কেপটাউনের বিমানবন্দরে পা রেখেই মনে হলো গোটা বিশ্বের কালো মানুষদের অধিকার আদায় ও বৈষম্যহীন দুনিয়া গড়তে চাওয়া লড়াকু নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ওরফে মাদিবার দেশে এলাম। যদিও মাদিবা গোত্রের নাম, কিন্তু এখানে ম্যান্ডেলাকে সবাই ওই নামেই ডাকে। কেপটাউনের সঙ্গে মাদিবার সম্পর্কটা বেশ গভীর। কারণ, ২৭ বছরের বন্দিজীবনের ভেতর, এই অন্তরীপের অদূরেই অতলান্তিকের এক ছোট দ্বীপ রবেনে তিনি কারাভোগ করেন ১৮ বছর, কালো মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন বলে। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘অ্যাপারথেইড ল’ অনুযায়ী এ দেশের নাগরিকদের চারটি বর্ণে ভাগ করা হয়: শ্বেতাঙ্গ বা ইউরোপীয়, কৃষ্ণাঙ্গ, কালার্ড বা মিশ্রবর্ণ এবং ভারতীয় বা এশীয়। ম্যান্ডেলা ছিলেন এই বিভেদের বিপক্ষে। দক্ষিণ আফ্রিকার ৮০ ভাগ কালো মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং তারা বর্ণবৈষম্যের শিকার। ম্যান্ডেলার আন্দোলন ছিল তাদের জন্যই। কিন্তু শ্বেত-শাসন সেটা মেনে নেবে কেন? ফলে দীর্ঘ কারাভোগ করতে হয় ম্যান্ডেলাকে। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শাসকগোষ্ঠী। ১৯৯০ সালে মুক্তির পর তিনি কেপটাউনে এসেই প্রথম জনসমক্ষে বক্তৃতা দেন। বহু বছর পর সেই বক্তৃতা শোনার জন্য কেপটাউন সিটি হলের সামনে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। সেই বক্তৃতা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এক যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা। তিনি বলেছিলেন, যা ঘটেছে তা যেন সবাই ভুলে যায়। প্রতিহিংসা তিনি চান না। সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে অতীত ভুলে সবাইকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
পর্বতসম মাদিবার মতোই আরও এক পর্বত দাঁড়িয়ে আছে কেপটাউনে—টেবিল মাউন্টেন। পর্বতের ওপরে টেবিলের মতো সমতল আছে বলেই এমন নাম। বিমানবন্দর থেকে হিরেনগ্রাখট স্ট্রিটের অনিক্স হোটেলে যাওয়া পর্যন্ত পর্বতটি আমাদের অভিবাদন জানিয়ে গেল। ইউরোপের মতোই গোছানো ও পরিষ্কার রাস্তাঘাট। আধুনিক শহরের সব বৈশিষ্ট্যই হাজির এই শহরে। পরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব আধুনিক চেইন শপের আউটলেট বসেছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। হোটেলে এসে মালমত্তর রেখেই দুপুরের খাবার খেতে নিচে নামি, চটজলদি ভরসার নাম ম্যাকডোনাল্ড, হোটেলের নিচেই তাদের ঘর। খাওয়া শেষে আশপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে প্রথম দিনেই পরিচয় হয় বাংলাদেশি মানুষদের সঙ্গে, মনোহারি দোকানের কর্মচারী। দোকানের মালিকও বাংলাদেশি। প্রায় ১০ বছরের প্রবাসজীবন। এখানকার অধিকাংশ মুদিদোকানের ব্যবসাই বাংলাদেশিদের দখলে। আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা একটু উন্নত বলে শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, মাদাগাসকার প্রভৃতি জায়গা থেকে লোকজন এসে ভিড় করে এখানে। জীবনধারণের জন্য, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য। ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে এসে লোকে এখানে জীবনের নিরাপত্তহীনতায় ভোগে। কেপটাউনে পা রাখার পর থেকেই শুনছি বাড়বাড়ন্ত অপরাধপ্রবণতার কথা। কিন্তু যে দেশে আন্তর্জাতিক নামজাদা ব্র্যান্ডের গাড়ির দোকানের ছড়াছড়ি, যে দেশে এত ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে, সে দেশে চুরি-ছিনতাই-রাহাজানি-অপহরণ এত বেশি কেন? এর একটাই উত্তর: সম্পদের বৈষম্য এখানে প্রকট। কিছু মানুষ অনেক ধনী, আর অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র, উদ্বাস্তু, অবহেলিত, তাই বেপরোয়া। কেপটাউনের রাস্তায় গৃহহীন মানুষ চোখে পড়ে, এমনকি ভিক্ষুকও।
