যে নারীরা বিশ্বসাহিত্যে কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩) অন্যতম। অথচ এই অমর কবি জীবনের কাছে হয়েছেন প্রতারিত। জীবন তাঁকে ক্রমাগত এক বিষণ্ণ, বেদনার্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। জীবনের করুণ দাঁত তাকে নিষ্পেষিত করেছে। বেঁচে থাকার একঘেয়েমি কিংবা বেঁচে থাকার লড়াই তাঁকে ক্লান্ত করেছে। জীবন-মৃত্যুর দোলাচল তাঁর কবিতা আর জীবনকে ঘিরে থাকে তার মীমাংসা আমরা করতে পারি না। কেবলই পার্থিব জঞ্জাল আর বেদনাই তাঁকে অপার্থিব জগতে আকৃষ্ট করে।
সিলভিয়া শুধু জীবনাচরণে নন, বরং লেখার মেজাজে অনেকটাই কাছাকাছি থাকেন। এক অন্ধকার জগতে তাঁর কবিতার বসবাস। তবে তাঁর আঁধার জগৎ এডগার অ্যালান পোর অন্ধকার জগৎ নয়। রহস্য, রোমাঞ্চ নয়, বরং তার অন্ধকারের আড়ালে আছে ব্যথা ও বিদ্রোহের সুর। তাঁর কবিতার স্বরে নারী যন্ত্রণা, বেদনা ও মুক্তির গান খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ সিলভিয়া বিশ্ব কবিতায় এমন এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, যাঁর শক্তির উৎস নারীর অহম, বেদনা, গর্ব ও গর্ভ।
আমেরিকার ম্যাসাচুটে জন্মেছিলেন সিলভিয়া। সিলভিয়া অত্যন্ত তরুণ বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্রিটিশ কবি টেড হিউজকে। অল্প বয়সেই সিলভিয়া পাঠক, সমালোচকের নজর কেড়েছিলেন। জীবিতকালেই তাঁর বই ইংল্যান্ডে ও আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়ে গেছে। সদ্য খ্যাতির মুখ দেখতে শুরু করেছিলেন সিলভিয়া। তিনিই প্রথম কবি, যে মৃত্যুর পর আমেরিকার অন্যতম সেরা সাহিত্য পুরস্কার পুলিৎজার (১৯৮১) পেয়েছিলেন। স্মিথ কলেজের একটি বৃত্তিও পেয়েছিলেন সিলভিয়া।
সিলভিয়া খুব ছোট্টবেলা থেকেই কবিতা ছাপানোর ব্যাপারে প্রবল আগ্রহী। মাত্র আট বছর বয়সে সিলভিয়ার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতা লেখা, প্রকাশ করা শুধু নয়—কবিতায় জীবনযাপন, কবিতা নিয়ে খ্যাতি-বিত্তের আকাঙ্ক্ষা ছিল সিলভিয়ার। অথচ একটা তীব্র ঝাঁজ তাঁর কবিতায় সর্বদাই ছিল। বিচ্ছিন্নতা, আত্মবিধ্বংসী মনোভাব আর আত্মহননই সিলভিয়া প্লাথের কবিতার মূল বিষয়বস্তু। তীক্ষ্ন অন্তর্দৃষ্টি, বিষাদ আর বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায় তাঁর কবিতায়।
নিজের নারী এবং কবিসত্তার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন তিনি। মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি হব পৃথিবীর কতিপয় নারী কবিদের অন্তর্গত এমন একজন সম্পূর্ণত আনন্দিত নারী, কোনো তিক্ত, হতাশ, বিকৃত পুরুষ-অনুকারক নয়, যে অনুকরণ অবশেষে নারী কবিদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি নারী এবং নারীজন্মে আনন্দিত। আমি গান গাইব পৃথিবীর উর্বরতার, ক্ষয়-শোক-মৃত্যুর মধ্যে মানুষের উর্বরতার গান। আমি গায়িকা হব। টেড আর আমার সুন্দর মিলিত জীবন হবে’ (উদ্ধৃতি: ভাবনার ভাস্কর্য, কেতকী কুশারী ডাইসন)।
সিলভিয়া উচ্ছল-উদ্যম জীবনযাপন করলেও তাঁর নিজের কাছেই নিজের জীবনটা খুব অদ্ভূত মনে হতো। ১৯৫২ সালে যখন স্মিথ কলেজে সদ্য ভর্তি হলেন তখন নিজের প্রতিই সিলভিয়ার প্রশ্ন ছিল—‘You walked in, laughing, tears welling confused, mingling in your throat. How can you be so many women to so many people, oh you strange girl?’
