আমরা বঙ্গবন্ধু বললে বুঝি শেখ মুজিবুর রহমানের কথা, মহাকবি বললে বুঝি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নেতাজি বললে বুঝি সুভাষচন্দ্র বসু, বিশ্বকবি বললে বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু বললে চিত্তরঞ্জন দাস, চারণ কবি বললে মুকুন্দ দাস, বিদ্রোহী কবি বললে কাজী নজরুল ইসলাম, কাকাবাবু বললে কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ, বিপ্লবী কবি বললে বুঝি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে। তেমনি গণমানুষের কবি বললে বুঝি কবি দিলওয়ারকে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে এক নাগরিক সংবর্ধনায় কবি দিলওয়ারকে গণমানুষের কবি অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়। কবি দিলওয়ারের পারিবারিক নাম দিলওয়ার খান। সিলেট জেলার খিত্তা পরগনার ভার্থখলা গ্রামের সম্ভ্রান্ত খান বংশে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি কবি দিলওয়ার জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ হাসান খান এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ রহিমুন্নেসা। ঝালোপাড়া পাঠশালা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট রাজা জি সি হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট এম সি কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে হয়।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র আট বছর বয়সে কবি দিলওয়ারের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের দশম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় রাজা জি সি হাইস্কুলের একজন প্রগতিশীল শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় লেখালেখির উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। তার লেখা ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’ দৈনিক ‘যুগভেরী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘জিজ্ঞাসা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যে পথচলা শুরু। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা হাইস্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। মাত্র দুই মাস শিক্ষকতা করার পর শুরু হয় তার সাংবাদিকতার জীবন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দৈনিক ‘সংবাদ’ এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ‘সমস্বর’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রকাশিত মাসিক ‘উদয়ন’ পত্রিকার সিনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ‘উল্লাস’, ‘মৌমাছি’, ‘গ্রাম সুরমার ছড়া’, ‘মরুদ্দ্যান’, ‘সময়ের ডাক’, ‘সিলেট পরিদর্শক’ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
কবি দিলওয়ার সিলেট বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনী সংগীতের গীতিকার। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তার লেখা ‘তুমি রহমতের নদীয়া’ গানটি সম্মিলিত কণ্ঠে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণ-আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সিলেটের কবি-সাহিত্যিক সাংবাদিকদের নিয়ে গঠন করেন ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’। এই সংস্থাটি সিলেটে স্বাধীনতা আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধেও কবি দিলওয়ারের ভূমিকা অনন্য। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের তিনি প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক। তিনি সিলেট খেলাঘর ও সিলেট উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার নিজ গ্রামে ‘ভার্থখলা স্বর্ণালী সংঘ’ গড়ে তুলেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার লেখা একাধিক গান গাওয়া হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত একটি গানের আংশিক তুলে ধরা হলো—
আয়রে চাষী, মজুর-কুলি-মেথর-কুমার-কামার
বাংলা ভাষা ডাক দিয়েছে
বাংলা তোমার আমার।
