• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বপ্নতরী


স্নেহেন্দু পাল
প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২১, ০১:১৬ পিএম
স্বপ্নতরী

রঙিন তরীখানা মাঝি কবে যে ভাসায়েছিল গিয়াছে ভুলিয়া। কতকাল হতে সে কখনও আপনমনে ধরিছে হাল কখনও আপনবেগে টানিছে দাঁড় নদীরও বক্ষ চিরিয়া। জলজীবনেরে আপনও করিয়া চলিয়াছে সে স্রোতেরও ধর্ম মানিয়া। কখনও প্রয়োজনে কখনও বিশ্রামেরও কারণে থামিয়াছে তার তরীখানি ঘাট হতে ঘাটে। কখনও খাদ্য, কখনও নিত্য প্রয়োজনে নামিয়াছে সে বাটে। মানুষ জনে দৌড়ে আসিয়া দেখে তার তরীখানা। এমনও রঙিন তরী যে তারা দেখেনি কখনও  আগে। তাদেরই মধ্যে যারা ছিল প্রবীন, সব তারা বলে ওঠে কলরবে, দেখেছিনু এমনও তরী বিশ বৎসর পুবে। সচরাচর এমন রঙীন, এমন শোভাবর্ধনকারি তরী যায় না যে দেখা এদিকও পানে। তার সে অপূর্ব রঙিন প্রলেপ মস্ত আকারে, অন্দরের বিলাস গৃহে আর মূর্তিসহ জাফরির অলঙ্কারে দেহ যে তার আছে ভরে। গর্বিত হইয়া যেন সে আছে যে ভাসিয়া স্রোতেরও পরে। তারে      একবার দেখে যায় জনে জনে। গ্রামবাসী সব চমকিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে । দায় ফেরানো চোখ একই পলে।
এমনি এক ঘাটে মাঝি বেঁধেছিলো তার তরীখানি। ছিলো সেটা এক গঞ্জ বটে। মাঝি নামিয়াছিল তারই প্রয়োজনেরও তরে। ফিরিবারই পথে দেখে মাঝি এক নবীনা রয়েছে দাঁড়ায়ে তারই তরীরও পানে চাহিয়া, মোহিত যেন সে না পলক ফেলিয়া। মাঝি শুধায় তারে— লেগেছে ভাল মোর তরীখানি? নবীনা কহে— কহকি মাঝি এমনি তরী দেখেছি কী কভু। নয়নও মোর ধন্য আজই এমন দৃশ্য আস্বাদনে। শোভা বাড়িয়াছে মোদের গঞ্জেরও ঘাটে। এমনই করিয়া আলাপ ওঠে জমিয়া নবীনা মাঝিতে। গঞ্জেরও ঘাটে প্রতিদিন প্রতিপল কাটে গঞ্জ, তরী আর নদীরও গল্পে,  একে অপরের আদান প্রদানে। মাঝি ভুলিয়া গেছিলো কতদিন গেছে যে কাটিয়া এ গঞ্জেরও ঘাটে। শুধু ঘাটের আম্রকুঞ্জখানি রেখেছিল খোঁজ নীরবে তাদের।  কখন যে মধু গেছিলো জমিয়া পাইনিকো টের কেহ কাহারো পানে। শুধু অনুভবে গেছিলো বোঝা একটি দিনও যদি না হয় দেখা দুই মুখপানে কেমনে যেন  করে  হুহু দুই প্রাণময়।
একদিন নবীনা আসিয়া কহে মাঝিরে—  যাবে নিয়ে  আমারে তোমারই তরীতে?
স্তব্ধ মাঝি দুই দণ্ড থাকে দাঁড়ায়ে। ধীরে ধীরে কহে নবীনারে—  যাবো নিয়ে যদি চাও যেতে মোর অদৃষ্টে।
কিন্তু হায় কোথা থেকে যেন কালো ছায়া দেয় হানা  যুগে যুগে ভালোরও পরে। কেমনে যেন হয়েছে কানাকানি। জেনেছে সবাই নীরবে তাদের পলায়নেরও কথা। গঞ্জবাসিগণ জমায়েত হইয়াছে বিচারও চাহিয়া  ঘাটেরও আম্রতলে। ছিল যে সেথায় নবীনাও আর ছিলো তার অভিভাবকগণে। মোড়ল প্রশ্ন ছোঁড়ে মাঝিরে—  তুমি কি পারিবে রাখিতে ভালো ওরে?  পারিবে নিতে ভরণেরও সর্ব দায়িত্ব? মাঝি কয়— কেন নয়, নিশ্চয়ই পারিব। বেসেছি যখন ভালো তারে।
মোড়ল কহে কি কর হে ? কি তোমার আয়?
মাঝি কহে—  স্বপ্ন মোর পুঁজি আর   লক্ষ মোর  অতল অনন্তের পানে। যেথা জলরাশি অকৃত্রিম অস্থির অসীমেরও পরে।
এ শুনে নবীনা একবার চায় মাঝির মুখপানে।
মোড়ল কহে—  না এমনই অনিশ্চিত পানে পারিনা তারে দিতে ঠেলে। নির্দিষ্ট আয় না থাকিলে কেমনে ছাড়ব তোমারি হাতে। এ আশা করিতে হইবে ত্যাগ তোমারে। আরও কহে—   যদি তোমার প্রয়োজন যায় মিটে, তবে এ ঘাট তুমি শীঘ্রই যাবে ছেড়ে।   যেন দেখি নাই আর তোমারে এ প্রান্তেরও কোনো ঘাটে।
মাঝি কয়—  প্রয়োজন কী গেছে ফুরায়ে, অপ্রয়োজনই আজ হয়েছে বড় প্রয়োজনেরও আগে।
মাঝি নবীনারে জিগায়—  তোমারো কী একই মত? তুমিও কি দেবে সায় এদেরই পানে? মোদের ভালোবাসার নেই কি তবে কোনো মূল্য তব? কেন তবে বলেছিলে চলো নিয়ে মোরে তোমারি তরীতে! নবীনা থাকে চুপ। দেয় নাকো সাড়া ।    কোন  মন্ত্রবলে যেন সে হয়েছে বধির।  কিছুক্ষণ পর মাঝি কহে  তুমি কি এখনও থাকিবে নিরবে?
নীরবতাই তাহলে তোমার উত্তর?
মোড়ল কহে— ও কী কহিবে! আমরা যাহা বলিব,  তাহাই  শুধু শুনিতে  হইবে ওরে।
মাঝি আবারো কহে নবীনারে, এত কাল আমি ছিলাম এঘাটে শুধু তোমারই কারণে, নতুবা কোনো কালে কোনো ঘাটে হয়নিকো মোর এতটা সময়ও ব্যয়। লক্ষ তুমি জানো মোর, সব শুনেই তুমি চেয়েছিলে আসিতে। যদি বেসেথাকো ভালো তবে তুমি আসিবে এ আমার পরমও বিশ্বাস। আমি থাকবো অপেক্ষায় তোমারই তরে  তুমি যতদিন না আসো এ পানে।
মোড়ল আবারও কহে—  যদি কর মাঝি তুমি বাড়াবাড়ি তবে জেনো জ্বলিবে তোমার সপ্নের তরীখানি। তাই যত শীঘ্র তুমি এ ঘাট যাও ছেড়ে চলে। নহিলে তোমার আসিবে চরমও বিপদ।
এমনই সতীব্র হুমকি দিয়া  তারা গেলো চলে নবীনারে নিয়া। এও বলিল তারা, নবীনার উপরে চলিবে পাহারা দিবরাত্র প্রহর।
মাঝি স্তব্ধ সে শূন্য আম্রতলে। বুঝিতে পারিছে না কি যে করিবে সে। একদিকে তার ভালোবাসা অন্যদিকে তার ব্রতেরও লক্ষ। তাকে যে হবে পৌঁছাতেই সে অতলও অস্থির অদৃষ্টে। কিন্তু তার ভালোবাসা? এ প্রশ্ন খায় তারে কুরে কুরে।