১৯৪০ সালে আট বছর বয়সেই সিলভিয়ার বাবা মারা যান। কঠোর আর স্বৈরাচারী বাবাকে তাঁর ভালো লাগত না। কিন্তু বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুও তাঁর ভালো লাগেনি। তার ‘daddy’ কবিতায় মৃত বাবার প্রতি ভালবাসা ও ঘৃণাকে তুলে ধরা হয়েছে। বাবা তাঁর কবিতায় পরবর্তী প্রভাব ফেলেছে। আবার মা-ও এসেছেন তাঁর কবিতায়। ‘Medusa’ কবিতায় কন্যার সঙ্গে মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘The Jailer’ কবিতায় দায়িত্বহীন-স্বার্থপর স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ক্রোধ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে বলে রাখা দরকার, ছোট্টবেলায় বাবার মৃত্যু, বেঁচে থাকার জন্য মায়ের সংগ্রাম, আবার স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাবা-মায়ের সম্পর্ক—এসবই তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে।
আধুনিক পাঠক, লেখক, সমালোচকের দরবারে সিলভিয়া প্লাথের পরিচয় আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হয় ফুরিয়েছে। এই ক্ষণজন্মা, অভিমানী কবি ও তাঁর কবিতার সঙ্গে কমবেশি সবারই পরিচয় আছে বলে ধারণা করা যায়। এত অল্প সময়ে আমাদের জন্য এত উঁচুদরের এত কবিতা রেখে যাওয়ার নজির বিশ্ব কাব্য ইতিহাসে বড় কম। যেকোনো প্রাচীনপন্থী পাঠকের জন্য সিলভিয়া প্লাথ এক মোক্ষম হুমকি। তাঁর কবিতা পরিচিত বোধের চেনা পরিমণ্ডলকে বারবার আক্রমণ করেছে। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই আমরা বরং সিলভিয়া প্লাথের কাব্যভূবনে প্রবেশ করি। তাঁর কয়েকটি কবিতার পরিচিতিই এ লেখার মূল বিষয়। বলা দরকার, ছোট ছোট বাক্য, সরল শব্দ ব্যবহার করলেও সিলভিয়ার কবিতায় বহু প্রতীক, পুরাণের ব্যবহার আছে। অন্যদিকে ছোট ছোট শব্দ দিয়েই তিনি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেন, পুরো বাক্য বলেন না। ফলে প্রায়শই তাঁর কবিতা সহজপাঠ্য নয়। প্রায়শই তাঁর কবিতা বাড়তি মনোযোগ দাবি করে, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। এই ছোট্ট লেখাটি আশা করি তাঁর কাব্যভুবন আস্বাদনে একটা প্রবেশিকা হিসেবে কাজ করবে।
শুরুটা করা যাক তাঁর অতি বিখ্যাত কবিতা ‘অ্যারিয়েল’ (Ariel) দিয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর পর ‘অ্যারিয়েল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম কবিতা এটি। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ‘অ্যারিয়েল’ সিলভিয়া প্লাথের ঘোড়ার নাম ছিল। পুরো কবিতাটিতে এক ভোরে, যখনো আলো ফোটেনি তখন থেকে ঘোড়ায় চড়ে বাইরে বের হওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। গ্রামের মেঠো পথ, গিরিখাত, পাহাড় পেরিয়ে ঘোড়ায় চড়ার উল্লাস আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা উপভোগের আনন্দ এ কবিতায় প্রকাশিত। এই কবিতায় প্লাথ একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল চিত্রকল্প তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে নারী স্বাধীনতা, মৃত্যু, যৌনতার মতো প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, লেডি গোডিভা তেরো শতকের ইংরেজ নারী ছিলেন, যিনি নগ্ন হয়ে ঘোড়ায় চড়েছিলেন। তাঁর স্বামী প্রজাদের ওপর অবৈধ কর চাপিয়ে দিলে তার প্রতিবাদ জানাতে তিনি নগ্ন হয়ে ঘোড়ায় চড়ে ইংল্যান্ডের কভেন্টি শহরে এ কাজ করেন।
শ্বেত
গোডিভা, আমি উন্মুক্ত করি—
মৃত হাত, মৃত কাঠিন্য।
