‘বুদ্ধিজীবী’ কথাটি বাংলা ভাষায় ঠিক কখন হইতে চালু হইয়াছে জানি না, তবে সে বেশিদিন আগের কথা নয়। ঢাকায় ১৯২০ সালের দশকে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নাম দেওয়া হইয়াছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ সে আন্দোলনের দুই প্রধান নেতার একজন কাজী আবদুল ওদুদ। ১৯৫১ সনে প্রকাশিত তাঁহার বিশালকায় ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী শব্দটি পাওয়া যায় না। ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। এদেশের বুদ্ধিজীবীরা আজও বুদ্ধির মাঠে মোটের উপর আমদানিনির্ভর। শুদ্ধমাত্র শব্দের ক্ষেত্রে নয়, ধ্যানধারণার ক্ষেত্রেও তাঁহাদের এই আমদানি-নির্ভরতা—একান্ত অন্ধ না হইলে—আপনার চোখে না পড়িয়া যাইবে না।
প্রশ্ন উঠিবে বুদ্ধিজীবী কে বা কে নয়। এক প্রস্তাব অনুসারে সকলেই বুদ্ধিজীবী নয়। মাত্র কেউ কেউ বুদ্ধিজীবী। আরেক প্রস্তাব মোতাবেক মানুষ মাত্রেই বুদ্ধিজীবী। কেননা একমাত্র বুদ্ধির—যাহার অবিসংবাদিত প্রকাশ ভাষা—বলেই মানুষ প্রাণীজগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করিয়াছে। তবে কাজের কথা এই, বুদ্ধিজীবীর কাজ সকলেই করেন না। বুদ্ধিজীবীর কাজ কি? বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী বলিতে লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতি উচ্চ ব্যবসায়ী লোকদের বোঝানো হয়। তাঁহাদের পংক্তিতে শিল্পী, আইন-ব্যবসায়ী, চিকিৎসা-ব্যবসায়ী প্রভৃতিকেও ধরা হইয়া থাকে।
আবার উল্লেখ থাকে যে লেখক মাত্রেই বুদ্ধিজীবী বলিয়া গণ্য হইবেন না। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি এস্তেমাল না করিয়াও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাহার বিশিষ্টতা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ নিবন্ধে তিনি নির্দেশ করিয়াছিলেন: “যদি এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।” দ্বিতীয় প্রশ্ন উঠিয়াছে বুদ্ধিজীবী কি বিশেষ কোন শ্রেণীর নাম? অনেক লব্ধপ্রতিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ইহার উত্তর দিয়াছেন—না। তাঁহাদের মতে প্রত্যেক শ্রেণীরই নিজস্ব বুদ্ধিজীবী থাকে। যাহাদের নিজস্ব (ইংরেজি জবানে যাহাকে বলে অর্গানিক) বুদ্ধিজীবী থাকে না তাহারা বুদ্ধির জন্য অন্য কোন শ্রেণীর উপর নির্ভর করেন।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরাও সঙ্গত কারণে নানা শ্রেণীতে বিভক্ত এবং একই কারণে তাঁহারা দলে দলে শাসক শ্রেণীর সহিত যুক্ত হইয়াছেন। যে সকল সমাজে স্বাধীনতা সংগ্রাম বা বিপ্লবী আন্দোলন সফল হইয়াছে সেইসব সমাজের ইতিহাসে দেখা গিয়াছে বুদ্ধিজীবীরাই আপন আপন শ্রেণীর নেতৃত্ব দিয়াছেন। আর যে সকল সমাজে স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা বিপ্লবী আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে—অন্তত আপোসরফায় পৌঁছিয়াছে—সেখানে বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের তল্পিতল্পা বহন করিয়াছেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা অতিমাত্রায় রাষ্ট্রনির্ভর। এই নির্ভরতা শুরু হইয়াছিল পরাধীন ভারতবর্ষে অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত থাকার সময়। ইহার একটি কারণ এদেশে জাতীয় চেতনা বা জাতীয় সমাজ গড়িয়া উঠিবার আগেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। অতিবিকশিত রাষ্ট্রের এই ঐতিহ্যটা শুদ্ধমাত্র ইংরেজ আমলের নয়, তাহার ঢের আগের। ইংরেজরা এই দেশে যে রাষ্ট্রকাঠামো গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, ভারত, পাকিস্তান কি বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীগুলি সেই কাঠামোটাই অবিকল গ্রহণ করিয়াছেন। সত্যকার অর্থে নতুন রাষ্ট্র কেহই গঠন করেন নাই। আজও এই উপমহাদেশের বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের অধীনস্ত কর্মচারীর ভূমিকায় অভিনয় করিতেছেন। ভারত আর পাকিস্তানে কিংবা বাংলাদেশেও এখন পর্যন্ত সেই ঐতিহ্যই সমানে চলিতেছে।
