দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইড-উত্তর সমাজ হবে রংধনুর মতো। রংধনু শব্দটি প্রথম বহুজাতির রূপক আকারে এনেছিলেন আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু। তাঁর এই ধারণাকেই স্বপ্ন আকারে লালন করে সামনে এগোতে চেয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৯৪ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর এই আশার পালে হাওয়া লাগে। কিন্তু পালের বিভিন্ন জায়গায় ছিদ্র ধরা পড়ল ২০২২ সালে এসেও। তৃতীয় দিন আমি আর মনে যখন ডার্লিং স্ট্রিট দিয়ে কেপটাউনের প্রাসাদে ঢুকব, তার ঢিল ছোড়া দূরত্বেই দেখি বস্তি রাশি রাশি। দরিদ্র, ছিন্নমূল মানুষের বাস। প্রাসাদের সামনে বস্তি, কী বৈপরীত্য! যদিও প্রাসাদটি তৈরি হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। ক্যাসল অব গুড হোপ বা উত্তমাশা প্রাসাদের ভেতরে ঢোকার পথে কামান বসানো। যেন গরিব মানুষদের সম্ভাব্য বিপ্লবে ভীত হয়ে সশস্ত্র সজ্জা।
মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে হলুদ রঙের এই প্রাসাদ। ছবি: লেখক
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের ভেতরে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয়। প্রাসাদটি ১৬৬৬ সালের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা শুরু হয়, শেষ হয় ১৬৭৯ সালে। পঞ্চভুজাকৃতির প্রাসাদের প্রতিটি ভুজে একটি করে বুরুজ। প্রবেশদ্বারে বসানো ঘণ্টাটি বানানো হয়েছে হল্যান্ডে, বসানো হয় ১৬৯৭ সালে। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়বে মাঝে বিশাল সবুজ ঘাসে ঢাকা খোলা চত্বর। মাঠ পেরিয়ে দোতলা প্রাসাদে প্রবেশের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন ট্রাইবের রাজাদের ভাস্কর্য। ভেতরে বিভিন্ন কক্ষে সাজানো আছে সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আঁকা অন্তরীপ ও বন্দরের ছবি। মাঝামাঝি থাকা কক্ষে কাঠের মেঝের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনার চোখে পড়বে দাসদের গর্দানের শিকল। এখন আমরা যেভাবে কুকুরদের গলায় পরিয়ে রাখি। এর সামনে দাঁড়িয়ে অস্বস্তিবোধ হলো। মনে হলো শিকলের ভেতর এখনো বাঁধা পড়ে আছে কোনো অতৃপ্ত আত্মা। মুক্তি ঘটেনি তার। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না সেখানে। নীরব কক্ষে আমি আর মনে ছাড়া কেউ নেই। আমরা দুজনে মিলে ঘুরে ঘুরে পেইন্টিং আর যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র দেখে বেরিয়ে এলাম।
সপ্তদশ অথবা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্যবহৃত এই শিকল পরানো হতো ক্রীতদাসদের গলায়। ছবি: লেখক
মনে বলছিল, বাবা আজ তো রোদ উঠেছে, চলো টেবিল মাউন্টেনে যাই। গুগলে দেখলাম প্রাসাদ থেকে পর্বতের গোড়ায় পৌঁছাতে লাগবে আধ ঘণ্টা। বললাম, চলো তবে যাওয়া যাক। উবার নিলাম, ভাড়া আসবে ৮৪ র্যান্ড। আমরা মূল শহরের পথ ছেড়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ি পথে উঠে পড়লাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ওপরে উঠছি, একদিকে পাথুরে দেয়াল, অন্যদিকে খাদ, সুনীল সমুদ্রের জলরাশি। পথ চলাকে উপভোগ করতে করতে আমরা কেব্ল-কারে