• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
শার্ল বোদলেয়ার

পারির পিত্ত: পাঁচবারের ছয়


সলিমুল্লাহ খান
প্রকাশিত: মে ৪, ২০২২, ০৫:১৬ পিএম
পারির পিত্ত: পাঁচবারের ছয়

মুখবন্ধ

আজ ‘পারির পিত্ত’ পুস্তকের পঞ্চম কিস্তিস্বরূপ আরো ছয়টি গদ্য কবিতার (২৫-৩০) বাংলা তর্জমা ছাপা হইল। শার্ল বোদলেয়ারের এই কবিতাগুলির মধ্যে যে ব্রত উদযাপিত হইয়াছে তাহাতে আছে দাসপ্রথা ও পরাধীনতা ব্যবসায়ের তির্যক বিচার। ‘সুন্দরী ডরোথি’ কবিতার ডরোথি কোন এক ফরাশি উপনিবেশের বাসিন্দা। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর ফরাশিদেশের উপনিবেশগুলিতে ক্রীতদাসদের মুক্তি দিবার যে বিধান চালু হইয়াছিল তাহার আওতায় ডরোথিও স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিলেন। এয়ুরোপিয়া দাসপ্রথার ব্রত অনুসারে ক্রীতদাসদের পায়ে জুতা পরার অনুমতি ছিল না। কিন্তু কথায় যেমন বলে—স্বভাব যায় না ম’লে। স্বাধীনতা লাভ করিবা সত্ত্বেও ডরোথি জুতা পরিতে শুরু করেন নাই। বক্রোক্তিরসিক শার্ল বোদলেয়ার ঘটনার সার করিয়াছিলেন এই বাক্যে: “ডরোথি এতই প্রতিভাময়ী গরবিনী যে তাহার স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবটা ছাড়াইয়া উঠিয়াছে লোকনন্দিত হইবার আনন্দ, তাই স্বাধীন হইবার পরও সে হাঁটিতেছে খালি পায়ে।”

বলা নিষ্প্রয়োজন নয়, দাসদের স্বাধীনতাও নিতান্ত বিনামূল্যে লভ্য ছিল না। ডরোথি নিজের স্বাধীনতা পাইলেও এই কবিতার কাল পর্যন্ত তাহার ছোটবোনটি কিন্তু স্বাধীন হয় নাই। বোদলেয়ারের বক্রোক্তি এইক্ষেত্রে যথার্থ: “ডরোথির ভক্ত সকলেই আর সকলেই তাহাকে চায়, আর সেও ষোল আনা সুখী বোধ করিত যদি না সে মাত্র এগার বছর বয়সের—অথচ ইতিমধ্যেই সাবালক, ভারি সুন্দরী—বোনটিকে ছাড়াইয়া লইবার স্বার্থে তিল তিল পাইপয়সার উপর পাইপয়সা জমাইতে বাধ্য হইত!”

শার্ল বোদলেয়ার ১৮৪৮ সালের বিপ্লবে সক্রিয় হইয়াছিলেন ব্যারিকেডের যোদ্ধার ভূমিকায়। তাঁহার কবিতার বিষাদ সেই বিপ্লবের পরাজয়বরণের স্মারক হিসাবেও গণ্য হইতে পারে। ১৮৫০ সালের পর হইতে ফরাশিদেশে নবোদিত ধনতন্ত্রের কোন বৈশিষ্ট্যই বোদলেয়ারের চোখ এড়াইয়া যায় নাই। ক্রমবর্ধমান শ্রেণীবৈষম্য আর শ্রেণী সংগ্রাম তাঁহার দৃষ্টিতে ধরা পড়িয়াছে অন্য সেরেস্তায়। উদাহরণস্বরূপ ‘গরিবের চোখ’ কবিতাটি লওয়া যাইতে পারে। নব্য ধনতন্ত্রের সৃষ্ট শ্রেণীবিভেদ মনোজগতের বিভাজন আকারেও দেখা দেয়। সারাদিন একসঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ানো প্রেমিক ও প্রেমিকা বিকালে এক রেস্তোরাঁয় বসিয়াছিলেন। অদূরে, তাহাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে, একটি দীনদরিদ্র পরিবার দাঁড়াইয়া ছিল। এই পরিস্থিতিতে প্রেমিক ও প্রেমিকার মতদ্বৈধ দেখা দিয়া যে অস্বস্তির সৃষ্টি করে বোদলেয়ার তাহার বয়ানও লিখিয়াছেন। প্রেমিক ভদ্রলোকের জবানিতে কবির কথক লিখিতেছেন: “আমার দৃষ্টিটা আপনার দৃষ্টি বরাবর ঘুরাইলাম। আশা করিয়াছিলাম, সেখানে, প্রিয়তমা আমার, আমার ভাবনাই দেখিতে পাইব। বড় সুন্দর আর বড় আশ্চর্য কোমল আপনার চোখ দুইটি; আপনার সবুজ নয়নে হুজুগদেবীর বাস যাহার মনের মাধুরীটা চাঁদ হইতে আগত। আপনার ঐ নয়নযুগে আমার নয়ন দুইটি যখন ডুবাইতে গেলাম আপনি বলিয়া উঠিলেন, ‘গাড়িবারান্দার মতো হা করা চোখ যত্তসব! এইগুলা দুই চোখের বিষ আমার! খানসামা ডাকিয়া বলিতে পারেন না, সরাইয়া দিক এইগুলি!”