মধ্যখানে—১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর—বাংলাদেশে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হইয়াছে। রাষ্ট্রের একাধিপত্য হইতে মুক্ত হইবার জন্য মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ বিদেশি সাহায্য সংস্থা বা ফাউন্ডেশনের সরাসরি কর্তৃত্বে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। ইহার পরিণতি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের জন্যই সুদূরপ্রসারী হইতে বাধ্য। দেখা যাইতেছে, বুদ্ধিজীবীরা এখন হয় নিজস্ব (অর্গানিক) কিংবা পরগাছা (বা প্রাতিষ্ঠানিক) এই দুই চরিত্রের কোন একটিতে—অথবা উভয়ের একটা খিচুড়িতে বিভক্ত হইয়া—বিরাজ করিতেছেন।
১
‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাঙলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাঙলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’—পঞ্চাশ বছর আগে এই কথাগুলি লিখিয়াছিলেন আহমদ ছফা। গত পঞ্চাশ বছরে তাঁহার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন তো দূরের কথা, বিদ্যমান কাঠামোই বরং আরো পাকাপোক্ত হইয়াছে।
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর হইতে নবেম্বরের মধ্যে প্রকাশিত মোট সতেরটি উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধের সংকলন আহমদ ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। প্রথম নিবন্ধেই তিনি যোগ করিয়াছিলেন: “আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়—প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালী হয়েছেন— সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম পাকিস্তান ইত্যাদিতে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাঙলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যাঁরা সারা জীবন কোনো কিছুতে যদি নির্দ্ধিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন—সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।”
গ্রন্থের ভূমিকা উপলক্ষে বদরুদ্দীন উমর মন্তব্য করিয়াছিলেন, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ “মূলতঃ বাঙলাদেশের মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদেরই একজনের স্বশ্রেণীর বিরুদ্ধে একটা নিঃশঙ্ক সমালোচনা”। ‘মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের একজন’ হওয়া সত্ত্বেও আহমদ ছফাকে এই সমালোচনা বাবদ কম মূল্য পরিশোধ করিতে হয় নাই। প্রথমবারের পঁচিশ বছর পর—১৯৯৭ নাগাদ—গ্রন্থটির দ্বিতীয় প্রকাশ উপলক্ষে তিনি লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন: “মাঝে মাঝে এমন চিন্তাও মনে আসে, লেখাটি যদি না লিখতাম, হয়তো আমার জীবন অন্যরকম হতে পারতো। এই লেখাটির জন্যই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর রোষ আমাকে পেছন থেকে অভিশাপের মতো তাড়া করেছে। অদ্যাবধি আমি জীবনে তৃপ্তি কি বস্তু তার সন্ধান পাইনি। আগামীতে কোনদিন পাবো, সে ভরসাও করিনে।” এই লেখার চারি বছরের মাথায়—২০০১ সালে—আহমদ ছফা মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন। লাশে পরিণত হইবার পরও ‘একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর রোষ’ হইতে তিনি পরিত্রাণ লাভ করেন নাই। অনেক চেষ্টাচরিত্র করিয়াও আমরা তাঁহাকে কবরস্থ করার মতো সাড়ে তিন হাত জায়গা মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরগাহে পাই নাই।
এই ‘একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী’ সম্প্রদায়ের পেছনে রাষ্ট্রের পরোক্ষ হাতটাও তিনি প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। ১৯৯৭ সালে—‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থের নতুন ভূমিকাচ্ছলে—তিনি লিখিয়াছিলেন: “এই গ্রন্থে যে সকল মতামত প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো বাহাত্তর সালে যতটা প্রাসঙ্গিক এবং সত্য ছিল, এই সাতানব্বই সালে তাদের তাৎপর্য ক্ষুন্ন না হয়ে বরং অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।” পঁচিশ বছর পর—অনেকটা রোমন্থনের ভঙ্গিতে—ত্রিকালদর্শী তিরেসিয়সের মতো আহমদ ছফা যাহা উচ্চারণ করিয়াছিলেন তাহা আজ পর্যন্ত—পরবর্তী পঁচিশ বছরেও—সমান অকাট্য রহিয়াছে।
“সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে”, আহমদ ছফা লিখিয়াছিলেন, “জাতীয় মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা—এই রাষ্ট্রীয় চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে ফেলেছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে তোষামোদ, চাটুকারিতা, নির্লজ্জ আত্মপ্রচার মানুষের সুস্থ কাণ্ডজ্ঞানকে একরকম মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল। সন্ত্রাস, গুম, খুন, ছিনতাই, দস্যুতা, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচার হত্যা—এগুলো একান্তই নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষের হনন প্রবৃত্তি, লোভ-রিরংসার এরকম নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশের সিংহদুয়ার খুলে দেওয়ার ব্যাপারে তৎকালীন সরকার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এই ধরনের একটি মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই একটি পালনীয় ভূমিকা ছিল, একটা দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তাঁরা সেদিন তাঁদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব-কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে যাবতীয় অমানবিক কর্মকাণ্ডে সরকারের মদদ দিয়ে নিজেদের আখের গোছাবার কাছে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।”
১৯৯৭ সালের পর—এই ২০২২ সাল নাগাদ—আরো পঁচিশ বছর পার হইয়াছে। চারিপাশে যাহা ঘটিতেছে তাহা দেখিয়া মহাপ্রাণ আহমদ ছফা ঐ বছর যাহা লিখিয়াছিলেন পরের পঁচিশ বছরে কি তাহার কোন গুণগত পরিবর্তন হইয়াছে? যদি কিছু হইয়া থাকে তাহা নেহায়েতই পরিমাণগত পরিবর্তন। বৃদ্ধি পাইয়াছে শুদ্ধ কণ্ঠস্বরের উত্তাপটুকুন। আহমদ ছফার রচনা—যাহাকে বলা যায় ইতিহাসের প্রগাঢ় সমাচার—আরো একটু উদ্ধার করার দরকার আছে: “বর্তমানে সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা যে ভূমিকাটি পালন করছেন, তা কিছুতেই বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে আওয়ামী-বাকশালী বুদ্ধিজীবীরা যে কাপুরুষোচিত ভূমিকা পালন করেছে, তার চাইতে বেশী আলাদা নয়। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় বাহাত্তর-তেয়াত্তর সাল থেকে টাইম মেশিনে চড়ে তাঁরা এই সাতানব্বই সালে পদার্পণ করেছেন। বাহাত্তর সালে তাঁরা যেভাবে, যে ভাষায় অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলতেন, বাঙালী সংস্কৃতির কথা বলতেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতি অঙ্গীকার প্রকাশ করতেন—এই সাতানব্বই সালেও তাঁরা একই ভাষায় সেই পুরোনো বুলিগুলো উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। পরিবর্তন যেটুকু হয়েছে
তাঁদের কণ্ঠস্বর এখন অধিকতরো দ্বিধা এবং জড়িমাহীন।” পরের পঁচিশ বছরে এই কণ্ঠস্বরটি শুদ্ধ দ্বিধাহীন নয়, পরম নির্লজ্জ, এবং বেপরোয়াও হইয়াছে।
২
এই অপরাধজনক মনোভাবের—এই কপট কণ্ঠস্বরের—ফলাফল কি হইয়াছে তাহার পুনরুল্লেখ সংক্ষেপেই করা যাইতে পারে। বর্তমানে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ পরম অপমানিত হইয়াছে, আর স্বভাবতই তাহার সত্য ইতিহাস চরম উপেক্ষিত হইতেছে। এই অপরাধে মধ্যশ্রেণীভুক্ত একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের দায়ও কম নয়। বুদ্ধিজীবীরা কতগুলি সত্য যেন বেশি বেশি আড়াল করিতেই বেশি তৎপর। কি রাষ্ট্রের উদ্যোগে কি বুদ্ধিজীবীদের প্রবর্তনায় ১৯৪৭ সালের আগের— অনেক দীর্ঘদিনের—পরাধীনতা বিরোধী গণবিদ্রোহ কিংবা সর্বসাধারণ রাজনৈতিক সংগ্রামের কোন খবর পর্যন্ত নাই, উদ্যাপন তো দূরের কথা। তাঁহারা ভুলিয়া গিয়াছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস মাত্র ১৯৪৭ সালের পর শুরু হয় নাই।
সুদূর অতীতে না গিয়া অন্তত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের আর কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস আমল করা ছাড়া আজিকার বাংলাদেশের আগা কিংবা গোড়া কোনটাই বোঝা যাইবে না। এখন যে ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে এই দেশের পরিসর তাহা তো ১৯৪৭ সালেই নির্ধারিত হইয়াছিল। সেই সীমানা শুদ্ধমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দান বলিলে কথাটা সম্পূর্ণ হয় না, মানিতে হইবে ইহার মধ্যে রাজা রামমোহন রায় হইতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত লব্ধপ্রতিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদেরও একটা ভূমিকা ছিল। ভুলিলে চলিবে কি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত—‘আমার সোনার বাংলা’—১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন উপলক্ষে রচিত হইয়াছিল?
