“সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়/ মন্দিরে বাজছিল পুজোর ঘণ্টা/ সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;/ শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;/ কবির সংগীতে বেজে উঠছিল/ সুন্দরের আরাধনা।” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (আফ্রিকা)
২৬ সেপ্টেম্বর সকালে পুত্র মনে আর আমি যখন ওয়াটার ফ্রন্টে পৌঁছালাম, তখন অতলান্তিকের দক্ষিণ প্রান্ত যেন রোদ মেখে ঝলমল করছে। ঢেউয়ের মুকুটে যেন চকমকি পাথর বসানো। আর তাকে সামনে রেখে সকল আয়োজন, সকল আরাধনা। ঘাটে ছোটবড় নৌযান বাঁধা। বিনয়ের সাথে প্রস্তাব আসছে ঘুরতে যাবো কি না। মনে বলল, বাবা চলো বোটে চড়ি। বললাম, চলো তবে, তোমার মা থাকলে ভালো হতো। আমরা দেড়শ র্যান্ড দিয়ে দুটো টিকিট কিনলাম। মনের জন্য হাফ টিকিট। এক ঘন্টা সমুদ্রতীর ঘেঁষে অতলান্তিক ঘুরিয়ে দেখাবে। আমরা উঠেই দেখি তিন কৃষ্ণ তরুণী বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে গান গাইছে আর ছবি তুলছে। তাদের ছবি তোলার বহর দেখে মনে হেসেই কুটিকুটি। তারাও হাসি বিনিময় করল মনের সাথে। আর উঠল একটি ভারতীয় পরিবার, তারা অবশ্য আর ভারতে থাকেন না, প্রবাসী পরিবার। তো বোট ছাড়ল ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায়। একটু দূর যাওয়ার পরই বোঝা গেল আমরা অতলান্তিকে আছি। বোটের ছাদে বসায় শীতল বাতাসের ঝাপটা কাঁটার মতো বিঁধছিল চোখেমুখে। আর নীচে ঢেউ যেন খেলনা নৌকা নিয়ে খেলছে। মনে আর আমি একটু সন্ত্রস্ত হলাম। তবে পুরো ব্যাপারটা রোলার কোস্টার মনে করে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। ভুলে থাকতে চাইলাম, আমরা আছি আটলান্টিক মহাসাগরে।
বোট থেকে দেখা টেবিল মাউন্টেন। ছবি: লেখক
মহাসাগরের পানি অনেক ঠাণ্ডা বলে সীল মাছগুলো উঠে আসে বয়াতে। সেখানে রোদ পোহায়। তীর ধরে আরো এগুতে থাকল বোট। একপাশে টেবিল মাউন্টেন। পর্বতের সানুদেশে মেঘ গুলজার। সমুদ্রের বুকে শুয়ে আছে রবেন আইল্যান্ড। বোটের ছাদে থাকা গাইড ডাঙার বিভিন্ন স্থাপনার বর্ণনা দিচ্ছে। ক্লক টাওয়ার, স্বয়ংক্রিয় সেতু, ম্যান্ডেলা মিউজিয়াম। লাল রঙয়ের গথিক স্টাইলের ক্লক টাওয়ারটি ডক ক্লক নামেও পরিচিত। স্থাপিত হয় ১৮৮২ সালে। আরেকটু সামনে এগুতেই বিশাল এক লাল জাহাজ দেখিয়ে গাইড বলল, এটি গত সপ্তায় অ্যান্টার্টিকা থেকে এসেছে। গবেষণা কাজে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের বহন করে বরফের রাজ্যে গিয়েছিল ‘এস এ আগুলাস টু’ জাহাজটি। লক্ষ্য করে দেখলাম জাহাজটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে ‘মামা আফ্রিকা’ খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকার গায়িকা, গীতিকার ও নাগরিক অধিকারকর্মী মিরিয়াম মাকেবাকে। তিনিও মাদিবার মতোই বর্ণবিদ্বেষী ‘অ্যাপারথেইড’ ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকার সঙ্গীত ছাড়াও জাজ সঙ্গীতের জন্যও তিনি জনপ্রিয়। তবে ঠিক কোন কারণে গবেষণা কাজে ব্যবহৃত জাহাজটি সচেতন এই শিল্পীকে উৎসর্গ করা হয়েছে তা জানা হয়নি।
যাহোক, কিছুক্ষণ পর নৌযান ফিরে এলো ঘাঁটে। আমরা নেমে এগিয়ে গেলাম আফ্রিকান ট্রেডিং পোর্ট ভবনের সামনে। ১৯০৪ সালে নির্মিত এই তিন তলা ভবনটি পুরনো বন্দরের কাপ্তানের কার্যালয় হিসেবেও পরিচিত। খোলা চত্ত্বরে সেখানে সারাদিনই কোনো না কোন দল গান-বাজনা পরিবেশন করে মুখর করে রাখে। চত্ত্বরের একপাশে একটা ছোট দোকান আছে ‘হটডগ কিং’, মনের ইদানিং হটডগ খুব প্রিয় হয়েছে। কাজেই তাকে নিয়ে খেতে বসলাম আর চত্তরে চলা সুর ও নাচের উপস্থাপনা উপভোগ করলাম। এই চত্ত্বরটি পেরুলেই, শপিংমলের দিকে যেতে চোখে পড়বে একাধিক স্যুভিনিয়র শপ, একটি ছোট এম্ফিথিয়েটার, প্রচুর রেস্তোরাঁ আর বাচ্চাদের খেলার