এই অশ্বারোহী গোভিডার পাশাপাশি কবিতায় এসেছে ‘ঈশ্বরের সিংহী’ শব্দযুগল। এই শব্দযুগল ইহুদি পুরাণ থেকে নেওয়া হয়েছে, হিব্রু ভাষায় ‘অ্যারিয়েল’ অর্থ ঈশ্বরের সিংহী।
অন্যদিকে কোনো কোনো সমালোচক উইলিয়াম শেকসপিয়রের ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের ‘অ্যারিয়েল’-এর সঙ্গে এই কবিতাকে তুলনা করেছেন। ‘টেম্পেস্ট’-এর অ্যারিয়াল একজন আত্মা যে তার উদ্ধারকারী জাদুকর প্রসপেরোর ইচ্ছায় চলে। এত ছোট্ট একটি কবিতায় এত চিত্রকল্প, ইতিহাস, পুরাণের ব্যবহার সিলভিয়ার প্লাথের দক্ষতাই তুলে ধরে। খুব ভোরে একটা অশ্বারোহণের মাধ্যমে সিলভিয়া প্লাথ যেন নতুন এক নারী জন্মের ইঙ্গিত দেন। নিজের তিরিশতম জন্মদিনে (অক্টোবর ১৯৬২) এই কবিতা রচনা করেছিলেন সিলভিয়া প্লাথ।
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘অ্যারিয়েল’ কাব্যগ্রন্থের আরেকটি বিখ্যাত এবং জটিল কবিতা ‘লেডি ল্যাজারাস’। সিলভিয়া প্লাথের রচনারীতি বোঝার জন্য এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। ‘ড্যাডি’র মতো এ কবিতাতেও নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার আর হতাকাণ্ডের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাৎসিরা বন্দীদের চামড়া থেকে সাবান আর ল্যাম্পের শেড বানাত—কবিতার চতুর্থ ও পঞ্চম লাইনেই সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সিলভিয়া। অন্যদিকে প্লাথের আত্মহত্যাপ্রবণতা, ক্রমাগতে মরতে চাওয়ার চেষ্টা এই কবিতা এসেছে। ‘ড্যাডি’ কবিতার মতোই এ কবিতাতেও জার্মান ভাষার ব্যবহার রয়েছে তার পিতার উত্তরসূরি সূত্রেই। অন্যদিকে জনাব শত্রু বলতে স্বামী টেড হিউজকে বুঝিয়েছেন তিনি। পুরুষ বলতেই পিতা ও স্বামীর কথা এসেছে তার কবিতায় বারবার। পুরাণের আগুনপাখি ফিনিক্স এ কবিতায় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফিনিক্স সেই পাখি, যাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় এবং পোড়া ছাই থেকে তার বারবার জন্ম হয়। সিলভিয়া প্লাথও যেন বারবার মৃত্যু থেকে ফিরে আসেন। তিনি এ কবিতা যেন ডাক্তার মহাশয়ের উদ্দেশে লিখেছেন। প্রতি দশ বছরে একবার করে মরতে চাওয়া সিলভিয়াকে বারবার ডাক্তাররাই ফিরিয়ে এনেছে। তাই পরেরবার যখন সে মরার প্রস্তুতি নেবে তখন ডাক্তার আর পুরুষদের আগে খাবে।
বাইবেলের ‘গসপেল অব জন’-এ ল্যাজারাসের কথা আছে। সন্ত ল্যাজারাসকে তার মৃত্যুর চার দিন পর স্বয়ং যিশুখ্রিষ্ট ফিরিয়ে এনেছিলেন। নিজেকে নারী ল্যাজারাস হিসেবে কল্পনা করেছেন সিলভিয়া। বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা আর বারবার তাঁকে ডাক্তারদের ফিরিয়ে আনাকে ডার্ক হিউমারের মতো করে তুলে ধরেছেন সিলভিয়া। উল্লেখ্য, মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ও’ নীলের বিখ্যাত একটি নাটক ‘ল্যাজরাস লাফড’ বাইবেলের এ কাহিনি অবলম্বনেই রচিত। ‘ল্যাজারাস’ শব্দটি শিল্প-সংস্কৃতিতে তো বটেই, এমনকি বিজ্ঞানেও পূর্ণ জীবনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এই কবিতাতেই সিলভিয়া বলছেন তাঁর বিখ্যাত উক্তি , ‘মরে যাওয়া একটা শিল্প (dying is an art) এবং পরের লাইনেই তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমি এটা বিশেষ ভালোভাবে করতে পারি’। কিন্তু মরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সিলভিয়া বারবার ব্যর্থতার স্বীকার হয়েছেন। স্বীকারোক্তিমূলক এই কবিতাতেই তিনি উল্লেখ করছেন—
