রকলা, উপন্যাস।
বস্তুত কেবল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নয়, জাতির পিতার দীর্ঘ সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে শিল্প-সাহিত্য পরিবেশিত ও রচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ছিল তর্কাতীত। ঐকান্তিকতায় পূর্ণ ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে শায়েস্তা করতে চেয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ তাঁকে জেল থেকে বের করে এনেছে। এমনকি ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। জয়ী আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্র করে সরাতে না পেরে সশস্ত্র বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বাঙালি আবার তাঁকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনে। তিনি ১৯৭২ থেকে দেশের উন্নয়নে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছেন। তাঁর শাসনকালে সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৭৫-এর দুঃসময় পরবর্তী তবু মানুষের ভালোবাসা প্রদর্শন থেমে থাকেনি। মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে তাঁর নামে। সেই পাশবিক নৃশংসতায় প্রাণপুরুষ চির আরাধ্য কর্ণধারকে হারিয়েছি আমরা। শোষিত জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে সেই জনতারই হয়েছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য এ দেশবাসীকে ঝঞ্ঝা-উত্তাল দিন পার করতে হয়েছে, যার কেন্দ্রে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা-আন্দোলন ছিল বাঙালির জাতিসত্তা উন্মেষের গৌরবময় মুহূর্ত। স্বাধীনতাসংগ্রাম সেই মুহূর্ত থেকে ক্রমান্বয়ে মহীরুহে পরিণত হয়। বাঙালিত্বের মূল শিকড় ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসে লুকিয়ে রয়েছে। আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই রক্তঝরা ইতিহাসের মুখ থুবড়ে পড়ার দিন। কিন্তু সেখান থেকে পুনরায় বাংলার মানুষ জেগেছে শিল্প-সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে।
লেখক : বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়