১৯৪৭ সালের উত্তাপের মধ্যে ১৯০৫ সালে সৃষ্ট পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের অধিকাংশ মানুষ প্রবল আবেগে—বুঝিয়া বা না বুঝিয়াই—পাকিস্তানে যোগ দিয়াছিলেন। তাহারা চাহিয়াছিলেন স্বাধীনতা এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার। আর মাত্র পাইয়াছিলেন ‘পোকায় কাটা’ পূর্ব পাকিস্তান। গালিচার নীচে চাপা দিয়া নয়, এই সত্য বিশ্লেষণ করিয়াই বুদ্ধিজীবীরা আগাইবেন। ইহা আশা করা কি অন্যায়? পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ‘ধর্মতান্ত্রিকতা’ বা ঐ জাতীয় কোন আদর্শের জয় ছিল না। ছিল বাংলাদেশের জনসাধারণের জাতীয় স্বার্থ বা জাতীয় আত্মপরিচয় আদায়ের লড়াই মাত্র। ১৯৪৯ সালের পর যাঁহারা আওয়ামী মুসলিম লীগ—কিংবা খানিক পরে আওয়ামী লীগ—গঠন করিয়াছিলেন তাঁহারা সকলেই তো পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রণী নেতা ছিলেন। এ কথা অস্বীকার করিয়া চলা মানে কল্পনার রাজ্যেই বসবাস করা—বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার, জাতীয় স্বাধীনতার সত্যকার একটি গোড়ার কথা অস্বীকার করা।
আরো একটা কথা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত হইলেও রাষ্ট্রস্বরূপ পাকিস্তান ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় নাই। ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় নাই বলিয়াই—চূড়ান্ত অবিচার, নির্যাতন এবং কদাকার শোষণ চালু থাকার কারণেই—অতি অল্পদিনের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের মোহভঙ্গ হইয়াছিল। এতদিনে পরিষ্কার হইয়াছে যে কোন ধর্মই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল না। ধর্মই যদি পাকিস্তানের ভিত্তি হইত তো অত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারিত না। তাহার আরেক প্রমাণ—পাকিস্তান গিয়াছে, কিন্তু ইসলাম ধর্ম যেখানে ছিল সেখানেই আছে। ন্যায়বিচারের দাবি হইতেই গড়িয়া উঠিয়াছিল বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা। আমার এই যুক্তির পক্ষে প্রমাণ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ঘোষণাপত্রে উচ্চারিত তিন অঙ্গীকার: ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’।
আহমদ ছফার পর্যবেক্ষণ যদি অসত্য না হইয়া থাকে তবে মানিতে হয়, বাহাত্তর হইতে পঁচাত্তর সালে সরকার এই জাতীয় চেতনার বা জাতীয় স্বাধীনতার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করিতে কিংবা—তাঁহার জবানে বলিতে—‘একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে’ পর্যন্ত পারেন নাই। এই ঘটনার ফলাফল শুদ্ধ ১৯৭৫ সালের ট্রাজেডি নয়, সেই ফলাফল আরো সুদূরপ্রসারী হইয়াছে। বুদ্ধিজীবীরা এই ট্রাজেডি হইতে কোন শিক্ষাটা গ্রহণ করিয়াছেন? যদি আদৌ কোন শিক্ষা গ্রহণ করিতেন তবে এখন তাঁহারা যে প্রহসনে অভিনয় করিতেছেন তাহা অন্তত করিতেন না।
আহমদ ছফার অপরাধ তিনি এই নির্জলা সত্য কথাগুলি সর্বসাধারণের বোধগম্য ভাষায় লিখিয়াছিলেন: “একজন ব্যক্তির মৃত্যুতে একটা জাতির সমগ্র জনগণের জাগ্রত আকাঙ্ক্ষার যখন পরাজয় ঘটে, তখন স্বভাবতই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাঁরা যে আদর্শের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে ভিতটিই ছিল নাজুক, দোদুল্যমান এবং দুর্বল। আওয়ামী লীগ দলটি শুরু থেকে জাতির গঠন প্রক্রিয়ায়, জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে, সমাজের আন্তঃসম্প্রদায় সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায়, সমাজের অবহেলিত এবং নির্যাতিত অংশের মানুষকে দেশগঠন এবং জাতিগঠনে অংশভাগী করে তোলার ব্যাপারে কোনরকম রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেনি।”