আর আমি এক হাস্যমুখী নারী।
কেবল তিরিশ বছর বয়স।
আর বিড়ালটির মতোই আমি নয়বার মরবার চেষ্টা করেছি।
এইটা তৃতীয়বার।
কী অপচয়
প্রতিটি দশককে বিনষ্ট করা।
জীবনের প্রতি তরুণ সিলভিয়ার একটা উচ্ছল দৃষ্টিভঙ্গি থাকার পরও তাকে বারবার মরে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে। ১৯৬২ সালের অক্টোবরে লেখা এই কবিতায় এক গভীর কৃষ্ণরম্যের মতোই এই কবিতা সেই বিষাদ ও ব্যর্থতার হাস্যকর দিক তুলে ধরে। আর পরের বছরই সিলভিয়া প্লাথ আমাদের সবাইকে বিষাদাক্রান্ত করে সফল আত্মহননে।
‘আব্বু, তোমাকে আমার হত্যা করার কথা।
আমি সময় করার আগেই তুমি মরে গেলে—’
বাবাকে নিয়ে এমন ভয়ংকর কবিতা বোধ হয় সিলভিয়া প্লাথের পক্ষেই লেখা সম্ভব। ‘ড্যাডি’ সিলভিয়া প্লাথের আরেক বিশ্বখ্যাত কবিতা। এই কবিতায় বাবা শুধু সিলভিয়া প্লাথের বাবা নন, পুরো পিতৃতন্ত্রের প্রতীক, কখনোবা স্বামীও। বাবা আর স্বামীকে রীতিমতো হিটলার, ভ্যাম্পায়ার, বিকট আকার, সোয়াসতিকা, ঈশ্বর, নাৎসি হিসেবে দেখেছেন তিনি। অন্যদিকে নিজেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্যাতিত, নিহত ইহুদিদের একজন হিসেবে দেখেছেন। এই চিত্রকল্পই যেন পিতৃতন্ত্র’র অত্যাচারী দিক আর নারীর আক্রান্ত হওয়ার দিক তুলে ধরে যুগপৎ।
‘আমি, আমি, আমি, আমি,
আমি বহু কষ্টে কথা বলতে পারতাম।
আমি ভাবতাম প্রত্যেকটা জার্মান লোকই তুমি।
আর ভাষাটা অকথ্য
একটা ইঞ্জিন, একটা ইঞ্জিন
একটা ইহুদির মতো আমাকে কাটছে কর্কশ শব্দে’।
উল্লেখ করা দরকার, সিলভিয়ার বাবা জার্মান বংশোদ্ভূত ছিলেন। এ কবিতায় সচেতনভাবেই একাধিক জার্মান শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। হিটলারের আত্মজীবনীর শিরোনাম ‘মাইন কাম্ফ’ (‘আমার সংগ্রাম’)। ‘পাঞ্জার’ হলো জার্মান ট্যাংকচালক, অন্যদিকে ‘লুফতাফি’ হলো জার্মান যুদ্ধবিমান। ‘গোবেলডিগো’ শিশুর মুখে উচ্চারিত আবোলতাবোল শব্দ। এই কবিতার চলন, ছন্দ এবং শব্দ ব্যবহারে ছোট্ট বালিকার কথাও মনে হয় বারবার। সিলভিয়া প্লাথকে অনেকেই ‘স্বীকারোক্তিমূলক কবি’ (confessional poet) বলে থাকেন। খ্রিষ্টধর্মীয়রা যেমন গির্জায় গিয়ে অকপটে কনফেশন বাক্সের সামনে নিজের ব্যথা, ক্রোধ, পাপের কথা বলেন, সিলভিয়াও কোনো কোনো কবিতায় নিজের জীবনের নানা যন্ত্রণা, নিরাশা, ক্রোধ ইত্যাদি প্রকাশ করেছেন অকপটে, কবিতায়। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে আব্বু (Daddy) তার স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা। আরেকটি তথ্য উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি, টেড হিউজের সঙ্গে বিচ্ছেদের এক মাস পরই তিনি এ কবিতা রচনা করেন। অন্য নারীর সঙ্গে টেড হিউজের সম্পর্ক, সিলভিয়ার প্রতি তার অবিশ্বস্ততাও এ কবিতায় উঠে এসেছে। তীব্র বিষাদ, ক্রোধ এই কবিতার ভাষাকে রুক্ষ্ম আর তীক্ষ্ন করেছে। পিতার মৃত্যুতে সিলভিয়া শোক করেন না, বরং মুক্তি পান। এই মুক্তি পুরুষতন্ত্রের থেকে মুক্তি। এই মুক্তি স্বামীর থেকেও মুক্তি। অথচ মুক্তির অনেক আগেই সিলভিয়া অন্য নারীদের মতোই আহত, ক্ষতবিক্ষত। ‘আব্বু’ সিলভিয়ার প্লাথের এমন এক কবিতা যা বারবার পড়তে হয় এবং প্রতিবারই নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়।