ওঠার জায়গায় এলাম। টিকিট কাটতে হলো বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে। তবে লাইনে দাঁড়ানো বৃথা যায়নি। আমরা যখন কেব্ল-কারের ভেতরে ঢুকলাম, ভেতরের মেঝেটা ঘুরছিল। আর আমরা উঠে যাচ্ছিলাম ওপরে ১ হাজার ৮৬ মিটার উঁচু টেবিল মাউন্টেনে। বেলেপাথর, গ্রানাইট ও শিলা দিয়ে গড়ে ওঠা এই পাহাড় দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম আকর্ষণ। এটি সম্প্রতি প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের একটিতে স্থান করে নিয়েছে। পর্বতে পা রাখামাত্র ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। কড়া রোদ, কিন্তু বাতাসের কারণে ঠান্ডা। মনে বলল, বাবা ঠান্ডা লাগছে। ওর হুডি জ্যাকেটের ওপর আরও একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে দিলাম। একটু পর হাওয়াটা থেমে গেল, রোদের কারণে একটু উষ্ণ বোধ হলো। আমরা ওপর থেকে কেপটাউনকে দেখলাম, দুরবিন চোখে দিয়ে। দুরবিনের পেটে সে জন্য পাঁচ র্যান্ডের মুদ্রা ফেলতে হয়। অতলান্তিকের নাচন দেখলাম। দূরে যেখানে নেলসন ম্যান্ডেলা বন্দী ছিলেন প্রায় দুই দশক, সেই রবেন আইল্যান্ডও দেখা যায় পর্বতের ওপর থেকে। তবে ছোট পাতার মতো। নগর ও বন্দর দেখা যায়।
পর্বতের ওপরেই ছোট একটা খাবারের দোকান আছে। আমি আর মনে স্যান্ডউইচ খেয়ে বাইরে এসে পর্বতের অন্য দিকটায় গিয়ে বসলাম। যেদিকে শহর নেই, আছে বিস্তীর্ণ জলরাশি। বসার জায়গাটিকে ঘিরে কোমর অব্দি পাথরের পাঁচিল তুলে দেওয়া, যেন কেউ পড়েটরে না যায়। সেখানে ভিড় করছে রক্তিম ডানার শালিক, ইংরেজিতে রেড-উইংড স্টার্লিং। মানুষের ছড়িয়ে দেওয়া খাবারের দানার লোভে এরা ভয়ডর ভুলে গেছে। মানুষের খুব কাছাকাছি এসে বসে থাকে, মিষ্টি সুরে ডাকে, উড়ে চলে যায় না। আমি সেই সুযোগে কিছু ছবি তুলে নিই এই মোহনীয় কৃষ্ণপক্ষীর। মনেও খুব আনন্দ পেল ওদের দেখে।
ভয়ডর ভোলা রেড-উইংড স্টার্লিং। ছবি: লেখক
টেবিল মাউন্টেনের একদিকে এক হাজার মিটারের ডেভিলস পিক, অন্যদিকে সাড়ে ছয় শ মিটারের একটু উঁচু লায়নস হেড। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘূর্ণিলাগা বাতাসের ঝাপটা মাঝে মাঝে এসেই আমাদের ওপর এসে পড়ছে। আর বেলা তিনটার দিককার সূর্যালোক, পাহাড়ের ভিন্ন রূপ তুলে ধরছিল আমাদের সামনে। ওখানকার এক ছোট্ট দোকানে ঢুকে টুকিটাকি কেনাকাটা করলাম। এরপর মনেকে বললাম, চলো তবে যাওয়া যাক। মনে আইসক্রিম খেতে চাইল। আমি জানি এখন আইসক্রিম কিনে দিলে কেব্ল-কারের ঘূর্ণমান মেঝেতে মনে সেটিকে সামলাতে পারবে না, হয় ওর, নয়তো আমার জামাকাপড় নষ্ট করবে। বললাম, চলো আমরা কেব্ল-কারে নিচে নামি, সেখানে আইসক্রিমের দোকান আছে। কেব্ল-কারে আবার উঠলাম, নামার সময় কানে তালা লাগল। বাতাসের চাপের কারণে। নিচে নেমে সাতরঙা টর্নেডো আইসক্রিম কিনে দিলাম মনেকে। উবার ডাকলাম। কিন্তু কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। দুই কানই বন্ধ। কয়েকবার জোরে জিজ্ঞেস করে করে চালকের কথার উত্তর দিচ্ছি। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। পরে ইন্টারনেটের সহায়তায় জানলাম, চুইঙ্গাম চিবুলে বা হাই তুললে কানের তালা ছোটে। হাই তুলে তালা ছোটালাম। উফ, স্বস্তি!