আওয়ামী লীগের অদূরদর্শিতা এবং সংকীর্ণ দলীয় বা শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ‘মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার’ মাঠে মারা গিয়াছে। সামরিক শাসন বা সাম্প্রদায়িক ধর্ম-ব্যবসায় কোনটাই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল না—হইতেও পারিত না। সত্য বলিতে কি বাহাত্তর হইতে পঁচাত্তর সালের মধ্যে যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা কার্যত মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার হইতে অনেক দূরে সরিয়া গিয়াছিল। তাহার পর হইতে দীর্ঘদিন—একভাবে না অন্যভাবে—সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা দখল করিয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহারা নিজেদের ক্ষমতা শক্তিশালী করিবার জন্য দক্ষিণপন্থী ও ধর্ম-ব্যবসায়ী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করিয়াছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধের সময় যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা যথানিয়মে খণ্ডবিখণ্ডও করিয়াছিলেন।
৩
দক্ষিণপন্থী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতার পথ হইতে সামরিক শাসকদের উত্তরসুরিরাও সরিয়া আসেন নাই—আহমদ ছফার এই পর্যবেক্ষণ বড়ই তীক্ষ্ণধী, একান্তই ব্যতিক্রমধর্মী। মনে রাখা প্রয়োজন, ‘বুদ্ধিজীবীরা মিথ্যা বলেন’—কথাটি যিনি বলিয়াছিলেন তিনিও ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী। এখন আপনিই স্থির করুন বুদ্ধিজীবীরা আসলে কি বলেন—তাঁহারা কি মিথ্যা বলেন, নাকি বলেন না? ‘বুদ্ধিজীবীরা মিথ্যা বলেন’—এই কথাটি যদি মিথ্যা না হয় তো ‘বুদ্ধিজীবীরা মিথ্যা বলেন’—কথাটা সত্য নয়, কেননা অন্তত একজন বুদ্ধিজীবী তো মিথ্যা বলেন নাই। আর উদ্ধৃত কথাটি যদি মিথ্যা হয় তো সিদ্ধান্ত করিতে হয় ‘বুদ্ধিজীবীরা মিথ্যা বলেন না’। অর্থাৎ আপনি যাহাই ধরিয়া লইবেন আপনার সিদ্ধান্ত হইবে তাহা নয়, তাহার বিপরীত। এই ধাঁধা হইতে বাহির হইবার পথ কি? পথ একটাই। সকল বুদ্ধিজীবী মিথ্যা বলেন না—একথা স্বীকার করা। কে সেই বুদ্ধিজীবী। জানিয়া রাখিবেন, বাংলাদেশে অন্তত একজন আছেন তিনি মিথ্যা বলেন না। তিনি আহমদ ছফা। তিনিই সেই লোক।
নিয়মের অতিক্রম আহমদ ছফা—১৯৮৯ সালে—‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (দ্বিতীয় খণ্ড)’ নামক অন্য একটি লেখায় যাহা লিখিয়াছিলেন তাহাও এখন পর্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক হইয়া যায় নাই: “আজকে এখানে সেখানে ধর্মবাদী শক্তির যে প্রচণ্ড উৎপাত লক্ষ করা যাচ্ছে তারও বিকাশ হয়েছে সামরিক শাসনের পক্ষপুটে। দক্ষিণপন্থী শক্তির যে উত্থান তা সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে ঘটেনি। সামরিক সরকার তাদেরকে অন্ধকার গর্ভগুহা থেকে তুলে এনেছেন—এ কারণে যে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করবে। দক্ষিণপন্থী শক্তিসমূহের সঙ্গে স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের একটা মৌলিক মিল এখানে যে তারা উভয়েই জাতীয়তাবাদী
রাষ্ট্রচেতনার বিরোধী। সামরিক সরকার জাতীয়তাবাদের অবসানের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকে। মৌলবাদ জাতীয়তাবাদকে পরাজিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার উচ্চাকাক্সক্ষা পোষণ করে। আজকের বাংলাদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করা হয়েছে, তার কারণ শাসকদের ইসলামপ্রীতি নয়। তারা জাতীয়তাবাদকে সার্বক্ষণিকভাবে পর্যুদস্ত করতে চায়।”