‘চাঁদ ও ঈয় গাছ’ (The Moon and the Ywe tree) ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব প্রিয় কবিতা। সিলভিয়া প্লাথের এই কবিতা একবার পড়লে মাথা থেকে নামানো যায় না। মাত্র এক পৃষ্ঠার এই কবিতায় সিলভিয়া তার ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন আর প্রকৃতির ঘনিষ্ঠতাকে তুলে ধরেছেন বিস্ময়কর দক্ষতায়। একটা সময় সিলভিয়া কবিতা লিখতে পারছিলেন না। তখন স্বামী টেড হিউজ পরামর্শ দেন চারপাশের পরিবেশ নিয়ে লিখতে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে। সিলভিয়ার শোবার ঘরের জানালার কাছেই ছিলো গির্জার আঙিনা। সেখানে ঈয় গাছের মাথায় চাঁদ উঠেছিল। চাঁদ আর ঈয় গাছকেই সিলভিয়া প্রতীক হিসাবে এই কবিতায় তুলে আনেন। চাঁদ হলো তার মা আর ঈয় গাছ হলো বাবা। বাবা-মাকে প্রকৃতির অংশ করে তোলেন তিনি। কিন্তু কোনোভাবেই এই কবিতা পাঠ মধুর অভিজ্ঞতা নয়, কেননা, চাঁদ আর বৃক্ষ নিয়ে এটি কোনো কোমল-পেলব কবিতা নয়। প্লাথের শৈশবেই বাবা মারা যান, মা ছিলেন অনেকটা নিষ্পৃহ, শীতল। বাবার প্রতি যেমন সিলভিয়ার অনেক অভিযোগ ছিল (‘আব্বু’ কবিতা দ্রষ্টব্য) তেমনি মায়ের সঙ্গেও তার তেমন আন্তরিক কোনো সম্পর্ক ছিল না।
অন্যদিকে, বাবা-মায়ের সম্পর্কটিও সিলভিয়ার বিবেচনায় আন্তরিক ছিল না। আদতে সব দাম্পত্য সম্পর্কের শীতলতাও সিলভিয়া দেখেছেন। এই সবকিছুর প্রভাব পড়েছে ‘চাঁদ ও ঈয় গাছ’ কবিতায়। তবে সিলভিয়ার কল্পনা শক্তি আর সৃষ্টিশীলতা এতই প্রখর যে বিষাদ আর নৈরাশ্যকেও তিনি অনন্য দক্ষতায় আঁকতে পারতেন, যার প্রমাণ এই কবিতা। নিজের জানালা দিয়ে দেখা চাঁদ আর ঈয় গাছ নিয়ে লেখা এই কবিতা যেন এক ধ্যনস্থ বয়ান। ঈয় গাছ এখানে পুরুষত্বের প্রতীক, আবার মৃত্যুর প্রতীক। ঈয় গাছ সচারাচর কবরস্থানে, গির্জার আঙিনাতেই দেখা যায়। অন্যদিকে চাঁদ এখানে মাতৃত্বের প্রতীক, নারীর প্রতীক এবং সর্বোপরি একাকিত্বের প্রতীক। চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। চাঁদ শুধু তার মা নয়, সিলভিয়া নিজেও নিজের মতো নিঃসঙ্গ, একাকী।
ধারণা করা হয় ১৯৬৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখা ‘প্রান্তরেখা’ (Edge) কবিতাটিই সিলভিয়া প্লাথের লেখা সর্বশেষ কবিতা। আত্মহত্যার মাত্র ছয় দিন আগে লেখা এই কবিতাটি তার ‘সুইসাইড নোট’ বলা যায়। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মানসিকতার একটা উৎকৃষ্ট নমুনা এই কবিতা। এই কবিতায় সিলভিয়া নারীর অর্থহীন জীবনকে তুলে ধরেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের ইচ্ছা ছাড়া নারী কিছুই করতে পারে না। আবার নারীর সব কাজকেই বিশেষত গৃহকর্মকে গুরুত্বহীন, অর্থহীন মনে করা হয়। প্লাথ তাই এমন এক মৃত নারীর কথা বলেছেন যার পূর্ণতা প্রাপ্তি হয় কেবল মৃত্যুতে। তাঁর ভাষায়, মৃত্যুতেই ‘নারীটি স্বার্থক পূর্ণতা পেয়েছে’। নারীর শরীর মৃত্যুর পর হেসে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘প্রান্তরেখা’ সিলভিয়া প্লাথের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন কবিতা (darkest poem)। এই কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রঙের ব্যবহার। সাদা, লাল আর কালো এই তিনটি রং এখানে রবার্ট গ্রেভসের ‘সাদা দেবীগণ’ তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ শতকের মাঝামাঝি পুরাণবিদ গ্রেভস রচনা করেন ‘দ্য হোয়াইট গডেস’। তিনি ইউরোপীয় মূর্তি পূজারিদের দেবীদের সম্পর্কে আলোচনা করে দেখান যে আসলে একজন দেবীই নানা নামে ও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। জন্মদান, জীবন ধারণ আর মৃত্যু আদতে একই নারী সত্তার কুমারীকাল, মাতৃত্বকাল এবং বৃদ্ধাকালের রূপান্তরিত