এই কিস্তির অন্য চারিটি কবিতা—যথাক্রমে ‘একটি বীরোচিত মৃত্যু’, ‘জাল টাকা’, ‘অকৃপণ খেলোয়াড়’ এবং ‘দড়ি’—রাষ্ট্র ও ধনতান্ত্রিক সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করিয়াছে। ধনতন্ত্রের অন্যতম যমজ ভাই স্বাধীনতা ব্যবসায় বা আলোকজ্বালা প্রগতির প্রসঙ্গে বোদলেয়ার—শয়তানের পরোক্ষ জবানিতে—বলিয়াছেন: “আদরের ভাইবেরাদরগণ, আপনারা যখন আলোকজ্বালা প্রগতির গৌরবগাথা শোনেন কদাচ ভুলিবেন না, শয়তানের শ্রেষ্ঠ কৌশলের মধ্যে আছে এইটি: সে আপনাদের বিশ্বাস করাইতে চাহে যে সে মারা গিয়াছে!” এই কথাটি ‘অকৃপণ খেলোয়াড়’ কবিতায় পাওয়া যাইবে।

বুর্জোয়া সমাজের নৈতিকতা—যাহা স্বাধীনতা ব্যবসায় নামেও অভিহিত হয়—কোথায় মরণব্যাধিতে আক্রান্ত তাহা ‘গরিবের চোখে’ কবিতার মতো ‘জাল টাকা’ উপাখ্যানেও ধরিয়া দিয়াছেন বোদলেয়ার। এই উপাখ্যান অনুসারে জনৈক ভদ্রলোক এক ভিক্ষুককে দুই ফ্রাঁ মূল্যের একটি রূপার মুদ্রা ভিক্ষা দিতেছেন দেখিয়া তাহার বন্ধু অবাক হইয়াছিলেন। এই অবাক বিস্ময় নিরসন করিতে গিয়া তিনি বলিলেন, “টাকাটা কিন্তু জাল”। সঙ্গের দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি এই ধূর্ত অসততার যে বিশ্লেষণ করিলেন তাহাতে বুর্জোয়া সমাজের নৈতিক ভিত্তি প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত: “তাহার চোখের শাদা অংশে চোখ রাখিলাম আমি আর দেখিয়া অবাক হইলাম, চোখ হইতে তর্কাতীত একটা আন্তরিকতার আলো ঠিকরাইয়া বাহির হইতেছে। পরিষ্কার বুঝিয়া লইলাম, তিনি চাহিয়াছিলেন যুগপদ দানশীলতার পরিচয় দিতে আর ভালোমতো একটা ব্যবসায়ও সফল করিতে; চল্লিশটা পয়সা বাঁচাইতে আর আল্লাহতায়ালার মনটাও জয় করিতে; নিঃখরচায় বেহেশতে প্রবেশ করিতে; পরিশেষে, দানবীর পরিচয়ে বিনাপয়সায় একটা সুনাম ক্রয় করিতে।”

