লতাজি কিসের ভিত্তিতে, কোন অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে গাইলেন ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে...!’ জানি না। তবে আমার অধিকাংশ প্রেমই এসেছিল সরবে, বৃষ্টিদিনে ‘ঠাডা’ পড়ার মতো ভয়ানক শব্দে। মানুষের জীবনে মাত্র একবার প্রেম আসবে, তা-ও আবার নীরবে—এটাকে আমি প্রেমের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার হিসেবেই দেখি। বড় মানুষের প্রেম এমন হয় নাকি, চোখের জলে পরাজয়! লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ না পাওয়ায় প্রশ্নটা করা হয়নি কখনো। তাঁকে জানাতে পারিনি প্রেমে পড়ে ও প্রেমে পড়িয়ে আমি কাঁপায়া দিছি, ফাটায়া দিছি। নিজেও চিত্তিছান হয়ে গেছি বারবার!
প্রেম বরাবরই আমার কাছে এসেছে বজ্র-দামামা বাজিয়ে, রণসংগীত রূপে। গ্রামাঞ্চলের মুরগি লেখক ও নেট বইয়ের সেই পসার ও প্রচার থাকলে বিশ টাকা মূল্যের একটা পাণ্ডুলিপিই রচনা করে ফেলতে পারতাম— ‘হাইস্কুলের দিনগুলোতে প্রেমের কুরকুরানি’। সেটা আর সম্ভব নয়। আমাদের অনেক ঐতিহ্যই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ফলে হারিয়ে গেছে কম দামে জীবনঘনিষ্ঠ প্রেমের উপন্যাস পড়ার সুযোগ। এমন আক্ষেপ ও বিতং বর্ণনায় না গিয়ে সরাসরি প্রেমাখ্যানে চলে যাই। তাতে প্রেমপিয়াসীদের ধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কা থাকে না। নিজেও এসব বলে বুক হালকা করি কিংবা আরও ভারী হই।
আমাদের এ উচ্চবিদ্যালয়ের অন্যতম আতঙ্ক মোয়াজ্জেম স্যার। বালক-বালিকার কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা। স্যার ক্লাসে ঢুকেই সব ছাত্রছাত্রীর চোখের দিকে তাকান একবার করে। এতেই বুঝে ফেলেন কে পড়া পারবে, আর কে শিখে আসেনি। তাই বেছে বেছে অবল ও অবলাদেরই লজ্জা দেন। সেদিন ক্লাসে ঢুকে প্রাথমিক জরিপ চালিয়ে মিশাইল হানলেন লাস্ট বেঞ্চের অবগুণ্ঠিতার দিকে—এই খাদিজা, ২২-এর নামতা ক।’
হতচকিত আমরা সবাই—বইয়ে তো ২২-এর নামতা নেই! খাদিজা সেই সংশয়ে গেল না। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বই খুলে পড়া শুরু করল—৭ এক্কে ৭, সাত দু’গুণে ১৩...। কাঁপা কাঁপা হাতে বই নিয়ে পড়ার কারণেই কি না জানি না—পৃষ্ঠা ভেদ করে নিচে পড়ল পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি। মোয়াজ্জেম স্যারের নজর এড়াল না। ৮৭-এর নামতা জপতে জপতে তিনি যেই এসে মেঝে থেকে তুলে নিলেন ছবিটা। পরক্ষণেই হুঙ্কার ছাড়লেন—মাজহারের ছবি তোর কাছে ক্যান? কী করিস এটা দিয়া?’
বাকি ১২৪ জন শিক্ষার্থীর ২৪৮টা চোখ নিবদ্ধ হলো খাদিজার দিকে। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়েছে প্রথম দফাতেই। ছবিটা তো রেখেছি জ্যামিতি বক্সের ভেতরে। চোরনি খাদিজা কখন নিয়ে গেল!
ও মা, এ যে দেখছি চোরের বড় গলা! স্যারের বাক্যবাণে ভীত না হয়ে খাদিজা বলে উঠল, ‘আমি মাজহারকে লাভ করি।’
‘কী কস তুই! ছবি দিয়া কী লাভ-লস অয়?’