এ পর্যন্ত কবি দিলওয়ারের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ ‘জিজ্ঞাসা’ (কাব্যগ্রন্থ)-১৯৫৩, ‘ঐকতান’ (কাব্যগ্রন্থ)-১৯৬৪, ‘পুবাল হাওয়া’ (গানের বই)- ১৯৬৫, ‘উদ্ভিদ উল্লাস’ (কাব্যগ্রন্থ)- ১৯৬৯, ‘বাংলা তোমার আমার’ (গানের বই) -১৯৭২, ফেসিং দি মিউজিক, (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ) ১৯৭৫, ‘স্বনিষ্ঠ সনেট’ (কাব্যগ্রন্থ)- ১৯৭৭, ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ (কাব্যগ্রন্থ)- ১৯৮১, ‘বাংলাদেশ জন্ম না নিলে’ (প্রবন্ধগ্রন্থ)- ১৯৮৫, ‘নির্বাচিত কবিতা’ (কাব্যগ্রন্থ)- ১৯৮৭, ‘দিলওয়ারের শতছড়া’ (ছড়ার বই) ১৯৮৭, ‘দিলওয়ারের একুশের কবিতা’ (কাব্যগ্রন্থ)-১৯৯৩, ‘দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা’ (কাব্যগ্রন্থ)-১৯৯৩, ‘ছড়ায় অ-আ-ক-খ’ (ছড়ার বই) ১৯৯৪, ‘দিলওয়ারের রচনাসমগ্র’ (১ম খণ্ড)১৯৯৯, ‘দিলওয়ারের রচনাসমগ্র’ (২য় খণ্ড) ২০০০, ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ডাকে’ (ভ্রমণ স্মৃতি) ২০০১, ‘স্বপৃথিবী রইবো সজীব’ (কাব্যগ্রন্থ)- ২০০৪, ‘দুইমেরু দুইডানা’ কাব্যগ্রন্থ ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে কবি রোগাক্রান্ত হয়ে যখন হাসপাতালে শায়িত ছিলেন তখন তার শয্যাপাশে যে সেবিকা মহীয়সী নারী তাকে সেবা দিয়ে রোগমুক্ত করেন, সেই আনিসা খাতুনকেই কবি জীবনসাথি হিসেবে বরণ করেন এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সেই মহীয়সী নারী কবির জীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। কবির কথায় ‘আনিসা ছিলেন ঝড়ের রাতের অভয়দাত্রী, বিশল্যকরণী’। কিন্তু জীবনে আবার এলো ঝড়ের রাত। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ ৩ ছেলে ৩ মেয়ে রেখে সেই ঝড়ের রাতের অভয়দাত্রী, বিশল্যকরণীর সাথে কবির চিরবিচ্ছেদ ঘটে।
অতঃপর আনিসা দিলওয়ারের চতুর্থ বোন ওয়ারিসা খাতুন অভয়ধাত্রীর সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে কবির শূন্যহৃদয় পরিপূর্ণ করে তুলেন। কবির বর্ণনার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো—আনিসার অকালমৃত্যু আমার কবি জীবনকে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টিতে বিপর্যস্ত করতে পারত যদি না বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে তার প্রিয়তম বোন ওয়ারিসা এগিয়ে আসত।
অলৌকিকতা বলে একটি শব্দ আছে, যে শব্দটি একাধারে মরুভূমি ও তৃষ্ণাঞ্চলের অর্থ বহন করে। আপাদমস্তক সুশিক্ষিত ও সুমার্জিত চেতনার অধিকারিণী ওয়ারিসা মাতৃহারা তিন পুত্র তিন কন্যাকে যেভাবে ব্যাকুল বাহুমেলে বুকে তুলে নিয়েছিল। আর সেই অভাবনীয় আচরণ অলৌকিকতার একখণ্ড তৃণাঞ্চল রূপেই আমার তৃতীয় দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল।
ওয়াসিয়াও কবিকে ছেড়ে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে কবি দিলওয়ারের প্রিয় পুত্র এবং তার যোগ্য উত্তরসূরি কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের অকালমৃত্যু হয়। এত সব মৃত্যুকে সাথে নিয়ে তিনি গণমানুষের মাঝে জীবনের ঠিকানা খুঁজেছেন।
কবি দিলওয়ারকে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাবব্দে সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সাহিত্যক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ফেলোশিপ প্রাপ্তি, ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আবুল মনসুর সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনস্থ সিলেট সেন্টারের গণসংবর্ধনা পান। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য একুশে পদক পান।
রাষ্ট্র যদি এইসব মুক্তচেতনার মানুষগুলোকে সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে পুরস্কার কিংবা সংস্কৃতি যাই দেওয়া হোক মুক্তচেতনা’র বিকাশ সম্ভব হতে পারে না। কল্যাণকর সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না। এই উপমহাদেশের মাটিতে দত্ত কবি মাইকেল অনাদর ও অবহেলার শিকার হয়ে দাতব্য চিকিৎসালয় মৃত্যুবরণ করেছিল। নজরুলকে জীবিত অবস্থায় আমাদের রাজধানী ঢাকায় লাঠিপেটা খেতে হয়েছিল। কাফের উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। আর গণমানুষের কবি দিলওয়ারকে দেওয়া পলিটিকাল পেনশন কর্তন করে দেয়া হয়। এরকম ঘটনায় প্রতীয়মান হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা মুক্তচেতনার অগ্রপথিকদের সুরক্ষা দিতে কতটা আগ্রহী। এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে দেশে কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের প্রাণ স্রোত বাধাগ্রস্ত, সেখানে স্বাধীনতা অর্থহীন।
গণমানুষের কবি দিলওয়ার ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার লোকান্তরিত হয়েছেন।