‘দড়ি’ কবিতায় বোদলেয়ার দেখাইয়াছেন, নগদ লেনদেনের সমাজে মানুষে মানুষে কিংবা মানুষে জিনিশে সম্পর্ক কোথায় নামিয়াছে। একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক গলায় ফাঁস দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে আর তাহার মা জননী আসিয়াছেন ফাঁসির দড়িটা সংগ্রহ করিতে, তাহার চোখে কোন অশ্রুর আভাস পর্যন্ত নাই। একই প্রকরণে আশপাশের দশ প্রতিবেশী উদ্বন্ধনে আত্মহত্যাকারীর সৎকারে অংশগ্রহণ করিবেন না, কিন্তু ফাঁসির রজ্জুর একটা টুকরা পাইবার আশায় গৃহকর্তার কাছে চিঠি লিখিবেন। এই মনোভাব ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই প্রাপ্তব্য। বোদলেয়ার লিখিয়াছেন: “তখন আমার মাথায় একটা হঠাৎ আলোর ঝলকানি হইল, আর বুঝিতে পারিলাম কি কারণে মা জননী এতটা জেদের সহিত আমার হাত হইতে রশিটা ছিনাইয়া লইয়াছিলেন আর কোন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হইয়া সান্তনা পাইতে চাহিয়াছিলেন।”

‘একটি বীরোচিত মুত্যু’ কবিতায় বোদলেয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শিল্পকলার জয় দেখাইয়াছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন অভিনেতার কীর্তির আলোকে। রাষ্ট্রদ্রোহ বলিয়া কথিত কোন এক অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত অভিনেতাকে ক্ষমা করা হইতে পারে এমন গুজবে ইন্ধন যোগাইবার মতো অভিনয়ানুষ্ঠানের আয়োজন করা হইল। আয়োজক রাজার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে কবি লিখিয়াছেন: “তবে আমার মতো যাহারা এই রহস্যময় আর অসুস্থ আত্মার আরো গভীরে প্রবেশ করিতে পারিয়াছেন তাহারা বলিবেন, কোন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষের অভিনয় প্রতিভা কতখানি বাকি থাকে রাজা তাহা বিচার করিতে চাহিয়াছিলেন—এই অনুমান সত্য হইবার সম্ভাবনা সীমাহীন।” এই পরীক্ষায় শিল্পী—নাম ফাঁসিয়ুল—উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন: “একটা অবাক, অকাট্য কায়দায় ফাঁসিয়ুল আমার চোখে প্রমাণ করিলেন, গহ্বরের ভয় ঢাকিয়া রাখিতে শিল্পের মৌতাত যত কার্যকর তত আর কিছুই নয়।”

পূর্বের মতো এই কবিতাগুলিও ক্লদ পিশোয়া সম্পাদিত বোদলেয়ার রচনাবলীর প্রথম খণ্ডে মুদ্রিত পাঠ অবলম্বন করিয়া অনূদিত হইয়াছে।

 

২ মে ২০২২

 

দোহাই

Charles Baudelaire, Oeuvres complètes, I, texte établi, présenté et annoté par Claude Pichois (Paris: Éditions Gallimard, 1975), pp. 316-331. 

 

 

২৫

সুন্দরী ডরোথি

 

খাড়া, ভয়াবহ রোদে সূর্য গ্রামের নাভিশ্বাস তুলিতেছে; বালি চিকচিক করিতেছে আর সমুদ্র করিতেছে ঝিলমিল। হতভম্ব দুনিয়া অসহায় আত্মসমর্পণ করিয়াছে আর দিবানিদ্রায় ঢলিয়া পড়িয়াছে; দিবানিদ্রা এক জাতীয় সুস্বাদু মৃত্যু বৈ কি যখন নিদ্রিত ব্যক্তি, অর্ধজাগ্রত থাকিয়া, শূন্যে বিলীন হইবার জীবনানন্দটা আস্বাদন করে।

এই অবসরে সূর্যের মতন বলিষ্ঠ আর গর্বিত ডরোথি জনমানবহীন পথে চলিয়াছে, এই প্রহরে অপার নীলের নীচে একমাত্র জীবিত প্রাণী সে যে এই রোদে একটা ঝাঁঝাঁলো, কালো ছায়া ফেলিয়া চলিয়াছে।

সুবিশাল নিতম্বের উপর শীর্ণ শরীর দোলাইয়া অনায়াস ভারসাম্য বজায় রাখিয়া আগাইতেছে সে। গায়ের পরিষ্কার, গোলাপি রেশমের পোশাক তাহার কালো চামড়ার উপর ঝকঝক করিতেছে আর তাহার উঁচালম্বা দেহে পিঠের খোল আর পীনোন্নত বুক জুড়িয়া খাপে খাপে মিলিয়া গিয়াছে।

তাহার গাঢ়লাল ছাতা রোদ ছাঁকিয়া লইয়া নিজের প্রতিফলিত রক্তরঙা লালটা শ্যামলা মুখের উপর ফেলিতেছে।