‘লাভ করলে সাথে ছবি রাখতে হয়, স্যার।’
সবার চোখ এবার আমার দিকে। যেন আমিই গন্ডগোলের মূল। সে দৃষ্টি পরক্ষণেই ঘুরে গেল খাদিজার দিকে। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে একটি ভিউকার্ড বের করল খাদিজা। উঁকি দিলেন সুদর্শন মিঠুন চক্রবর্তী।
স্যার বললেন, ‘এটার কাহিনি কী?’
‘আমার বিদেশি প্রেমিক। যদিও বাপের বয়সী, তাতে কী—নায়ক তো! আমির খানের ছবিও ছিল।’
‘বুঝছি। ছবি নিয়া থাকলে নামতা শিখবি ক্যামতে?’
‘আমি প্রেমের নামতা পারি, স্যার।’
‘ক দেখি, মহাজ্ঞানদায়িনী।’
‘এক এক্কে এক
আমায় চেয়ে দেখ
দুই এক্কে দুই
সাথি আমার তুই
তিন এক্কে তিন
মনে রাখিস চিরদিন
চার এক্কে চার
তোকে বলব কী রে আর...।’
নামতা কিসের—এ যে বাংলা সিনেমার গান। পপির কণ্ঠে শুনে শুনে তার প্রেমে পড়েছি কতবার! বারো মাসের নামতাও গানে গানে মুখস্থ ‘কুলি গার্ল’ পপির—
জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি
মন চায় প্রেমে পড়ি
মার্চ মাসেও পাইলাম না রে
মন-মানুষের দেখা
এপ্রিলও যায় রে চলে
এখন কী করি...।
বারো মাসের নাম গানটি থেকেই শিখেছি। আমাদের শৈশবে ভিউকার্ড বিক্রি হত হাটে-মাঠে। বিনোদনপিয়াসী ফেরিওয়ালারাও ছিল তৎপর। আমার সংগ্রহে পপির পাশাপাশি ছিল শাবনূর, মৌসুমী, পূর্ণিমার ভিউকার্ড। আরও ছিল মাধুরী দীক্ষিত, জুহি চাওলা, কারিশমা কাপুর। রঙিন সব ছবি, মনকাড়া। সংগোপনে লুকিয়ে রাখতাম। মন আনচান করে উঠলে বাবা-মা-আপুর চোখ বাঁচিয়ে দেখতাম। দেখতে দেখতে নেশা ধরে যেত। কিন্তু আজ খাদিজা আমাকেই ভিউকার্ড বানিয়ে দিল!
কী অপরাধ করেছিলাম জানি না, সেদিন মোয়াজ্জেম স্যার তিনটা বেত ভেঙেছিলেন। দুইটা খাদিজার পিঠে, একটা আমার হাতে। স্কুলের পাশেই বাগান। সেখান থেকে বেত সংগ্রহ করে আনতে বলেছিলেন স্যার। এনেছিলাম নিরীহ গাছের ডাল ভেঙে। আমার আনা বেত দিয়ে আমাকেই পেটানো হবে জানলে ওখান থেকেই দেয়াল টপকে পালাতাম। বিশ্বে মানবাধিকার ও প্রেমাধিকার না থাকার কারণেই বোধ হয় এমন ঘটনাও ঘটে। সেদিন মনে মনে খাদিজা ও স্যার দুজনকেই অভিশাপ দিয়েছিলাম। শকুনের দোয়ায় গরু মরতে পারে, নির্দোষ বালকের বদদোয়ায় প্রেম নিপাত যায় না।
তিন মাস পরে এলো আরও বড় বিপদ। তদ্দিনে আমরা আরও এক ক্লাস ওপরে উঠে গেছি। খাদিজা পরীক্ষায় ফেল করায় নিচের ক্লাসেই রয়ে গেছে। নতুন ক্লাসে পেলাম নতুন শিক্ষকও। নেয়ামত স্যার পড়াচ্ছেন ‘এইম ইন লাইফ’। বড় হয়ে আমরা কে কোন হাতি-ঘোড়ায় চড়ব, রাজা-উজির মারব—এমন বয়ান দিচ্ছি। এর মধ্যে পিংকি দত্ত দাঁড়িয়ে বলল—‘স্যার, আমার জীবনের লক্ষ্য মাজহারুল আলমের বউ হওয়া।’
অবাক স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘সে আবার কে?’
