এখন নোবেল পুরস্কারের মৌসুম। ইতিমধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে পুরস্কার ঘোষিত হয়ে গেছে। আজ ঘোষিত হবে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার। বিশ্বজুড়েই চলছে এন্তার জল্পনা-কল্পনা, এ বছর কে পাচ্ছেন এই পুরস্কার, তা নিয়ে। বাজি ধরাধরিও চলছে রীতিমতো বলে-কয়েই। সেই উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা গ্রাস করেছে এ দেশের বিদ্বৎজনদেরও।
পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে নিবন্ধাদি প্রকাশের হিড়িক পড়ে গেছে এরই মধ্যে; সামাজিক মাধ্যমেও সম্ভাব্য পুরস্কার প্রাপক-সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী করে স্ট্যাটাস ভূমিষ্ঠ হচ্ছে মুহুর্মুহু। কেউ কেউ সাহস করে সঙ্গে এই প্রশ্নটিও জুড়ে দিচ্ছেন যে, সাহিত্যে আমরা কবে নোবেল পাব আবার? সবেধন নীলমণি যে-একটি মাত্র পুরস্কার জুটেছিল বাংলা সাহিত্যের ভাগ্যে, তার বয়সই তো এখন একশ আট! বস্তুত এই প্রশ্নটিকেই আরেকটু তলিয়ে দেখা এবং এর একটা সন্তোষজনক উত্তর খোঁজার লক্ষ্যেই এই নিবন্ধের অবতারণা।
এই প্রশ্নের পিঠে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসে: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো লেখক কিংবা সাহিত্যকর্ম আছে আদৌ? এর উত্তর: আলবৎ রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের পরে অন্তত আরও এক ডজন সাহিত্যিকের নাম এই মুহূর্তেই করা যায়, যেকোনো মানদণ্ডেই যাঁরা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। বাংলা কথাসাহিত্যের বিখ্যাত তিন বন্দ্যোপাধ্যায় তো রয়েছেনই, সেই সঙ্গে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সতীনাথ ভাদুড়ী, অমিয়ভূষণ মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী, দেবেশ রায়, শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এমনকি সৈয়দ শামসুল হকের নামও উঠে আসতে পারে এই তালিকায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তাঁরা কেউই এই পুরস্কারের মুখ দেখে যেতে পারেননি। এর কারণ আর কিছু নয়: জীবদ্দশায় তাঁদের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মসমূহের বিদেশি তথা ইংরেজি ভাষায় ঠিকঠাকমতো অনুবাদ না হওয়া।
খোদ রবীন্দ্রনাথও এই পুরস্কার আদৌ পেতেন কি না, সন্দেহ; যদি তিনি নিজেই নিজের কিছু কবিতা অনুবাদ করার উদ্যোগ না নিতেন এবং তাঁর যদি ঘটনাচক্রে বিখ্যাত বিলেতি চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রদেনস্টাইনের সঙ্গে পূর্বপরিচয় না থাকত। কেননা, এই রদেনস্টাইনই প্রখ্যাত আইরিশ কবি ইয়েটসের সঙ্গে কবির পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর অনূদিত কবিতার পাণ্ডুলিপিখানি। ইয়েটস সেগুলো পড়ে ও কবির কণ্ঠে সেসবের অপূর্ব আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রকাশিতব্য গীতাঞ্জলি গ্রন্থের জন্য একটি মুখবন্ধ লিখে দেন, যা আমরা জেনেছি, কবির নোবেল পুরস্কার লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ধান ভানতে এই রবির গীত গাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য: অনুবাদ ও বৈশ্বিক যোগাযোগের ওপর জোর দেওয়া, যে-দুটোর অভাবে অদ্যাবধি বাংলা সাহিত্যের আর কারও ভাগ্যে, যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, এই নোবেলের শিকেটুকু ছিঁড়ল না। প্রথমে আসা যাক অনুবাদের বিষয়টিতে। নোবেল পুরস্কারটি যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যার পরিসর গোটা বিশ্বে বিস্তৃত, সেহেতু এর যাবতীয় কার্যকলাপ একটি মোটামুটি সর্বজনবোধ্য আন্তর্জাতিক ভাষার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়; বলা বাহুল্য, সে-ভাষাটি ইংরেজি। ফলত নোবেল পুরস্কারের জন্য আমাদের কোনো সাহিত্যিককে প্রাথমিকভাবে বিবেচিত হতে হলেও তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মসমূহকে ইংরেজিতে এবং সম্ভব হলে আরও দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বভাষাতেও অনূদিত হওয়া আবশ্যক। তবে এই অনুবাদ যার-তার দ্বারা, যেন-তেন প্রকারে সংঘটিত হলে চলবে না; তাকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং বর্তমান বিশ্বের স্বীকৃত ন্যূনতম ভাষামান ও প্রকাশরীতির নিরিখে প্রকাশক, সম্পাদক, সমালোচক সম্প্রদায়, সর্বোপরি বৃহত্তর পাঠকশ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তেমন অনুবাদক, যার বাংলা ও ইংরেজি এই দুই ভাষাতেই রয়েছে সমান দখল ও দক্ষতা, বিশেষ করে সমকালীন ও সৃজনশীল ইংরেজিতে লিখবার সহজাত ক্ষমতা, খুব বেশি নেই এখনকার বাংলাদেশে; এই কথাটি আমাদের সর্বাগ্রে স্বীকার করে নেওয়াটাই মঙ্গলজনক। তাহলে করণীয় কী? করণীয় এই যে, আমাদেরকে এ জন্য শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাইরেও তাকাতে হবে।
