• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রংপেনসিল


তাপস কুমার দত্ত
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২, ০২:৩৫ পিএম
রংপেনসিল

কলিং বেলে চাপ দিতেই আমার বুকটা ধুকপুক শুরু করল। 
কদিন আগে আমার হার্টের বাইপাস সার্জারি হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন উত্তেজনা না নিতে। কিন্তু আমি এমন একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, যার সঙ্গে আমার মৃত্যুশয্যার সময় দেখা হলেও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাবে।
কেউ দরজা খুলছে না। তাতে করে আমার হৃদয়ের গতি আরও বেড়ে যাচ্ছে।
আবার কলিং বেলে চাপ দিলাম। টিংটং শব্দ হলো। কেউ একজন বলল, ‘আ-স-ছি।’
কার গলা? তার?
দরজা খুলল একজন অল্প বয়সী কাজের মেয়ে।
আমি একটা অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বললাম, আজাদ সাহেবের বাড়ি এটা?
—জি। 
—ভাবি বাসায় আছেন?
—ভাবি?
—শবনম, আমি শবনম ভাবির কথা বলছি?
—জি বাসায় আছে। আপনি কার কাছে আইছেন?
—শবনম ভাবির কাছে?
—নাম কী আপনার?
—আলতাফ। আলতাফ মাহমুদ।
—দাঁড়ান আমি জিগায় আসি।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। কতক্ষণ! খুব বেশি হলে ১৫ সেকেন্ড। কিংবা ৩০ সেকেন্ড। 
আমি ভাবতে লাগলাম ঘটনাটা তো অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল।
আজাদ সাহেব এসে আমার বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজাবেন।
আমার বাড়ির কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলবে। আজাদ সাহেব দ্বিধা জড়ানো গলায় বলবেন, আলতাফ সাহেবের বাড়ি এটা?
—জি?
—ভাবি বাড়িতে আছেন?
—ভাবি?
—শবনম, আমি শবনম ভাবির কথা বলছি। আলতাফ সাহেবের স্ত্রী।...
আমার ভাবনা ছুটে যায়। শবনম এসে বলল, আরে আলতাফ ভাই। আসেন।
ইশ! এখনো কী অপূর্ব দেখতে! বয়স কত হলো? পঁয়ষট্টি বছর তো হবেই। কিন্তু বোম্বের রেখার মতো শবনমকে দেখলে মনে হয় যেন টেনেটুনে বয়স চল্লিশ বছর পার হয়েছে।
আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসি। এল-প্যার্টানের সোফা। আমি এলের নিচের সারিতে বসি। শবনম এলের মাথায় গিয়ে বসে। মনে হলো আজাদ সাহেব কিংবা শবনম খুব শৌখিন। খুব সুন্দর করে ঘরটা সাজানো। কিন্তু আমার চোখ শবনমের থেকে সরতে চাইছে না। আবার সরাসরি তাকাতে লজ্জাও পাচ্ছি। তাই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছি।
শবনম বলল, তারপর কেমন আছেন আলতাফ ভাই?
আমার চেয়ে এক বছরের ছোট হলেও আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। স্বাভাবিকভাবেই শবনম আমাকে তুমি করে বলত। এখন আপনি করে বলছে! 
—তুমি তো এখনো তরুণী আছ দেখছি।
—আপনার শরীর কিন্তু একদম ভেঙে গেছে বলে মনে হচ্ছে আলতাফ ভাই!
—হ্যাঁ। ছয় মাসে আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছে। বলতে পারো বোনাস পিরিয়ডে বেঁচে আছি। এত দিনে আমার কবরের ওপর ঘন দূর্বাঘাস গজিয়ে যেত।
—বালাই ষাট! কী যে বলেন! আপনার কথা কতজনের কাছে শুনি।
—শোনো!
—হ্যাঁ। আপনি তো অনেকেরই হৃদয় হরণকারী। তারা ফেসবুকে আপনার নামে প্রশংসা করে কত কথা লেখে। আমি পড়ি, আর খুব আনন্দ হয়।
—সত্যিই আনন্দ হয়?
—বাহ! আনন্দ হবে না। আপনি আমার ছোটবেলার খেলার সাথি ছিলেন।
—তোমার মনে আছে সেসব কথা? কী সুন্দর তিনরঙা একটা ছাতা নিয়ে তুমি স্কুলে আসতে! দুই পাশে দুটি বেণি। তখন আমরা ফাইভে পড়তাম। তুমি ঠিক প্রিন্সেসের মতো দেখতে ছিলে! ক্লাসে সবাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইত! তুমি গম্ভীর থাকতে। কিন্তু তুমি যদি কারও সঙ্গে কথা বলতে, ক্লাসের সবাই তাকে খুব সমীহ করত। ঈর্ষাও করত। 
শবনম খিল খিল করে হেসে ওঠে। বলে, তার মানে তোমাকে সবাই ঈর্ষা করত?