পিংকি আঙুল উঁচিয়ে আমাকে দেখাল। স্যার জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘মাজহার, দাঁড়াও।’
অধোবদনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘স্যার, আমার কোনো দোষ নেই। আমি কাউকে বিয়েও করতে চাই না।’
‘তাহলে কার দোষ?’
‘পিংকির।’
রোষানল থেকে বাঁচার জন্য বললাম পিংকির নাম। পেছন থেকে পড়া না-পারা ছাত্র আজমল বলে উঠল, ‘কেন, খাদিজা কিছু করেনি? ছবির কথা ভুলে গেছিস?’
চারদিকে হাসির রোল উঠলে স্যার আবার ধমকালেন। হাসি থামলেও চাপা স্বর থামল না। যেন আমিই ভিলেন! ভিসিআর-পরবর্তী যুগে স্যাটেলাইটে—ডিশ সংস্কৃতিতে বিস্তর বাংলা-হিন্দি সিনেমা আমরা দেখেছি। অকালে আমাদের পাকিয়ে দেওয়ার জন্য এসবই যথেষ্ট। কিন্তু পিংকিটা বেশি পেকেছে। নইলে কারও জীবনের লক্ষ্য হতে পারে অন্য একজনের বউ হওয়া! এটা তো এমনিতেই হয়ে যাবে; যেভাবে সিনেমার শেষ দৃশ্যে নায়ক কর্তৃক ভিলেনের পরাজয় ঘটে। তিন ঘণ্টা টানা মার খাবে, শেষ দৃশ্যে অসুর বিনাশ করবে।
যেহেতু ‘অকালপক্ব’ ফুটনোটের বিষয়টা আগেই ফাঁস করে দিই। স্কুলে কি এমন অঘটন, অলুক্ষণে কাণ্ড ঘটে—ছেলেমেয়েরা পারে এসব করতে! এমন প্রশ্ন যদি কারও মনে জাগে; গল্পকথনকে কষ্টকল্পনা হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান, তারা ‘আধুনিকতা’ ও ‘চলতি হাল’ থেকে পিছিয়ে। সমাজ-সংস্কৃতি পাল্টাতে শুরু করেছে অনেক আগ থেকেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রেম আসতে যৌবনকাল লাগে না। মনের যৌবনই প্রকৃত যৌবন! সেখানে এখন চিরবসন্ত।
নেয়ামত স্যার সজোরে বেতের বাড়ি মারলেন টেবিলে। ক্লাসের ফিসফিসানি ও চাপা গুঞ্জন থামল। আমি তখনো দাঁড়িয়ে। স্যার বললেন, ‘মাজহার, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?’
‘যত দ্রুত সম্ভব এ স্কুল থেকে টিসি নেওয়া।’
‘কেন? স্কুলের দোষ কী!’
‘প্রেমের জ্বালা আর সইতে পারছি না, স্যার!’
পেছন থেকে আর্তনাদ করে উঠল পিংকি। বলল, ‘মাজহারের সাথে আমাকেও টিসি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, স্যার। একা থাকতে ভালো লাগবে না।’
স্যার টিসি না দিয়ে বেত্রাঘাত দিলেন। এখানেই শেষ নয়। ভরা ক্লাসে দুজনকে দুজনের দুই কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন ঝাড়া বিশ মিনিট। দুজনকেই শপথ করতে হলো—আমরা আর কখনো এসব করব না। ভয়ে ভয়ে বলেছি বটে, কিন্তু আমি কী করেছি! অবশ্য ‘করার’ সুযোগ এলো নতুন স্কুলে। টিসি নিয়ে ভর্তি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে মনের মধ্যে শুরু হলো আকুলিবিকুলি। সহপাঠিনী তৃষ্ণাকে ভালো লাগতে শুরু করে। ও যেখান দিয়ে পায়ের ছাপ ফেলে হাঁটে, চেষ্টা করি নিজের পদচ্ছাপ সেখানে বসিয়ে হাঁটতে। তাতে অন্যরা মনে করতে শুরু করল, আমার পায়ে সমস্যা আছে। কিন্তু আমি তো জানি, সমস্যাটা মনে! বসন্ত আসার আগেই চোখে ক্রমাগত হলুদ দেখি। মনে-বুকে তীব্র মোচড় হঠাৎ হঠাৎ। খোঁজ নিয়ে জেনেছি তৃষ্ণা থাকে সহপাঠী মতির বাসার পাশেই। মতিকে পাকড়াও করে খুলে বলি হৃদয়ের কথা। সে বরাভয় দিয়ে বলল— ‘আরে বেডা, ডরাইস না। ও তো আমারই!’