চেহারা। এই তত্ত্ব মতে, সাদা হলো কুমারীর রং, লাল হলো মাতৃত্বের রং আর কালো হলো বয়োবৃদ্ধ কিংবা মৃত্যুর রং। সিলভিয়া এই প্রতীক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তার শেষ কবিতায় ‘সাদা সাপ’ ‘দুধের পাত্র’, ‘গোলাপ’, ‘রক্তাক্ত সৌরভ’, ‘রাত্রি’, ‘চাঁদ’, ‘কৃষ্ণতা’ ইত্যাদি চিত্রময়তা ব্যবহার করেছেন। সিলিভিয়ার সমগ্র কবিতাতেই রঙের প্রতীকী ব্যবহার দারুণভাবে করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, সিলভিয়া নিজেও একজন চিত্রকর ছিলেন। তার তিনটি আত্মপ্রতিকৃতি আর কিছু ড্রয়িং যোগ করা হলো এ লেখার সঙ্গেই। কবিতা আর তার আঁকা ছবিকে মিলিয়ে দেখলে হয়তো আরও গভীরে যাওয়া যাবে।
আব্বু
তুমি তো পরো না, তুমি তো পরো না
আর মোটেই, কালো জুতাখানি
যার মধ্যেই আমি বাস করতাম পায়ের মতো
তিরিশ বছর ধরে, নিঃস্ব আর নিষ্পাপ,
সাহসও হতো না সচরাচর নিশ্বাস নেওয়ার কিংবা হাঁচি দেওয়ার।
আব্বু, তোমাকে আমার হত্যা করার কথা।
আমি সময় করার আগেই তুমি মরে গেলে—
মর্মর পাথরের মতো ভারী, বস্তা ভর্তি ঈশ্বর,
বিকট আকার মূর্তি একটা ধূসর পায়ের আঙুল নিয়ে
সানফ্রান্সিসকোর বিশাল সীল মাছের মতো
আর মাথাখানি ক্ষেপাটে আটলান্টিক সাগর
যেখানে সীমের মতো সবুজ ছড়ায় নীলের ওপর
সুন্দর নসেট সৈকতের পানিতে।
আমি প্রার্থনা করতাম তোমার কাছ থেকে মুক্তি পেতে,
আহ, তুমি
জার্মান ভাষায়, পোলিশ শহরে
রোলারে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে মাটিতে
যুদ্ধে, যুদ্ধে, যুদ্ধ সমূহে।
কিন্তু শহরের নামটি ছিল চেনা
আমার পোলিশ বন্ধু
বলেছিল সেখানে দুয়েক ডজন আছে।
তাই আমি কখনোই বলতে পারিনি তুমি কোথায়
রেখেছো তোমার পা, তোমার শিকড়।
আমি কখনো কথা বলতে পারিনি তোমার সঙ্গে।
আমার জিব আটকে যেত চোয়ালে এসেই।
সেটা আটকে যেত সীমান্ত কাটাতাঁরের ফাঁদে।
আমি, আমি, আমি, আমি,
আমি বহু কষ্টে কথা বলতে পারতাম।
আমি ভাবতাম প্রত্যেকটা জার্মান লোকই তুমি।
আর ভাষাটা অকথ্য
একটা ইঞ্জিন, একটা ইঞ্জিন
একটা ইহুদির মতো আমাকে কাটছে কর্কশ শব্দে
দাখাউ, আউসভিজ, বেলসেনের একটা ইহুদির মতো।
আমি ভেবেছি আমি বোধ হয় ইহুদি হলেই ভালো করতাম।
টাইরলের তুষার, ভিয়েনার পরিষ্কার বিয়ার
খুব খাঁটি কিংবা সত্য নয়।
আমার ইহুদি বংশধরদের কাছে এবং আমার আজব ভাগ্যের কাছে
আর আমার ট্যারক তাসের প্যাকেটে আমার ভাগ্যের তাসের প্যাকেট
আমি হয়তো একটুখানি ইহুদি হতে পারতাম।
আমি বরাবরই তোমার ভয়ে ভীত থাকতাম,
তোমার লুফতাফি যুদ্ধবিমানে, তোমার গোবেলডিগোতে,
তোমার পরিপাটি গোঁফে
তোমার আর্য চোখে, তীব্র নীলে,
পাঞ্জার মানব, পাঞ্জার মানব, ওহ, তুমি—
ঈশ্বর নয়, তবে সোয়াস্তিকা
এত কালো যে এর মধ্য দিয়ে কোনো আকাশ ভেদ করতে পারে না।
প্রত্যেক নারীই একটা ফ্যাসিস্টের বন্দনা করে,
মুখের মধ্যে বুটজুতা, বর্বর,
বর্বর হৃদয় তোমার মতো বর্বর।
তুমি ব্ল্যাকবোর্ডের পাশে দাঁড়ানো, আব্বু,
তোমার যে ছবিটা আমার কাছে আছে
পায়ের বদলে তোমার মুখের কাছে একটা ফাটল আছে
কিন্তু তাতে শয়তানের চেয়ে কম মনে হচ্ছে না তোমাকে
কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের চেয়ে কম না যে কিনা
আমার সুন্দর হৃদয়কে দু’ফালি করে দিয়েছিল।
আমি ছিলাম দশ যখন তোমাকে ওরা কবর দিল।
বিশে এসে আমি মরতে চেষ্টা করলাম
আর ফিরে এলাম, ফিরে, ফিরে তোমার কাছেই।
আমার মনে হয়েছিল এমনকি হাড়গুলোও চলবে।
কিন্তু তারা আমাকে বস্তা থেকে টেনে বের করল
আর আমাকে আঠা দিয়ে জুড়ে দিল।
আর তখন আমি জেনেছিলাম কী করতে হবে।