জায়গা। প্রায় তিনশ একরের উপর গড়ে ওঠা পর্যটন কেন্দ্রটির পোশাকি নাম ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলফ্রেড ওয়াটারফ্রন্ট। এটি আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে পুরনো পোতাশ্রয়। ১৮৬০ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স আলফ্রেড এই কেপ কলোনির পোতাশ্রয়ে আসেন। তখন আলফ্রেডের বয়স মাত্র ১৬ এবং তিনি রয়েল নেভির মিডশিপম্যান। রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে তার আগমন বেশ আলোড়ন তুলেছিল। তখন তৈরিকৃত নৌঘাঁটির নাম তাই রাজপুত্র ও রানিমাতার নামেই রাখা হয়। ওয়াটারফ্রন্ট আরো একটি কারণে পরে আলোচনায় আসে, সেটি হলো ‘প্ল্যানেট হলিউড’ রেস্তোরাঁয় বোমা হামলার ঘটনায়। ১৯৯৮ সালের সন্ত্রাসী ওই হামলায় মারা যায় দুই জন। আহত হয় ২৬ জন। এরপর থেকেই এখানে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। হোটেলটি এখন আর নেই। তবে আমরা সেটা খোঁজার চেষ্টাও করিনি। খোলা চত্তরে ‘গরম কুকুর’ খেয়ে আমরা ধরলাম ‘টু ওশেসনস’ এক্যুয়েরিয়ামের পথ—ডক রোড। এক্যুয়েরিয়ামের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে ভারত মহাসাগর আর অতলান্তিক মহাসাগরকে বোঝানো হচ্ছে। এক্যুয়েরিয়ামটি তৈরি করা হয় ১৯৯৫ সালে।
মনে খেতে খেতেই বলছিল, বাবা চলো এবার একটু ফিশ-টিশ দেখে আসি। বললাম, চলো তবে। সাড়ে ছয় বছরের বালক তার বাবার সাথে হাত ধরে চলল মাছ-টাছ দেখার জন্য। টিকিট কেটে ঢুকতেই দেখি বোতলাকৃতির চৌবাচ্চার ভেতর জেলিফিশ। মনে বিস্ময় নিয়ে প্রাণীটিকে দেখল। এরপর বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছালাম পেঙ্গুইনদের কলোনীতে। অনেকখানি সময় নিয়ে আমরা বিভিন্ন জাতের পেঙ্গুইন দেখলাম। আফ্রিকান পেঙ্গুইনদের চলাফেরা বেশ রাজকীয়। পানির নীচে এরা আড়াই মিনিট বাতাস ছাড়া থাকতে পারে। আর শিকার ধরার সময় ছুটতে পারে ঘন্টায় কুড়ি কিলোমিটার পর্যন্ত। প্রকৃতিতে খাদ্যাভাব ও থাকার জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতে চমৎকার প্রাণীগুলো বিপন্নতার ভেতর আছে। মনের মনে ধরেছে রকহুপার পেঙ্গুইনকে, কারণ অ্যানিমেটেড মকুমেন্টারি ‘সার্ফ’স আপ’ মনের দেখা।
দক্ষিণ আফ্রিকান পেঙ্গুইনদের কলোনিতে। ছবি: লেখক
অনেকক্ষণ পেঙ্গুইনের হাঁটাচলা, পানিতে ঝাঁপ ও সাঁতারের দক্ষতা দেখে আমরা গেলাম হাঙর দর্শনে। বিশাল চৌবাচ্চার ভেতর তৈরি করা হয়েছে সমুদ্রের তলদেশের অভয়ারণ্য। সেখানে অন্য মাছেদের সাথে স্যান্ড টাইগার শার্কগুলোও বেশ গম্ভীর চালে সাঁতার কেটে চলেছে। মনে বেশ মজা পেল, বিশেষ করে ওদের দাঁত দেখে। কার্টুন ছবির শার্কো ও মারিনার কথাই বোধহয় ওর মনে পড়েছে। নয় তো হাঙরের রাজকীয় সাঁতার কেটে চলা দেখতে দেখতে মনে জিজ্ঞেস করতো না, বাবা এখানে কি মৎস্যকন্যা আছে? গ্যালারির মতো জায়গায় বসে জলের ভেতরকার অরণ্য দেখতে দেখতে আমি হাসলাম হো হো করে। গোটা অ্যাকুয়েরিয়ামে তিনশ প্রজাতির বেশি আট হাজার জলজ প্রাণী রাখা আছে। সব তো আর দেখা সম্ভব হয়নি। বেছে বেছে যতটুকু দেখা গেছে দেখেছি। ফেরার পথে আবার জেলিফিশকে বিদায় বলতে হলো মনের জন্য। ওটাকে তার বিশেষ ভালো লেগেছে।
দ্বিতীয় দিন হিসেবে ঘোরাঘুরি মন্দ হয়নি। তাছাড়া ঘন্টা দুয়েকের ভেতর সন্ধ্যা নামবে, কাজেই হোটেলে ফিরে এবার একটু বিশ্রাম করা যাক। পরদিন উত্তমাশার প্রাসাদ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। হোটেলের লোকজন বলছিল, প্রাসাদের বাইরে ছিন্নমূল মানুষের বাস, তাই না যাওয়াই উত্তম। দ্বিতীয় দিন গেলাম না বটে, তবে অযথা অতিরিক্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে দেশটির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে না দেখার কোনো মানে হয় না। মনোস্থির করলাম প্রাসাদে যাবো, মনেও থাকবে আমার সাথে।