বইমেলায় প্রতিদিনই আসছে নতুন বই। আর বইয়ের বাজারে প্রচ্ছদেও আছে নানান রকমফের। মূলত বই একটি পণ্য ও প্রচ্ছদ হলো এর মোড়ক। প্রচ্ছদ যত আকর্ষণীয় হবে পাঠক ততই বইটি পড়তে আগ্রহী হবে। একটি বইয়ের অর্থপূর্ণ প্রকাশ ঘটে সৃজনশীল প্রচ্ছদের মাধ্যমে।
এছাড়া লেখক-প্রকাশক-প্রচ্ছদশিল্পীর দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল সুন্দর একটি বই। তাই তো এবারও অমর একুশে বইমেলায় অসংখ্য বইয়ের মধ্যে সৃজনশীল প্রচ্ছদের চাহিদায় বেশি। পাশাপাশি বইকেনার ক্ষেত্রে পাঠকের নজর সুন্দর প্রচ্ছদের দিকে।
বইমেলায় মায়ের সঙ্গে বই কিনতে এসেছেন একাদশ শ্রেণির ছাত্রী তাসনুভা আক্তার তন্নী। প্রতিবছরই পছন্দের লেখকের পাশাপাশি নতুন লেখকের বই পড়তে ভালোবাসেন তন্নী। তবে বই কেনার আগে প্রচ্ছদ বা মলাটেই আগে নজর পড়ে তার।
তাসনুভা আক্তার তন্নী বলেন, “সাধারণত গল্পের বই পড়তে পছন্দ করি। তবে নতুন লেখকের বই সংগ্রহের আগে প্রচ্ছদের দিকেই মনোযোগ আগে থাকে। সুন্দর একটি প্রচ্ছদ দেখেই বই পড়তে আগ্রহী হই।”
এদিকে বান্ধবীকে সঙ্গে করে মেলায় এসেছে শিক্ষার্থী তানিশা। রাজধানীর সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এই শিক্ষার্থীর প্রথম আকর্ষণ থাকে বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে।
এ সময় বই কেনার ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি গুরুত্ব দেন জানতে চাইলে তানিশা বলেন, “বই কেনার ক্ষেত্রে বইয়ের প্রচ্ছদ বা মলাট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের মলাট দেখেই মানুষ আগ্রহী হয় বই কিনতে। কারণ বইয়ের মলাট যত সুন্দর হবে ভেতরের গল্প তত সুন্দর হবে।”
মেলায় এ বছর তিনটি বই প্রকাশ পেয়েছে সাহাদত হোসেন খানের। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত ৫০টির অধিক বই পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। বই লেখা এবং প্রচ্ছদের ব্যাপারে অনেক যত্নশীল তিনি। শুধুমাত্র বইয়ের প্রচ্ছদের শৈল্পিক সীমাবদ্ধতার কারণে গতবছর তার রচিত তিনটি বইয়ের চাহিদা কম ছিল বলে মনে করেন তিনি।
তবে পরবর্তী সংস্করণে বইয়ের প্রচ্ছদ পরিবর্তন করেই বেশ সাড়া পেয়েছেন বলে জানান এই লেখক।
লেখক সাহাদত হোসেন খান আরও বলেন, “মুখ যেমন মানুষের মূল পরিচয় বহন করে, তেমনি প্রচ্ছদ একটি বইয়ের মূল পরিচয় বহন করে। বইয়ের মানের প্রশ্নে প্রচ্ছদ কিন্তু পরিবর্তন করা হয়। লেখার বিষয় যতই ভালো হোক না কেন, প্রচ্ছদ কিন্তু ভালো হতে হবে। কারণ একজন পাঠক প্রথমে একটি সুন্দর বই নির্বাচন করবে, তারপর বইটা পড়বে। তাছাড়া যারা নতুন পাঠক তাদের কাছেও বইয়ের সুন্দর প্রচ্ছদ একটা বড় ভূমিকা রাখে। লেখক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদশিল্পীর দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল একটি ভালো বই। কাজেই প্রচ্ছদে মার খেলে বই কিন্তু সেখানেই শেষ।”