ঐতিহাসিক কারণেই পাশের দেশ ভারতে উল্লেখিত মান ও যোগ্যতাসম্পন্ন অনুবাদকের সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফলে আমাদের নজরটা সেদিকেও প্রসারিত করতে হবে। অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অনুবাদকেরাই আমাদের সাহিত্যের অনুবাদ করছেন অনেক বেশি এবং সেগুলো বিশ্বের বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত, প্রশংসিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুরস্কৃতও হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে দুজন অনুবাদক অরুণাভ সিনহা ও ভেঙ্কটেশরাম স্বামীর কথা বলতেই হয়, যাঁদের দক্ষ হাতে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, শহীদুল জহিরের মতো আমাদের দিকপাল লেখকেরা অনূদিত হয়ে চলেছেন। এর বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও অনেকে রয়েছেন যাঁরা এই কাজের যোগ্যতা রাখেন এবং তাঁদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা করেও চলেছেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শবনম নাদিয়া, যিনি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যের একাধিক শক্তিমান লেখকের রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেশে ও বিদেশে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। এছাড়া ক্লিন্টনবুথ সিলি, উইলিয়াম রাদিচে, হান্স হার্ডারের মতো আরও অনেক বিদেশিও রয়েছেন যাঁরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রেমে পড়ে এই ভাষাটাকে রপ্ত করেছেন খুব যত্নসহকারে, যা কাজে লাগিয়ে তাঁরা আমাদের অনেক মূল্যবান সাহিত্য ইতিমধ্যেই ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করেছেন।
এঁদের সবাইকে উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানীর বিনিময়ে যদি সুপরিকল্পিতভাবে, সত্যিকার পেশাদারত্বের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি অনুবাদ প্রকল্পে যুক্ত করার কথা ভাবা যায়, তাহলে অবশ্যই সেটি আমাদের সাহিত্যের জন্য সুনাম ও সুফল বয়ে আনবে।
তবে বলা বাহুল্য, এটি কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়। এর পেছনে অবশ্যই রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক উদ্যোগকে ক্রিয়াশীল হতে হবে। আমাদের দেশে বাংলা একাডেমি, মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থাসমূহ ইত্যাদির সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগেই কেবল এ ধরনের একটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প গ্রহণ ও তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এর জন্য সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে আলাদা সেল গঠন করে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটির তত্ত্বাবধানে সেটি পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রকাশনাসংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, যোগাযোগ রক্ষা ও বৈশ্বিক বিধিবিধান পালনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্তিও থাকা দরকার এই প্রকল্পের সঙ্গে। এছাড়া বিশ্বের বৃহত্তর সাহিত্যিক সমাজ ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, প্রকাশকদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন, উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
পাশাপাশি নিজেরাও, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নিয়মিতভাবে নানাবিধ সাহিত্য উৎসব, সম্মেলন, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিখ্যাত লেখক, প্রকাশক, অনুবাদক, সমালোচক, সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে তাঁদের সঙ্গে ভাব বিনিময় ও কার্যকর সৃজন-সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
মোদ্দাকথা এ-ই যে, আমরা সবাই জানি আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দীর্ঘ ও গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে, রয়েছে গর্ব করার মতো অনেক অর্জনও। কিন্তু সেই ঐতিহ্য ও অর্জনকে শুধু পুরস্কারপ্রাপ্তির আশায় নয়, সাধারণভাবেই বিশ্বের দরবারে পরিচিত করানো, বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা বিশাল ও উৎসুক ভোক্তাশ্রেণির কাছে পৌঁছানো আর তার ভেতর দিয়ে জগৎকে আমাদের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি, মূল্যবান মানস ঐশ্বর্যের বার্তা দেওয়ার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে দেশের সত্যিকার ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্য হলেও এমনিতরো এক মহান কর্মযজ্ঞ শুরু করা এখন সময়ের দাবি। বৃহৎ বিশ্বের এই ডাকে সাড়া দিতে না পারলে বৌদ্ধিকভাবে আমরা নির্ঘাত পিছিয়ে পড়ব আরও, আচ্ছন্ন হতে থাকব আরও বেশি কূপমণ্ডূকতায়, আমাদের আত্মবিশ্বাস ক্রমে গিয়ে তলানিতে ঠেকবে। এবং প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময় ঘনিয়ে এলে এহেন অর্থহীন, অন্তহীন বাকবিস্তার ও আত্মনাশা আহাজারিতেই আমাদের ব্যস্ত থাকতে হবে কেবল।