আওয়ামী লীগের মধ্যে যেমন এতদিনে আর কোন ‘আওয়াম’ অবশিষ্ট নাই তেমনি ‘জাতীয়তাবাদী দল’ বা ‘জাতীয় পার্টি’ প্রভৃতির মধ্যেও নাই কোন জাতীয় চেতনার চিহ্ন—বাংলাদেশের ইতিহাসে ইহাই পরম পরিহাসের বিষয়। ধর্মীয় আবেগ কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রাদর্শের গালভরা বুলি তো পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্য বজায় রাখিতে পারে নাই। কারণ সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায় নাই। সেই পুরাতন ভুল দিয়া বাংলাদেশ গড়া যাইবে বলিয়া যাহারা স্বপ্ন দেখিতেছেন তাহারা কিন্তু নতুন ভুল করিতেছেন। যে জাতি “স্মরণকালের ইতিহাসে সবচাইতে ব্যাপক জনযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে”—স্বৈরাচারী ও দখলদার পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় মদদদাতাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করিয়া—স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে সেই জাতি আজ পরাজিত, আজ সে শুদ্ধমাত্র শ্রেণীস্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি হইতেছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যাহারা পরাজিত হইয়াছিলেন তাহাদের সম্পর্কে আহমদ ছফা সেই ১৯৮৯ সালে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা আজও ধ্রুব: “বর্তমানে চারদিকে যে মৌলবাদী তৎপরতা এবং তাণ্ডব লক্ষ করা যাচ্ছে এটা তাদের শক্তি নয়, পরাজিত মানসিকতারই অধিক পরিচায়ক। যেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং আমাদের জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে ঘরের শত্রু বিভীষণের ভূমিকা পালন করেছে— সেই লজ্জা, সেই কলঙ্ক, সেই গ্লানি ঢাকার জন্য তারা তড়িঘড়ি কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলে পরাজিত বিবেকের কলঙ্কচিহ্ন ঢেকে দিতে চাইছে। ইতিহাসে ভ্রমসংশোধনের অবকাশ আছে। কিন্তু নতুন ভ্রম দিয়ে পুরনো ভ্রম ঢাকা দেয়ার কোন অবকাশ নেই।” যাহারা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করিয়া এই জাতিকে পরনির্ভর ধনতান্ত্রিক স্বার্থের অধীনতা পাশে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করিতেছেন তাহাদের হাত হইতে জাতিকে সহজেই মুক্ত করা যাইবে না। ইহাদের বড় সহায়ক হইয়াছে উদীয়মান বা নবগঠিত ধনিক শ্রেণী।
তাই আরেকবার বলিতেছি: স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসনের পক্ষপুটে শুদ্ধমাত্র ধর্ম-ব্যবসায়েরই পুনরুত্থান ঘটে নাই, সর্বগ্রাসী বৈদেশিক সংস্থার সহায়তাপুষ্ট বুদ্ধিজীবীদের একটি গোষ্ঠীও গড়িয়া উঠিয়াছে। তাহাদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন সংস্থাগুলির নামের দিকে তাকাইলেও প্রকৃত ঘটনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাহাদের নামের মধ্যে ইংরেজি বর্ণমালা হইতে লওয়া আদ্যাক্ষরের ছড়াছড়ি। ১৯৭১ সালের পরে নব্য পরাধীনতা-ব্যবসায়ী পাশ্চাত্যের অনুকরণে বাংলাদেশে ‘সিবিল সোসাইটি’ (বা ইঁহাদের অনুসৃত বানানে ‘সিভিল সোসাইটি’) শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় প্রধানত ইংরেজিনবিশ—কেহ কেহ বিদেশফেরত—বলিয়া তাহারা এই দুই শব্দের বাংলায় অনুবাদ করিলেন ‘সুশীল সমাজ’। দেখা গিয়াছে, এই অনুবাদ কোন কোন রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বক্তৃতা-বিবৃতিতে এস্তেমাল করিয়াছেন।
বুদ্ধিজীবীদের নতুন ভ্রমের ইহা সামান্য উদাহরণ মাত্র। কোন বিষয়ে জ্ঞানের অভাব থাকা অপরাধ নয়। পৃথিবীর সমস্ত বিষয় জানা কিংবা মুখস্ত করিয়া রাখা আমার কর্তব্য হইতে পারে না। কিন্তু যাহা আমার নিজেরও অগম্য তাহা দশজনের মধ্যে দ্বিধাহীন কিংবা বা জড়িমাহীন কণ্ঠে প্রচার করা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইতে পারে। ‘সিবিল সোসাইটি’ পদটির ‘সুশীল সমাজ’ অনুবাদ সেই ধরনের একটি অপরাধ কিনা ভাবিয়া দেখিতে অনুরোধ করিব। যে কোন শব্দ একটি ভাষায় একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে। কোন অর্থটি বর্তমান প্রয়োগে প্রাসঙ্গিক তাহা না জানিয়া অনুবাদ করিলে এই রকম অনেক সুন্দর সুন্দর ভ্রমের উদ্ভব হইবে।