কেপটাউনের যেকোনো জায়গা থেকে টেবিল মাউন্টেন দৃশ্যমান। ছবি: লেখক
সবাই আমাদের সাবধান করে দিচ্ছিলেন, যেন রাস্তায় ফোন নিয়ে বেখেয়ালে কথা না বলি, টাকা সবার সামনে না বের করি, যেকোনো মুহূর্তে ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। তবে আমাদের হোটেল যে অঞ্চলে সেটি নিরাপদ, পুলিশের টহল চোখে পড়ে। তারপরও, সাবধানের মার নেই। এদের গুণ্ডা বাহিনী পুলিশের চেয়ে নাকি শক্তিশালী ও ভয়ংকর। দিনদুপুরে মানুষ খুন করে ফেলে রেখে যায়। আমরা আসার কয়েক দিন আগেই নাকি এক বাংলাদেশিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা, ছিনতাই করতে গিয়ে। রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব! তো প্রথম দিন এসব সন্ত্রাসের কথাই শুধু শুনলাম। আর মনে মনে দমে যেতে থাকলাম, এত সুন্দর শহর, এত চমৎকার প্রকৃতির লীলাভূমি, তবে কি মন ভরে দেখাই হবে না? অপরাধ করার ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ নাকি দায়ী কালোরা। তাহলে নেলসন ম্যান্ডেলার দেখা স্বপ্ন—বিভেদহীন সমন্বিত জাতির রাষ্ট্র—তবে কি অধরাই থেকে যাবে এই ভূখণ্ডে? সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা যে মিশ্র জাতির সূচনা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়, সেটাকেই ঐকতানবাদনের মাধুর্য মিশিয়ে সামনে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন মাদিবা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্ণবৈষম্য এখনো আছে এই দেশে, হুট করে বোঝা যায় না। তবে ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে কম মজুরির কাজ কালোরাই করে, এমনকি ট্যাক্সি বা উবার চালকদের ভেতর অধিকাংশ কালো ও মিশ্র বর্ণের দেখা মেলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বেকারত্বের সমস্যাও আছে। কালোরা বলে, বাইরের দেশ থেকে লোকজন এসে এখানে তাদের কাজের ওপর ভাগ বসাচ্ছে। আর বাইরে থেকে আসা লোকেদের অভিযোগ, এখানকার কালোরা ভীষণ অলস আর অপরাধপ্রবণ। এসবের ভেতরে নিশ্চয় আরও অনেক কারণ ও বিশ্লেষণ রয়েছে, সেটা তোলা থাকল সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য।
এখানে সাদারা যে সবাই বিদ্বেষী বা বর্ণবাদী, তা নয়। সব দেশেই প্রগতিশীল মানুষ আছে। তারা ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। এই ভাবনাচিন্তার মানুষদের জন্য এই দেশে বাঙালি ধাঁচের মুখমণ্ডলও দেখা যায়। একটু ব্যাখ্যা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। কেপটাউনের স্থানীয় বাসিন্দাদের বলে খইসান। তাদের সঙ্গে অনেক সাদাই সংসার পেতেছে। তারা ছাড়া মিশ্রবর্ণের যে মানুষ এখানে দেখতে পাওয়া যায়, তার কারণ অনুসন্ধানে যেতে হবে পাঁচ-ছয় শ বছর আগে। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ডাচ বাণিজ্য জাহাজের বহর পূর্ব আফ্রিকার কূল ঘেঁষে বাণিজ্য করেছে, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার ডাঙায় উঠতে পারেনি। বলা হয়, ১৪৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইরোপীয় হিসেবে পর্তুগিজ নাবিক বার্থলোমিয়ো ডায়াসই প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করেছিলেন। পরে ১৬৫২ সালে ডাচরা কেপটাউনে প্রথম নোঙর ফেলে। তখন থেকেই সাদাদের বাস শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। ডাচরা এখানকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়নি, বরং এখানেই চাষাবাদ করেছে। অবাধ দাস ব্যবসা করেছে। মাদাগাস্কার, বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন বদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া ও মালয় থেকে এসেছে দাসেরা। তারা জমিতে কামলা খেটেছে। আবার ধীরে ধীরে সাদাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। দখলদার ডাচদের কিছু উদার নীতিও ছিল বটে, কোনো দাস নারীকে তারা বিয়ে করলে দাসত্ব থেকে তার চিরমুক্তি ঘটত। যেমন ১৬৫৬ সালে ইয়ান ওয়াওতারস আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন ক্যাথরিনা অব বেঙ্গলকে। বোঝাই যাচ্ছে ক্যাথরিনা ওই নারীর আসল নাম নয়, আর বিয়ের জন্য খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে তাকে। ১৬৫৮ সালে ইয়ান সাখারিয়াস বিয়ে করেন মারিয়া অব বেঙ্গল নামের আরেক বাঙালি মেয়েকে। দলিল-দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, মেয়েটি এসেছিল হুগলি বা ঝড়খালি থেকে। ১৬৬৯ সালে আরনলদুস বাসসন বিয়ে করেন এঞ্জেলা অব বেঙ্গলকে। এই বিয়েথা, বাচ্চাকাচ্চা, সংসার ইত্যাদির সঙ্গে যখন চাষাবাদ চলছে, তখন কেপটাউন দিয়ে পরবর্তী দুই শ বছরের ভেতর প্রবেশ ঘটে গেছে পর্তুগিজ, ফরাসি, জার্মান ও ইংরেজদের। যদিও পর্তুগিজরা ১৪৮৮ সালে কেপ পয়েন্ট দিয়ে পুব দিকে যাওয়ার রাস্তা আবিষ্কার করে প্রথম, কিন্তু স্থানীয় খইসানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল বৈরী, ফলে তারা ডাচদের মতো জমিয়ে ব্যবসা করতে পারেনি। পরে অবশ্য পেরেছে। তো এই ভাগ্যান্বেষী শ্বেতাঙ্গরা স্থানীয় খইসান ও দাসীদের বিয়ে করেছে, আবার হয়তো বিয়ে করেনি, কিন্তু সন্তান উৎপাদন করেছে। এর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় নানা বর্ণের মানুষের উদ্ভব ঘটেছে। আগ্রহী পাঠক হীরেন সিংহরায়ের ‘আমার আফ্রিকা’ বইয়ের পাতা উল্টে দেখতে পারেন, এ-সংক্রান্ত আরও তথ্য পাবেন।
হোটেলের জানালা থেকে অপূর্ব সমুদ্রবন্দর। ছবি: লেখক
দক্ষিণ আফ্রিকায় একটা শব্দ বেশ প্রচলিত: আফ্রিকানার। অর্থাৎ ১৬৫২ সালে যারা প্রথম এই অন্তরীপে পা ফেলেছিল, সেই ডাচদের থেকে শুরু করে, অন্য যেসব ঔপনিবেশিক শক্তি এসেছিল, তাদের ও তাদের বংশধরদের আফ্রিকানার বলা হয়। তো এই সাদা আফ্রিকানার ছাড়াও, পরবর্তী সময়ে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও সাদারা এখানে বসতি গেড়েছে। বাংলাদেশিরাও পিছিয়ে নেই। আমরা যে অনিক্স হোটেলে উঠেছি তার ঠিক দুই শ গজ পেছনেই পেয়েছি টাঙ্গাইলের লোক, এখানে মুদিদোকানের ব্যবসা করছে এবং আরও দুই বাংলাদেশিকে চাকরি দিয়েছে। কথায় কথায় জানা গেল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা উৎকৃষ্ট জায়গা। এই সত্যটি ডাচরা চার শ বছর আগেই অবশ্য বুঝতে পেরেছিল। বাঙালিরা বুঝতে পারছে ইদানীং।
আর আমরা যারা মৌসুমি বিহঙ্গের মতো সাময়িক কাজ অথবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসি এই দক্ষিণ আফ্রিকায় তারা বুঝতে পারি, এই দেশ দেখতে যত সুন্দরই হোক, যতই আলো ঝলমল করুক না কেন, পাদপ্রদীপের নিচে আছে গাঢ় অন্ধকার, তাই সন্ধ্যা নামলে বাইরে একলা বের হওয়া বারণ। এ এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। সন্ধ্যা সাতটার পরই সব সুনসান। কাজেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন সকাল থেকেই শুরু করব আমাদের ভ্রমণ। আমি আর মনে। তা ছাড়া প্রথম দিন দীর্ঘ প্রায় ১৭ ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তিও আছে। আমার স্ত্রী মনির মন খারাপ, কারণ এবার সে আমাদের সঙ্গে ঘুরতে পারবে না। মনে বলল, ফ্রান্সে বাবার কাজ ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় মায়ের। আমি বললাম, মন্দ নয়, পাল্টাপাল্টি হয়ে গেল। অফিসের কাজে বাংলাদেশ থেকে আরও এসেছেন কাজি মাহযাবিন মমতাজ, সম্পর্কে আমার ভাবি এবং দুই তরুণ আরাফাত ও তপু।