আমি হাহ-হাহ করে প্রাণ খুলে হেসে উঠি। চোখের কোণে জল জমে ওঠে। শবনম কোন ফাঁকে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।
শবনম বলে, তুমি তো দারুণ হাসতে পারো! এভাবে যে হাসতে পারে তার আবার হার্টের সমস্যা হয় নাকি?
—আমার হার্টের সমস্যা তো অনেক দিন থেকেই। সেই এগারো বছর বয়স থেকে।
—তাই নাকি, জানতাম না তো!
—আমিও তো জানতাম না। অনেক পরে জেনেছি।
—ট্রিটমেন্ট করেছ নিশ্চয়ই।
—হ্যাঁ। সেই ট্রিটমেন্ট করতেই তো তোমার কাছে আসা!
—মানে?
আমি আবার হো হো করে হেসে উঠি। কাজের মেয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে একবার দেখে যায়। সে হয়তো ভাবছে—কে এমন বেআক্কেলের মতো অন্যের বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে বিকটভাবে হাসছে!
শবনম বলে, তুমি যেন কী একটা দেখাবে বলেছিলে?
আমার হার্টবিট আবার বাড়তে থাকে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে অর্ধেক হয়ে যাওয়া একটা পুরোনো রংপেনসিল বের করি। যেন সাত রাজার ধন বের করছি। আমার হাত কাঁপতে থাকে। 
শবনমের দিকে ঝুঁকে বলি, এটার কথা তোমার মনে আছে?
—কী এটা?
—রংপেনসিল।
—রংপেনসিল?
—হ্যাঁ। তোমার মনে আছে?
—কী বলছ, বুঝতে পারছি না।
—তুমি একদিন ক্লাসে পেনসিল বাক্স থেকে এই পেনসিলটা বের করলে। আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, এত সুন্দার পেনসিল হয়! তুমি বললে, তোমার ভালো লেগেছে? যাও, তোমাকে এটা দিয়ে দিলাম। মনে পড়ে শবনম?
শবনম যেন অন্ধকারে পড়ল। খুব অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
—তোমার মনে নেই।
—না। একদমই মনে নেই। 
আমার বুক থেকে যেন ভুস করে দমকা হাওয়া বের হয়ে গেল।
—সত্যিই তোমার মনে নেই।
—ছোটবেলার এত কথা কি মনে থাকে? তুমি সেই রংপেনসিল কি হঠাৎ খুঁজে পেলে?
—না। হঠাৎ খুঁজে পাইনি। এটা আমি জমিয়ে রেখেছি। জীবন থেকে কত কিছু হারিয়ে গেল। কিন্তু এটাকে হারাতে দিইনি।
—সো ফানি!
—ফানি? তাই হয়তো! তুমি সেই যে পরের বছর চলে গেলে! তোমার বাবা বদলি হয়ে ঈশ্বরদী চলে গেলেন। 
—হ্যাঁ। তোমাকে কত দিন পর দেখলাম! প্রায় ৫৫ বছর পর!
—না। ফাইভের পরও তো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। মনে আছে? 
—কবে?
ঈশ্বরদী রেলমাস্টারের রুমে, মানে তোমার বাবার রুমে বসেছিলে তুমি। আমার বাবা আমাকে নিয়ে তোমার বাবার রুমে যায়। তখন আমরা টেনে পড়ি। তোমার বাবা আমাকে রসমালাই খাওয়ালেন। তোমার স্কুলে যাতায়াতের জন্য তোমাদের একটা প্রাইভেট রিকশা ছিল। তোমার বাবা বললেন, চাচি, মানে তোমার মা আমাকে দেখতে চেয়েছেন। তারপর সেই রিকশায় আমাকে নিয়ে তুমি তোমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। পথে কী অদ্ভুত কাণ্ডই না হলো! মনে পড়ে?
শবনম আবার যেন অন্ধকারে পড়ল। দ্বিধা জড়ানো গলায় বলল, তাই নাকি?
আমি অবাক হলাম। ফ্যাসফেসে গলায় বললাম, সত্যিই তোমার মনে নেই?
শবনব মাথা দোলাল—না, মনে পড়ছে না।
—তোমার সঙ্গে ঈশ্বরদী স্টেশনে তোমার বাবার রুমে দেখা হয়েছিল, সেটাও মনে নেই?