আমি তোমার একটা মূর্তি বানিয়েছিলাম,
মাইন কাম্ফ চেহারার একটা কৃষাঙ্গ মানুষ
আর ভালোবাসা জন্মাল দাঁতাল যন্ত্র আর যন্ত্রণার প্রতি
আর আমি বললাম কবুল, কবুল।
তাই আব্বু, আমি শেষতক মুক্তি পেলাম।
কালো টেলিফোনখানা সমূলে উৎপাটিত,
সেই কণ্ঠ আর আর পেরোতে পারল না।
যদি আমি একজনকে হত্যা করে থাকি, তবে দুইজনকে হত্যা করতাম—
যে ভ্যাম্পায়ার বলেছিল তুমিই সে
আর রক্ত পান করেছিল বছরের পর বছর,
সাত বছর, যদি তুমি ঠিক করে জানতে চাও।
আব্বু, তুমি এখন শুয়ে পড়তে পারো।
একটা গজাল পোতা আছে তোমার মোটা কালো হৃদয়ে
আর গ্রামবাসীরা কোনোদিনই তোমাকে পছন্দ করেনি।
তারা তোমাকে পা দলেছে আর নেচেছে তোমার ওপর।
তারা সব সময়ই জানত এটা তুমি।
আব্বু, আব্বু, তুমি হারামি, আমি মুক্ত।
অ্যারিয়েল
অন্ধকারে স্থবির,
তারপর অবয়বহীন নীল
বয়ে আসে দূর পাহাড় থেকে।
ঈশ্বরের সিংহিনীরা,
কেমন করে আমরা একেকজন বেড়ে উঠি
গোড়ালি আর হাঁটু রাখি ঘোড়ার কেন্দ্রে!— পথরেখাটি
ভেদ করে যায় আর গিরিপথ, সহদোরা
বাদামি বাঁকের
সেই ঘাড়ের যা আমি ছুঁতে পারি না,
কালো চোখ
গাঢ় তুতফলে মোড়া
খুড়—
কালো মিঠে রক্তে ভরা মুখ,
ছায়ারা,
অন্য কোনো কিছু
বাতাসের মধ্য দিয়ে আমাকে টানে—
ঊরুযুগল,
চুল;
গোড়ালি থেকে ওঠে তুষার কণা
শ্বেত
গোডিভা, আমি উন্মুক্ত করি—
মৃত হাত, মৃত কাঠিন্য।
আর এখন আমি
গমের ফেনা, সমুদ্রের একছটা দীপ্তি।
শিশুটির কান্না
দেয়ালে গলে যায়
আর আমি
আমি সেই তীর,
আর উড়ে যাওয়া শিশির
আত্মহত্যাপ্রবণ, তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায়
লালের মাঝে
চোখ, সকালের এক বিরাট মিশ্রণ পাত্র।
নারী ল্যাজারাস
আমি আবার এটা করেছি।
প্রতি দশ বছরে একবার
আমি এটার ব্যবস্থা করি—
একধরনের চলন্ত অলৌকিক, আমার চামড়া
নাৎসিদের ল্যাম্পশেডের মতো উজ্জ্বল,
আমার ডান পা
একটি পেপারওয়েট,
আমার মুখ বৈশিষ্টহীন, মিহি
ইহুদি লিনেন।
ন্যাপকিনের ছিঁড়ে ফেলা
ও শত্রু আমার।
আমি কি আতঙ্কিত হই?
নাকখানি, চোখের গভীর খাদ, পুরো দন্তপাটি?
চুকা ঢেকর
আজই হয়ে যাবে শেষ।
শীঘ্রই, শীঘ্রই এই মাংসপিণ্ড
এই কবরের গুহা খেয়ে ফেলবে
আমাকে কবরে আত্মীকরণ
আর আমি এক হাস্যমুখী নারী।
কেবল তিরিশ বছর বয়স।
আর বিড়ালটির মতোই আমি নয়বার মরবার চেষ্টা করেছি।
এইটা তৃতীয়বার।
কী অপচয়
প্রতিটি দশককে বিনষ্ট করা।
কত লক্ষ সুতার মতো আলোর ফিলামেন্ট।
বাদাম-মুচমুচে ভিড়
ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে দেখতে আসে
আমাকে উন্মোচিত হতে হাত আর পাসহ—
বিরাট স্ট্রিপটিজ।
ভদ্রমহোদয়, ভদ্রমহিলাগণ
এই হলো আমার হাতেরা
আমার হাঁটু।
হয়তো আমি হাড্ডিসার,
তবু আমি সেই একই, অভিন্ন নারী।
প্রথমবার এটা যখন ঘটেছিল তখন আমি মাত্র দশ।
সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা।
দ্বিতীয়বার আমি চেয়েছিলাম
এটা স্থায়ী হোক আর যেন ফিরে আসতে না হয়।
আমি পাথুরে বন্দী
একটা ঝিনুকের খোলের মতো।
তাদেরকে ফোন করতে হয়েছে আর ফোন করতে হয়েছে
আঠালো মুক্তার মতো পোকাগুলোকে আমার ভেতর থেকে তুলে ফেলতে।
মরে যাওয়া
একটা শিল্প, অন্য সবকিছুর মতোই।
আমি এটা বিশেষ ভালোভাবে করতে পারি।
আমি এটা করি কারণ আমার নরক অনুভূতি হয়।
আমি এটা করি কারণ এটা সত্যি মনে হয়।
আমার মনে তুমি হয়তো বলবে এটা একটা আহ্বান।
একটা কারাকক্ষে এটা করা যথেষ্ট সহজ।
এটা করা যথেষ্ট সহজ এবং স্থির থাকা।
এটা নাটকীয় ভঙ্গি
দিনের আলোতে ফিরে আসা
একই জায়গায়, একই মুখ নিয়ে, একই বর্বর
বিনোদন চিৎকারে:
‘একটা অলৌকিক!’