‘সিবিল’ শব্দের গোড়ার অর্থ ‘নগর-সংক্রান্ত’। সুতরাং ‘রাষ্ট্র-সংক্রান্ত’—সুতরাং ‘জাতি-সংক্রান্ত’—এই অর্থে জাতীয়। তাই সিবিল সোসাইটি মানে ‘জাতীয় সমাজ’ বা (পিছন ফিরিয়া বলিতে পারেন) ‘নাগরিক সমাজ’। ইহা কোনক্রমেই ‘সুশীল সমাজ’ হইতে পারে না। নাগরিক বা রাষ্ট্রবাসী (অর্থাৎ আইনের অধীন বা অনুগত প্রজা) মাত্রেই সম্প্রসারিত অর্থে ভদ্রলোক হইবেন ধরিয়া লওয়া যায়। এই অর্থে ‘সুশীল’ কথাটি তাহার লক্ষণা মাত্র। এই উদাহরণটা টানিলাম, বাংলাদেশের উচ্চশ্রেণীর কি উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মার্গগামিতার সাফাই সাক্ষ্যস্বরূপ। তাঁহারা অন্য জায়গায় আছেন। তাঁহাদের মনোভূমি অন্যত্র যাহা জন্মভূমি বাংলাদেশের অধিক সত্য। ইঁহারা কি আদৌ দেশের হিতচিন্তা করিতে পারেন? আমার বিশ্বাস হয় না। তাঁহারা ভাবিতেও পারেন না বাংলা ভাষায় সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভ করা যায়। শ্রেণীস্বার্থের প্রয়োজনে তাঁহারা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়াছেন।
৪
পরিশেষে, আর একটি মাত্র উদাহরণ দিয়া এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের উপসংহার টানিতেছি। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার কি নিদারুণ দীনহীন দশা ‘সুশীল সমাজ’ শব্দবন্ধটি তাহার এক বিয়োগান্ত উদাহরণ। আর একটি উদাহরণ পাওয়া যাইবে লব্ধপ্রতিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহৃত ‘জৈব বুদ্ধিজীবী’ শব্দের মধ্যে। ইতালির মহাপ্রাণ আন্তনিয়ো গ্রামসির লেখার ইংরেজি অনুবাদে ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’ বলিয়া একটা কথা পাওয়া যায়। ইংরেজি ‘অর্গান’ বা অঙ্গ হইতে এই ‘অর্গানিক’ বিশেষণটি আসিয়াছে। আর বাংলাদেশের ‘সুশীল সমাজ’ ইহার তর্জমা করিয়াছেন ‘জৈব বুদ্ধিজীবী’ বলিয়া। বোঝা যাইতেছে, তাঁহারা জৈব সার—অর্থাৎ জৈব সার (বা গোবর) দিয়া উৎপাদিত তরিতরকারি—বেশি বেশি ভোজন করিয়া থাকেন।
আরও একটি প্রবণতা দেখা দিয়াছে যাহার মধ্যে প্রাদুর্ভাব ঘটিতেছে প্রহসনের। ১৯৭১ সনের বীরত্বব্যঞ্জক সংগ্রামের ঐতিহ্য পঞ্চাশ বছর না যাইতেই আজ ব্যঙ্গবিদ্রুপের স্বীকার হইতেছে। একটি উদাহরণ দিতেছি। দেশের একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় সম্প্রতি একটি দুই পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপন প্রচ্ছদের উপর ভাঁজ করিয়া ছাপা হইয়াছে। সম্প্রতি—মানে এই ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে—বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের একান্ন বছরের মাথায় ঘটিয়াছে এই ঘটনা। সেই বিজ্ঞাপনে যে সকল শব্দ বাংলা হরফে ছাপা হইয়াছে তাহা লক্ষ করিলেই দেখা যাইবে গত পঞ্চাশ বছরে বুদ্ধিবৃত্তির জগতে কোন প্রতিবিপ্লবটি ঘটিয়া গিয়াছে।
এই বিজ্ঞাপনের মাত্র দ্বিতীয় পৃষ্ঠার অন্তর্গত শব্দগুলি তুলিয়া দিতেছি: “লোয়ার গ্রাউন্ড ফ্লোর: ইউনিমার্ট; গ্রাউন্ড ফ্লোর: ফ্ল্যাগশিপ স্টোর; লেভেল ১: মেনসওয়্যার; লেভেল ২: উইমেন’স কালেকশন ওয়েডিং এন্ড জুয়েলারি; লেভেল ৩: সুজ, লেদার গুডস এন্ড হোম ডেকর; লেভেল ৪: মোবাইল এন্ড গ্যাজেটস; লেভেল ৫: ফুড কোর্ট; লেভেল ৬: এন্টারটেইনমেন্ট এন্ড মুভি হল।” প্রথম পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ এই বাণী: “শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে ৯,৫৯,৯০০ স্কয়ার ফিট বিশিষ্ট ইউনাইটেড গ্রুপের সেন্টারপয়েন্ট ঢাকার সেরা শপিং এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে তৈরি হচ্ছে আপনার জন্য। শহরের কমার্শিয়াল সেন্টারে ব্যবসা করতে পছন্দের স্পেসটি বুকিং করুন আজই।” বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত রোমান হরফে লেখা শব্দগুলি আর নকল করিলাম না। এই বিজ্ঞাপন ছাপা হইয়াছে যে পত্রিকার কল্যাণে তাহার সম্মানে আমরাও সাধু ভাষায় বাহবা দিয়া বলিতে পারি: ‘যাহা কিছু ভালো তাহার সঙ্গে প্রথম আলো’।
‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় যাহা ছাপা হইয়াছে তাহাই এখন নিয়ম—ইহার যম হওয়া খুব সামান্যসংখ্যক বুদ্ধিজীবীরই বুদ্ধিতে কি সাধ্যে কুলাইবে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীরা কি শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষাটি পরিত্যাগ করিয়াছেন? লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় বাংলা ভাষা কিংবা সাহিত্যের কি হইল তাহাতে বর্তমান কালের প্রাতিষ্ঠানিক বা পরগাছা বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ পশ্চাদব্যথা নাই। গোঁফ দেখিয়া যদি বিড়াল চেনা অসম্ভব না হয় তো উপরে বর্ণিত ঘটনা দেখিয়াও বিড়ালটি চিনিতে পারিবেন। দুঃখের মধ্যে, এই বিড়াল ইঁদুর ধরিবে কিনা বলা সম্ভব নয়। শুদ্ধমাত্র এইটুকু বলিতে পারি, বঙ্কিমচন্দ্রের উপলব্ধি ‘বাঙ্গালা সাহিত্য, বাঙ্গালার ভরসা’ ইঁহাদের গাত্র স্পর্শ করে নাই।
১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা—দেশি না বিদেশি অর্থনির্ভর—এই অর্থে দুই ভাগে ভাগ হইয়া গিয়াছেন। একদল—ইঁহারা সংখ্যায় যতই বেশি হউন না কেন শক্তিতে দুর্বল—বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় লিখিতে পারেন না। ইঁহাদের মধ্যে বেশির ভাগই রাষ্ট্রের বাঁটিয়া দেওয়া ভোগ খাইয়া প্রাণধারণ করেন। দ্বিতীয় দলটি—ইঁহারা সংখ্যায় স্বল্প হইলেও শক্তিতে প্রবল—প্রধানত ইংরেজিতেই লিখিয়া-পড়িয়া থাকেন। ১৯৬০ সালের দশকে—জাতীয় আন্দোলনের দিনে—বর্তমান বাংলাদেশের চৌহদ্দিতে বিদেশি তহবিলসমৃদ্ধ কোন ফাউন্ডেশন বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ-সহায়তা গ্রহণে আগ্রহী বা সমর্থ বুদ্ধিজীবী ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। আর ইংরেজি ২০০০ সালের মধ্যে এই ধরনের সাহায্য গ্রহণে আগ্রহী নন এমন বুদ্ধিজীবী খুঁজিয়া পাওয়াই মুশকিল। এই কয়েক দশকের মধ্যে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়াছে।
আজিকার বাংলাদেশে লব্ধপ্রতিষ্ঠ কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সংশ্লিষ্ট গবেষক বা বুদ্ধিজীবী খুব কমই পাওয়া যাইবে যিনি গবেষণা বা পরামর্শের নামে এয়ুরোপ কিংবা উত্তর আমেরিক ভিত্তিক কোন না কোন ফাউন্ডেশনের বখশিস গ্রহণ করেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ অধ্যাপক জেমস পেট্রাস দক্ষিণ আমেরিকা সম্পর্কে একদা (আজি হইতে কিছু বেশি তিরিশ বছর আগে) যাহা উৎকীর্ণ করিয়াছিলেন তাহা আজিকার বাংলাদেশের বেলায়ও—মনে হইতেছে—ষোল আনা সত্য: “আর যাহাদের এখন পর্যন্ত সেই টাকা দেওয়া হয় নাই তাহা এই কারণে নয় যে তাহাতে তাহাদের আপত্তি আছে, আসলে তাহারা এখন পর্যন্ত যথাযথ সংযোগ বা যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া সারেন নাই।”
দোহাই
১. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন,’ বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল কর্তৃক সম্পাদিত (কলিকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৪০৯), পৃ. ২৩৬-৩৭।
২. কাজী আবদুল ওদুদ, শাশ্বত বঙ্গ (ঢাকা: ব্র্যাক প্রকাশনা, ১৯৮৩)।
৩. আহমদ ছফা, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (ঢাকা: প্রকাশ ভবন, ১৩৭৯)।
৪. আহমদ ছফা, ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, আহমদ ছফা রচনাবলি, ৬ষ্ঠ খণ্ড, নূরুল আনোয়ার কর্তৃক সম্পাদিত (ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮), পৃ. ১৫১-২১০।
৫. আহমদ ছফা, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (দ্বিতীয় খণ্ড)’, আহমদ ছফা রচনাবলি, ৮ম খণ্ড, নূরুল আনোয়ার কর্তৃক সম্পাদিত (ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮), পৃ. ৩৩৪-৩৫০।
৬. প্রথম আলো, ঈদ সংখ্যা ২০২২, মতিউর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত (ঢাকা: বৈশাখ ১৪২৯, এপ্রিল ২০২২)।
7. James Petras, ‘Metamorphosis of Latin America’s Intellectuals,’ Economic and Political Weekly, vol. 24, no. 14 (April 8, 1989), pp. 719-722.