শবনম আনমনে বলল, তুমি বলার পর আবছা আবছা মনে পড়ছে। 
—রিকশায় করে আমরা যখন তোমাদের বাসায় যাচ্ছিলাম, তখন পথে হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। রিকশাওয়ালা আমাদের হুড তুলে দিয়ে দূরে একটা টং চায়ের দোকানের ঝাঁপের নিচে চলে গেল। ঝুম বৃষ্টিতে আমরা দুজন রিকশায় পাশাপাশি বসে রইলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল ওটা একপশলা বৃষ্টি। তখনই থেমে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি থামার আর নাম নেই। এমন বৃষ্টি হচ্ছিল যে দূরের সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেছিল। পলিথিন আর রিকশার হুডের বাধা ডিঙিয়ে বৃষ্টি আমাদের দুজনকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিচ্ছিল। তুমি খিলখিল করে হাসছিলে। তারপর বললে, হুড নামিয়ে দিই? এসো ভিজি। আমি বললাম, বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর হয়। তুমি কপট রাগে আমার দিকে তাকালে। তারপর আমি নিজেই হুড নামিয়ে দিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা দুজনে ভিজে একাকার হয়ে গেলাম! কী যে হ্যাভেনলি ছিল সে সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড!
শবনম হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, থামো থামো। তুমি এসব বানিয়ে বানিয়ে কী সব বলছ? পুরো সিনেমার মতো প্রতিটি সিন ডিটেইলস ব্রিফ করছ! স্বপ্ন দেখেছ নিশ্চয়ই।
আমার গালে কেউ যেন ঠাস করে থাপ্পড় মারল। ঠিক তখনই টুংটাং করে কলিং বেল বেজে উঠল।
কাজের মেয়ে গিয়ে দরজা খুলল। ঘরে ঢুকল স্যুট-টাই পরা কুঁজো আশি বছরের এক বৃদ্ধ।
আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম, কে? তোমার বাবা?
শবনম রেগে বলল, তুমি আমার বাবাকে চেনো না? ও আমার হাজবেন্ড—আবুল কালাম আজাদ।
আজাদ সাহেব এগিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে শবনমকে বললেন, কে? 
আজাদ সাহেব শবনমের পাশে বসার পর শবনম হেসে বলল, তোমাকে ওর কথা বলেছিলাম একদিন। আলতাফ মাহমুদ। আমার বাবার সহকারী ছিলেন ওর বাবা। আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
আজাদ সাহেব আমার দিকে তাচ্ছিল্য ভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা। চাইল্ডহুডের গল্প হচ্ছে!   
শবনম স্বামীর ডান হাত জড়িয়ে ধরে বলল, জানো! আলতাফ আমার প্রেমে পড়েছিল!
আজাদ সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। 
আমার কান যেন গরম হয়ে উঠল। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। আমার ভয় হতে লাগল শবনম এরপর হয়তো রংপেনসিলের গল্পটাও নির্মমভাবে খোঁচা দিয়ে বলবে! আমি বিব্রতকর হাসি দিয়ে বললাম, প্লেটোনিক লাভ! আমাদের ক্লাসের সবাই-ই শবনমের প্রেমে পড়েছিল।
আজাদ সাহেব শরীর কাঁপিয়ে হাসলেন। শবনমকে বললেন, তা আলতাফ সাহেবকে চা-কফি কিছু দাওনি?
আমি বললাম, না-না। আমি চা খাব না। রাতে আর ঘুম আসবে না। 
এই সময় কাজের মেয়ে এসে আমার সামনে কয়েক পদের মিষ্টি রেখে গেল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। শবনমের দিকে তাকিয়ে বললাম, আজ তাহলে উঠি।
শবনম বলল, ঠিক আছে। একটা মিষ্টি খেয়ে যাও।
—আমার হাই সুগার। যাই তাহলে!
শবনম উঠে দাঁড়াল। 
আমি দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই শবনম পেছন থেকে ডাকল, শোনো আলতাফ। এটা নিয়ে যাও।
রংপেনসিলটা ভুল করে রেখে যাচ্ছিলাম। সেটা শবনমের হাত থেকে নেওয়ার সময় ওর আঙুলের সঙ্গে আমা আঙুলের স্পষ্ট লেগে গেল। যেন বিদ্যুতের শক খেলাম। আমার কবরে এত দিনে ঘাস গজিয়ে যাওয়ার কথা, আগামী মাসে আমার নাতনির বিয়ে! আর আমার মনে যে এখনো এত পুলক লুকিয়ে ছিল—জানতাম না!
শবনম বলল, তোমার বড্ড ভোলা মন। 
আমি বললাম, তোমারও বড্ড ভোলা মন।
শবনম হাসল। তারপর দরজার আলো-আঁধারির মধ্যে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমার হৃদয়টা আবার কেঁপে উঠল যেন। সেই রিকশায় ভেজার সময় যেভাবে তাকিয়েছিল শবনম—সেই দৃষ্টি! 
শবনম কি তাহলে কিছুই ভোলেনি? আমি রংপেনসিলটা পকেট ঢোকাতে ঢোকাতে চোখের জল মুছলাম। যেন আবার নতুন করে শবনমের কাছ থেকে রংপেনসিলটা গিফট পেলাম!

Link copied!