এটাই আমাকে এক ঝটকায় ফেলে দেয়।
এর একটা মূল্য আছে
আমার ক্ষত চাক্ষুষ দেখার, এর একটা মূল্য আছে
আমার হৃদয়কে শোনার—
এটা সত্যিই চলে।
আর এর মূল্য আছে, একটা বড় বিনিময় মূল্য আছে
একটা শব্দের কিংবা একটা স্পর্শের
কিংবা একটুখানি রক্তের
কিংবা আমার চুলের একটা টুকরা কিংবা আমার কাপড়ের
তাই, তাই জনাব ডাক্তার,
তাই জনাব শত্রু।
আমি তোমার রচিত গান
আমি তোমার মূল্যবান সম্পদ,
আর খাঁটি সোনার শিশু
যে গলে যায় এক তীক্ষ্ণ চিৎকারে।
আমি ঘুরি আর পুড়ি
এমন ভেবো না যে তোমার মহৎ উদ্বেগকে আমি খাটো করছি।
ছাই, ছাই—
তুমি তাকে খোঁচাও আর নাড়া দাও।
মাংস, হাড়, সেখানে কিচ্ছু নেই—
এক টুকরো সাবান,
একটা বিয়ের আংটি,
একটা সোনার দাঁত।
জনাব ঈশ্বর, জনাব শয়তান
সাবধান
সাবধান।
ছাই থেকেই
আমি জেগে উঠি আমার লাল চুল নিয়ে
আর আমি পুরুষ খাই বাতাসের মতো করে।
চাঁদ ও ঈয় গাছ
এটা হলো মনের আলো, ঠান্ডা আর অস্থিরমতি
মনের গাছেরা হলো কালো। আলো হলো নীল।
ঘাসেরা তাদের দুঃখ ঢালে আমার পায়ে যেন আমি ছিলাম দেবতা
আমার গোড়ালিতে শিহরণ তোলে আর তাদের নম্রতার মর্মরধ্বনি
ধোঁয়াময়, মরমি কুয়াশা বাস করে এইখানে।
আমার বাড়ি থেকে তারা বিচ্ছিন্ন একটা সমাধিফলক দিয়ে।
আমি নেহাত দেখতে পাই না কোথায় যেতে হবে।
চাঁদ কোনো দরজা নয়। সে তার নিজের অধিকারেই একটা মুখাবয়ব,
আঙুলের মাথার মতো সাদা আর ভীষণ রকমের মর্মাহত।
সে টেনে আনে সমুদ্রকে নিজের দিকে একটা কালো অপরাধের মতো, সে নীরব তার সম্পূর্ণ উধাও হা-মুখ নিয়ে। আমি এখানেই বাস করি।
রবিবারে দুইবার, ঘন্টাধ্বনি আকাশকে চমকিত করে—
আটটি মহৎ কথা পূনরুত্থানের নিশ্চয়তা দেয়
সবশেষে, তারা শান্তভাবে তাদের নাম ফুঁকে দেয়।
ঈয় গাছ ওপরের দিকে, এর আছে একটা গথিক আকার।
চোখ তার ওপরে যায় আর সেখানেই চাঁদকে পায়।
চাঁদটি হলো আমার মা। সে ম্যারির মতো মধুর নয়।
তার নীল পোশাক খুলে বের হয় ছোট্ট বাদুর আর পেঁচাদের।
আমি কেমন করে কোমলতায় বিশ্বাস রাখব—
প্রতিমার মুখ, কোমল হয় মোমবাতির আলোতে,
ঝুঁকে আসে, বিশেষত আমার দিকে, তার নরম চোখ।
আমি অনেক দূরে পড়েছি। মেঘেরা ফুল ফোটাচ্ছে
নীল আর মরমি নক্ষত্রদের মুখের ওপরে
চার্চের ভেতরে, সন্তরা সবাই হয়ে যাবে নীল
ভাসবে তাদের পলকা পায়ে গির্জার ঠান্ডা বেঞ্চের আসনের ওপরে,
তাদের হাত আর মুখ অনমনীয় হয়ে আছে পবিত্রতায়।
চাঁদটি এসবের কিচ্ছু দেখে না। সে ন্যাড়া আর বন্য।
আর ঈয় গাছের বার্তা হলো কৃষ্ণতা—কৃষ্ণতা আর নীরবতা।
প্রান্তরেখা
নারীটি সার্থক পূর্ণতা পেয়েছে।
তার মৃত্যু
শরীর তার সাধনার হাসি পড়েছে,
অপরিহার্য গ্রিক মায়া
তার আলখেল্লার ভাঁজে প্রবাহিত,
তার নগ্ন
পা মনে হয় বলছে:
আমরা অনেক দূর এসেছি, এখন সমাপ্তি।
প্রত্যেক মৃত সন্তান কুণ্ডলী পাকানো, একটা সাদা সাপ,
একেকজন ক্ষুদ্র
দুধের পাত্র ছিল, এখন শূন্য।
সে ভাঁজ করেছিল
তাদেরকে আবার তার শরীরে পাপড়ির মতো
একটি গোলাপ যখন বাগানে ঝরে যায়
শীতল আর সৌরভেরা রক্তাক্ত
রাত্রি কুসুমের মিষ্টি, গভীর কণ্ঠ থেকে।
চাঁদের বিষণ্ণ হওয়ার কিছু নেই,
তার হাড়ের অবগুণ্ঠন থেকে দেখে শুধু।
সে এমন বিষয়ে অভ্যস্ত।
তার কৃষ্ণতা ফাটল ধরায় আর টেনে নেয়।