তাহার বিশাল বড় প্রায়-নীল চুলের ভারে কমনীয় মাথাটা পিছনে হেলিয়া পড়িয়াছে আর তাহাকে দিয়াছে একটা বিজয়িনী বিজয়িনী আর আলস্যবিলাসিনী ভাব। তাহার দৃষ্টিনন্দন কানে ভারি কানের দুলের টুংটাং শব্দ চুপিচুপি পশিতেছে।

মাঝে মাঝে সমুদ্রের বাতাস তাহার উড়ন্ত ঘাগরার কোণা উল্টাইয়া ঝলমলে, অতুলনীয় জঙ্ঘা দেখাইতেছে; এয়ুরোপ আপনার যাদুঘরে যাদুঘরে যে মার্বেল পাথরের দেবীদের আটক করিয়া রাখিয়াছে তাহাদের পায়ের সমতুল্য পায়ে মিহি বালির উপর আপনার অবিকল চিহ্ন রাখিয়া চলিয়াছে সে। ডরোথি এতই প্রতিভাময়ী গরবিনী যে তাহার স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবটা ছাড়াইয়া উঠিয়াছে লোকনন্দিত হইবার আনন্দ, তাই স্বাধীন হইবার পরও সে হাঁটিতেছে খালি পায়ে। 

এইভাবে বাঁচিয়া থাকিবার আনন্দে আর একটা শুভ্র স্মিতহাসিমুখে, সাবলীল গতিতে, আগাইয়া চলিয়াছে সে যেন বা ঠাহর করিয়াছে অদূরে অন্তরীক্ষের কোন আয়নায় আপন চালচলন আর সৌন্দর্য চোখে পড়িতেছে তাহার।

এমন সময়ে—যখন কামড়াকামড়ি রোদের নীচে ব্যথায় কাতর হইয়া খোদ কুকুরের দল পর্যন্ত চিৎকার করে—কোন জবরদস্ত আবেগের টানে সুন্দরী আর ব্রোঞ্জের মতন চোখজুড়ানো, আলস্যবিলাসী ডরোথি পথে বাহির হইয়াছে?

তাহার ছোট্ট ঘরটি বড় ঢঙ করিয়া সাজানো; তাহাতে ফুল আর মাদুরযোগে বড় কম খরচে একটা নিখুঁত অন্দরমহল রচিত; সেখানে সে চুল আঁচড়ায়, ধূমপান করে, পাখার বাতাস খায়, কি পাখির পালকে বাঁধাই করা বড় বড় আয়নায় নিজের চেহারা দেখে; শত কদম দূরের সৈকতে আছড়াইয়া পড়া সমুদ্র প্রবল আর একসুরে তাহার অমীমাংসিত স্বপ্নের সঙ্গদান করে; এদিকে উঠানের শেষমাথায় চাউল আর জাফরান মিশানো কাঁকড়ার ঝোল রান্নায় নিরত লোহার ডেগচি হইতে কড়া ঘ্রাণ ভাসিয়া আসে—এই ঘর ছাড়িয়া কি কারণে বাহির হইল সে?

হইতে পারে সুদূর কোন সৈকতে কোন তরুণ অফিসার বন্ধুবান্ধবের মুখে স্বনামধন্যা ডরোথির গল্প শুনিয়াছেন, উহার সহিত তাহার অভিসার আজ। সে—সরলপ্রাণ মানুষ—উহার কাছে অপেরামঞ্চে বলনাচের একটা বিবরণ চাহিতে নিশ্চয়ই ভুল করিবে না, আর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিবে এখানে যেমন রবিবারের নাচে খালি পায়ে যাওয়া যায়, আর আফ্রিকার কালো বুড়িরা পর্যন্ত আনন্দে মাতাল আর উত্তেজনায় বেসামাল হইয়া পড়ে, সেখানেও তেমন যাওয়া যায় কিনা; আরও পরে আবার জানিতে চাহিবে পারির সুন্দরীরা সকলেই তাহার চাহিতে বেশি সুন্দরী কিনা।

ডরোথির ভক্ত সকলেই আর সকলেই তাহাকে চায়, আর সেও ষোল আনা সুখী বোধ করিত যদি না সে মাত্র এগার বছর বয়সের—অথচ ইতিমধ্যেই সাবালক, ভারি সুন্দরী—বোনটিকে ছাড়াইয়া লইবার স্বার্থে তিল তিল পাইপয়সার উপর পাইপয়সা জমাইতে বাধ্য হইত! সন্দেহ নাই সে—সুন্দরী ডরোথি—সফল হইবে; শিশুটির মালিক এতই লোভী, এতখানি অতিলোভী যে টাকাপয়সার লাবণ্য ছাড়া অন্য কোন লাবণ্যের মূল্য সে বুঝিবে না।