এভাবে যায় কেটে কয়দিন ।...

একদিন প্রভাতে নতুন সূর্য দেয় দেখা....
সিক্ত মুখমণ্ডল, আলুথালু কেশরাশি, এলানো শরীর শয্যাপরে, চমকাইয়া ওঠে দুই ক্লান্ত নয়ন। একি দুয়ার খুলিলো কে? নবীনা শয্যা ছাড়িয়া উন্মুক্ত দরজা হতে আসে বাহির হইয়া, দাঁড়ায় সে জনহীন শূন্য উঠানে। আঁচল লুটায়ে রহিয়াছে উঠানের ধুলারও পরে। কিন্তু মাঝি, কি খবর তার! কোথা সে? সে দেয় ছুট ঘাটেরও পানে, বক্ষ দেহ উন্মুক্ত হইয়া নগ্ন চরনে, সেই কঙ্কর ভরা পথে। দেখে বড়ো কোলাহল, গঞ্জ শুদ্ধু যেন পড়েছে ভাঙিয়া। কি যেন সবাই করে বলাবলি। কিন্তু তরীখানি? সে ছোটে আরও ঘাটের নিকটে। তরী যে আছে দাঁড়ায়ে এখনও, যেথা ছিল আগে।
কিন্তু কোথা গেল মাঝি? সে প্রশ্ন আর্তনাদে সে করে বারেবারে।

হঠাৎ ই চারিদিক স্তব্ধ হইয়া দৃষ্টি শুধু সকলের নবীনারও পানে। সে হঠাৎই গেছে বসে আলুথালু চুলে অর্ধনগ্ন দেহখানি লয়ে ঘাটেরও ’পরে। সিক্ত কুঞ্চিত পাথরসম চক্ষু  লইলা একদৃষ্টে সেই রঙিন তরীরও পানে।...

এর পর কতবছর যে গেছে কাটিয়া, নদী বেয়ে কত স্রোত গেছে কত বহিয়া, হয়তো রবি ডুবিয়াছে আরও কতবার তারও পরে। তবু আজও দেখিতে পাইবে সেই নবীনারে ছিন্ন বস্ত্রে রুক্ষ্ম কেশে কুঞ্চিত চর্ম লইয়া আজও আছে বসিয়া সেই গঞ্জেরও ঘাটে, আম্রকুঞ্জ তলে,  না পলক ফেলিয়া আছে যে তাকায়ে শুস্ক চক্ষু মেলিয়া সেই আগাছায় ভরা মলিনও রঙিনও স্বপ্নেরও তরী পানে।

Link copied!