হোটেলে ফেরার পথে রাস্তায় সিগন্যালে দাঁড়ালে, এক নারী হকার ম্যাগাজিন বিক্রি করতে এলো। ম্যাগাজিনটির নাম খেয়াল করতে পারিনি, তবে কাভার স্টোরিটা চোখে পড়ল: দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্বাস্তু সমস্যা। সবুজ সংকেত জ্বলে উঠল। আমরা চলতে শুরু করলাম।
পরের দিন ঠিক করলাম ওয়াটার ফ্রন্টে গিয়ে রবেন আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য বোটের টিকিট কাটব। আর বাকি সময়টা কাটাব বইয়ের দোকানে, মনেও নাকি টয় কিংডমে যাবে। পরিকল্পনামাফিক পরদিন ওয়াটার ফ্রন্টে গিয়ে টিকিট কাটলাম, দুজনের ৯০০ র্যান্ডের মতো লাগল। পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ৬০০ র্যান্ড। টিকিট কাটার আগেই অবশ্য ডাইকাস্ট গাড়ি কিনে দিতে হয়েছে মনেকে। টিকিট কাটার পর মনেকে নিয়ে গেলাম একটা প্লেয়িং জোনে, পাশেই। ওর খেলাধুলা শেষ হলে গেলাম বইয়ের দোকানে। ওদের এখানে চেইনশপ এক্সক্লুসিভ বুকসে ঢুকলাম। সেখানে ঢুকে আফ্রিকান নন-ফিকশন সেকশনে পড়ার মতো বই পেলেও ফিলোসফি আর টিভি-ফিল্ম বিভাগে খুব ভালো কিছু পাওয়া গেল না। তা-ও আটখানা বই কিনলাম। এগুলোর ভেতর সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে খ্রিস্টফার জে. লিয়ের লেখা ‘ফ্রানৎস ফানোঁ: টুয়ার্ড আ রেভল্যুশনারি হিউম্যানিজম’ বইটিকে। নেলসন ম্যান্ডেলার টুকরো লেখা ও বক্তৃতার সংকলন ‘নো ইজি ওয়াক টু ফ্রিডম’ বইটিও বেশ ভালো। আরেকটি মজার বই কিনেছি: ‘ডার্টি ফ্রেঞ্চ’, এটি সাধারণ ফরাসিদের আটপৌরে, পথচলতি, ঘরোয়া কথাবার্তা এবং গালাগালির বই। দেশের বাইরে গেলে কেন জানি ফরাসি ভাষার বই কেনার লোভ সামলাতে পারি না, কিনি, পড়তে আনন্দ পাই। ফরাসি ভাষার প্রতি আমার আকর্ষণ আশৈশব।
এদের আফ্রিকান্স ভাষায় বেশির ভাগটা জুড়ে আছে ডাচ, বাকিটায় আছে জর্মন ও খোইসান ভাষা। ফরাসিটাও আছে এক চিমটির মতো। আফ্রিকান্স কিন্তু আফ্রিকার কোনো ভাষা নয়। বলা হয়, এই ভাষা এসেছে পিজিন ডাচ কিংবা কিচেন ডাচ থেকে। আফ্রিকান্স ভাষাটি রান্নাঘর থেকে এসেছে এই তত্ত্ব মেনে নিলেও, পর্যটক হীরেন সিংহরায় দেখলাম পিজিন বা ক্রেওল তত্ত্বটি মানতে রাজি নন। রান্নাঘর থেকে আসার অর্থ হলো সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, বিশেষ করে নারীদের কাছ থেকে আসা। অন্যদিকে পিজিন বা ক্রেওল হলো একাধিক ভাষার সেতুবন্ধ, যেমন মরিশাসের ক্রেওল হলো ইংরেজি ও ফরাসির মিশ্রণ। আফ্রিকান্সের নব্বই থেকে পঁচনব্বই ভাগ শব্দই ডাচ। যদিও ডাচ ব্যাকরণ ভেঙেচুরে ভিন্ন চেহারা নিয়েছে এই ভাষায়। আমি, তুমি, তারা, আপনি, আপনারা—অর্থাৎ কর্তা যা-ই হোক না কেন, ক্রিয়াপদ সবগুলোর ক্ষেত্রেই এক। ব্যতিক্রম নেই। তো এই ব্যাকরণ ভাঙা ভাষাটিকেই ১৯২৫ সালে উচ্চশিক্ষায় ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে সত্তর লাখ মানুষ আফ্রিকান্স ভাষায় কথা বলে। ব্যবহারের দিক থেকে জুলু ও খোসা ভাষার পর এটি তৃতীয়। প্রায় ৬ কোটি মানুষের দেশে ইংরেজির চলটাও আছে বেশ ভালোভাবে। ওটার কারণেই চলাফেরা করতে অতটা অসুবিধা হয় না। অন্তত উবার-চালকরা ইংরেজিটা জানেন।