বাইরে কোনো অভিযোগ না থাকলেও ঘরে আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ—আমি নাকি একটা মশাও মারতে পারি না! অভিযোগ গুরুতর! খানিকটা অপমানজনকও বটে! আমি পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলি, ‘যে মানুষ বাঘ-সিংহ শিকার করার ক্ষমতা রাখে, সে কেন মশা-মাছির মতো নগণ্য প্রাণী হত্যা করবে!’
তা ছাড়া আজকাল মশা-মাছি মারা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার! নানা রকম হিসাব-নিকাশ করে হাত চালাতে হয়। আমি থাকি উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় শেষ সীমান্তে। পাশেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। উত্তরের হাওয়া যায় দক্ষিণে। দক্ষিণের হাওয়া আসে উত্তরে। হাওয়ার মতো মশারাও চলাফেরা করে অবাধে। হাওয়ার মতো মশাদেরও কোনো রকম বর্ডার সেন্স নেই। সুতরাং বাসায় যেসব মশা-মাছি ঘুরে বেড়ায়, সেগুলো উত্তরের না দক্ষিণের মশা, নিশ্চিত হতে পারি না। গায়ের বর্ণ, চেহারা—দেখতে সবই একই রকম। প্রায়ই বিভ্রান্ত হই। উত্তরের বাসিন্দা হয়ে দক্ষিণের মশা মারা উচিত না! তাই হাত গুটিয়ে রাখি।
আমি মশাবতা (মানুষের জন্য যেমন মানবতা তেমনি মশাদের জন্য মশাবতা!) দেখানোর চেষ্টা করলেও মশা অবশ্য তা করে না। সুযোগ পেলেই কামড়ায়। যত্রতত্র কামড়ায়। যখন-তখন কামড়ায়।
দেশে এখন ডেঙ্গুর মৌসুম চলছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ছড়াছড়ি। বিকেল হলেই সিটি করপোরেশনের লোকজনকে দেখি টিনের চোঙায় ধোঁয়া ছাড়েন। তাতে মশাদের কিছু হয় কি না, জানি না। তবে আমাদের অনেক সময় বাসার রাস্তা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে পুরো এলাকা। এক হাত সামনের কিছুও তখন আর ভালোভাবে দেখতে পাই না।
যুগ যুগ ধরে নির্বাচনের আগে নগর পিতারা মশা নিধনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মশা-মাছি কতটা ত্যাঁদড় প্রকৃতির প্রাণী, সেটা বলা বাহুল্য। সুতরাং একদিকে মশা নিধনের চেষ্টা যেমন চলে, তেমনি অন্যদিকে মশাদের টিকে থাকার চেষ্টাও চলে সমানতালে। আর এভাবেই দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে বহুকাল ধরে। শেষতক মশা-মাছিই যেন বিজয়ের হাসি হাসে! তাই আমরা ডেঙ্গুতে ভুগি, ম্যালেরিয়ায় ভুগি, চিকুনগুনিয়ায় ভুগি। কখনো কখনো টিকে যাই, কখনো আবার বেঘোরে প্রাণ হারাই!
কর্তৃপক্ষের অপেক্ষায় না থেকে মাঝে মাঝে আমরা তাই আইন নিজের হাতে তুলে নিই! মশা মারার ব্যাট হাতে পাল্টা আঘাতের চেষ্টা করি। ব্যাট হাতে ‘আজ মশার একদিন কি আমার একদিন’ মনোভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াই এ-ঘর থেকে ও-ঘর। ও-ঘর থেকে আবার এ-ঘর। দু-একটা নজরে পড়লেই আর রক্ষা নেই। অমনি কষে ব্যাট চালাই। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধা করতে পারি না। ঠিক ফসকে যায় বজ্জাত মশা। ব্যাট রেখে একসময় কয়েল জ্বালাই। তবু ওদের পুরোপুরি ঘায়েল করতে পারি না। স্প্রে করার পরও দেখি বেয়াড়া মশা দিব্যি ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে। আমাদের গান শোনায়। সুর, তাল, লয়—কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই।
কালে কালে মশার উৎপাতে ত্যক্তবিরক্ত হয়েছেন বহু কীর্তিমান মানুষ। মশার কাছে সবাই সমান। বিখ্যাত-কুখ্যাত কারও মাফ নেই। সবাইকে সমানতালে কামড়ায়। তাই যুগে যুগে মশা নিয়ে কলম চালিয়েছেন অনেক কীর্তিমান মানুষ। আমার কথা থাক। নিজের কথা বেশি বলা ঠিক না। মশার কামড়ে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে স্বয়ং অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন—মশায়!/দেশান্তরী করল আমায়/কেশনগরের মশায়!...মশা!/ক্ষুদ্র মশা!/মশার কামড় খেয়ে আমার-/স্বর্গে যাবার দশা!.../একাই যুদ্ধ করি/এ-হাতে ও-হাতে/দু’হাতেরই চাপড় বাজে/নাকের ডগাতে।/একাই/মশার কামড় নিজের চাপড়/কেমন করে ঠেকাই।.../কোন নগরের মশার সাথে/তুলনা কার চালাই?
এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের জীবনসঙ্গী হয়ে বহাল তবিয়তে টিকে আছে মশা-মাছি। আমরা ছাড়তে চাইলেও ওরা আমাদের ছাড়ে না। ঘরে-বাইরে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় রক্তচোষা ত্যাঁদড় মশা। চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, পকেটমার, মলম পার্টি—সবার কাছ থেকে নিস্তার পেলেও মশা থেকে যেন আমাদের কিছুতেই নিস্তার নেই।