‘তোর! তাহলে আমি নাই?’
‘কইলাম তো চিন্তা লইস না। আমার মানে তৃষ্ণা আমার কতা হুনে। ওর মা-ও হুনে। গতকাইল তো ওগোরে বাজার কইরা দিলাম। তৃষ্ণার বাপ বিদ্যাশে থাকে। বাহরাইনে।’
সান্ত্বনা পাই এমন আশ্বাসে। মতি বুদ্ধি দেয়, একদিন ক্লাস কামাই দিয়ে গোলাপ ফুল কিনে নিয়ে ওদের মহল্লায় গিয়ে দাঁড়াতে। ও তৃষ্ণাকে বুঝিয়ে বলবে। নিয়ে আসবে আমার কাছে। আমি ফুলটা তুলে দেব তৃষ্ণার হাতে। এরপর কাছে বা দূরে কোথাও দুজন মিলে ঘুরতে যাব। পরিকল্পনা তো ভালোই। আশায় বুক বেঁধে গোলাপ কিনে এনে দাঁড়ালাম উপগলিতে। কাল রাতে বাবার পকেট থেকে চুরি করেছি ৩০০ টাকা। ধারে-কাছে কোথাও বেড়াতে গেলে এ টাকাতেই হয়ে যাওয়ার কথা।
বিধি বাম, দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে মতি এলো। বলল, ‘দোস্ত, ঘটনা খারাপ। তোর কতা কওনের পর তৃষ্ণা কইল—কাইল্যা পোলাডার কতা কইতাছস থো? আমি কইলাম, হ মাজহার। এরপর তৃষ্ণা কইল—ওরে গিয়া কইস, জুতা আর ঝাড়ু দিয়া পিডামু।’
প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তির কী চপেটাঘাত! মতিকে বললাম, ‘তাহলে এখন কী করব?’
‘কান্দিস না। বাসায় যা, নইলে ক্লাসে যা। পকেটে টাকা থাকলে চা দোকানে বইসা সিনেমাও চাইবার পারস।’
‘তৃষ্ণা-মনিকে আরও একবার বোঝাবি না? একবার না পারিলে দেখ শতবার।’
‘না। খুব রাগী। তাইলে যেইডা কইছে হেইডা কইরাই ছাড়ব!’
তৃষ্ণার্ত বুকে তৃষ্ণা ও মতির এমন বিশ্বাসঘাতকতা! আমার হৃদয় ভেঙে গেল। কাছে কোনো দোকানে কেউ একজন রেডিও বা চেইঞ্জারে গান বাজাচ্ছে—আমি পৃথিবীর এই বুকে আগুন লাগিয়ে দেব/ যদি তুমি আমারই না হও...।
জীবনে আরও প্রেম এসেছিল বজ্রপতনের শব্দ নিয়ে। কোনোটাই আমার হয়নি। নানান জায়গায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরেছি খাদিজার কাছে, পিংকির কাছে। তারাও ফিরিয়ে দিয়েছে। হৃদয় সমীপে স্থান হবে না। দুজনের কেউই এখন একা নয়! আমাকে দুই নম্বর প্রেমিক হিসেবে রাখতেও তারা নারাজ। কী দিনকাল আইল—আমার বিলাই, আমারে কয় ম্যাও।
আমি একা, বড় একা, আমার আপন কেউ নেই...।