এই লেখক আরও বলেন, “বই কিন্তু একটি ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। অনেকে সাজিয়ে রাখার জন্য বই কেনেন। একটি সুন্দর বই ঘরের আলমারিতে থাকবে সেক্ষেত্রেও প্রচ্ছদের ভূমিক আছে। সৌন্দর্যের জয় সর্বত্র। কাজেই এর কোনও বিকল্প নেই।”
‘কিংবদন্তী’ প্রকাশনালয়ের প্রকাশক অঞ্জন হাসান পবন বলেন, “একটা প্রচ্ছদ যদি পাঠকের মনের মধ্যে দোলা দিতে না পারে বা প্রচ্ছদ যদি পাঠক মনে কৌতুহল সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে পাঠক আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ওই জায়গা থেকে প্রচ্ছদের মান উন্নয়ন অনেক জরুরি।”
এদিকে বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টু। বরাবরের মতো এবার একুশে বইমেলায় নান্দনিক প্রচ্ছদ করে লেখক-প্রকাশকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। এ বছর প্রায় আটশ থেকে নয়শ বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন এই প্রচ্ছদশিল্পী।
বই বিক্রিতে প্রচ্ছদের ভূমিকা কতটুকু, জানতে চাইলে প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টু বলেন, “ব্যক্তিমানুষের সৌন্দর্যের জন্য যেমন পোশাক প্রয়োজন। তেমনি একটি সুন্দর বইয়ের জন্য প্রয়োজন সুন্দর প্রচ্ছদের। প্রচ্ছদের নান্দনিকতা বইয়ের নতুন মাত্রা যোগ করে। প্রচ্ছদ ও অলংকরণের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। অলংকরণ হচ্ছে বিষয়ের প্রতিরূপ, অর্থাৎ যা লেখক অক্ষরে বলে তারই চিত্রিত রূপ অলংকরণ। আর প্রচ্ছদ হচ্ছে একটি লেখার অন্তর্গত ভাষা। এখন শিল্পী কতটা সৃজনশীল চিন্তায় লেখাটির প্রচ্ছদ করবে সেটা তার দক্ষতা ও শিল্পচিন্তার ওপর নির্ভর করে।”
প্রচ্ছদ তৈরিতে কোন বিষয় ভাবনা মাথায় থাকে, জানতে চাইলে প্রচ্ছদশিল্পী চারু বলেন, “সমগ্র বইকে প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। প্রচ্ছদের ভাষাটা কতটা নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটাই শিল্প। সেক্ষেত্রে আমি বইটির সাব-টেক্সটের দিকে গুরুত্ব দিই। লেখকের বক্তব্য বা ভাবনা সরাসরি উপস্থাপন না করে, লেখার অন্তর্নিহিত ভাবটি চিত্রের আকারে প্রকাশ করার চেষ্টা করি।”
মোস্তাফিজ কারিগর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন প্রচ্ছদশিল্পী। প্রচ্ছদের বাণিজ্যিক গুরুত্বের কথা জানতে চাইলে এই শিল্পী বলেন, “বই যখন বাজারে আসে এক অর্থে সেটি তখন পণ্য। সেক্ষেত্রে বইয়ের মোড়ক বা প্রচ্ছদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বই যেহেতু আমাদের শিল্পচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন। কাজেই বইয়ের কাভারটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রচ্ছদটি নান্দনিক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পুরো লেখাটি প্রচ্ছদের থাকবে বিষয়টি তেমন নয়। তবে সম্পূর্ণ বইটাকে যেনও প্রচ্ছদ উপস্থাপন করে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রচ্ছদের সঙ্গে বইয়ের একটি আত্মিক সম্পর্ক থাকতে হবে।”