 

 

২৬

গরিবের চোখ

 

আহা! আপনি জানিতে চাহিয়াছেন কি কারণে আজ আপনাকে ঘৃণা করি আমি! জিনিশটা আপনাকে ব্যাখ্যা করিয়া বোঝানো আমার পক্ষে সহজ, কিন্তু আপনার পক্ষে তাহা মাথায় ঢোকানো নিঃসন্দেহে অত সহজ নহে। কেননা আমার বিশ্বাস, কোন নারীর মাথায় কিছুই ঢোকানো যে সম্ভব নহে এই দুনিয়ায় সে সত্যের তিলোত্তমা উদাহরণ আপনি।

সুদীর্ঘ একটা দিন একসঙ্গে কাটাইলাম আমরা কিন্তু আমার মনে হইল দিনটা বড় দ্রুতই ফুরাইয়া গেল। আমরা সত্য সত্যই প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, আমাদের সমস্ত চিন্তাভাবনা সবই একে অপরকে জানাইব আর আজ হইতে আমাদের দুইটি আত্মা হইবে হরিহর একাত্মা।—যাহাই হউক, এই জাতীয় স্বপ্ন আদৌ অপূর্ব কিছু নয়—পার্থক্যের মধ্যে, স্বপ্নটা সকলেই দেখে কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে কদাচ তাহার ফল ফলে।

সে সন্ধ্যায় হয়রান-পেরেশান হইয়া নতুন বড় রাস্তাটার কোণায় আনকোরা একটা নতুন ক্যাফেতে বসিবার ইচ্ছা হইল আপনার। এখনও জায়গাটা ইটপাথরের খোয়ায় ভরা, তবে ইতিমধ্যেই মহাসমারোহে আপনার অসমাপ্ত জৌলুশের প্রদর্শন শুরু করিয়া দিয়াছে। ঝিকমিক করিতেছিল ক্যাফেটা। ইহার অন্দরের ঝলমলে গ্যাসবাতিগুলি দেখিলেই বোঝা যায়, উদ্বোধন দিবসের উত্তেজনাটা আজও শান্ত হয় নাই। পুরাদমে দীপ্যমান বাতির চোখধাঁধানো আলোতে শাদা দেয়ালগুলি আরো ঝিকমিক করিতেছিল। আয়নার উচ্চকিত বিস্তারে সোনারঙ দেয়ালের সাজি আর কার্নিশের আলপনা প্রতিফলিত হইতেছিল, মুখে লাগাম আঁটা কুকুরে টানা রথে গালফোলা বয়বেয়ারারা ছোটাছুটি করিতেছিল আর মণিবন্ধে শিকারি ঈগল বসাইয়া একদল নারী হাসিঠাট্টায় মজিয়াছিল; ফলফলারি, মিষ্টির ভাঁড় আর নিষাদে শিকার পাখির মাংসপূর্ণ তস্তরি মাথায় জলপরী আর দেবকন্যার দল চলিয়াছিল, কমনীয় হাতে কোমল পানীয়ভরা সুরাহি কি চূড়ামণ্ডিত দোরঙা মালাই-কুলফির মিনার আগাইয়া দিতেছিল এব আর গনুমেদগণ। এককথায়, এই দুনিয়ার সমস্ত ইতিহাস আর পুরান এই রাক্ষসভোজের পায়ে লুটাইতেছিল।

আমরা আসন যে জায়গাটায় পাতিয়াছিলাম তাহার ঠিক সামনে—রাস্তার উপর—ঠায় দাঁড়াইয়া একটা লোক। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মুখে ক্লান্তির ছাপ, দাঁড়িতে পাক ধরিয়াছে। এক হাতে এক ছেলে, আর হাতে ছোট্ট একটা প্রাণী কোলে লইয়াছে। উনপাঁজুরে ছোটনটির হাঁটিবার তাকত হয় নাই এখনও। কাজের বুয়ারা যে কাজ করিয়া থাকে লোকটা আজ সে কাজই করিতেছিল—বাচ্চাকাচ্চা লইয়া সন্ধ্যাবেলা একটু হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছিল। সবার কাপড়চোপড় টুটাফাটা। তিনটা মুখেরই হাবভাব সাংঘাতিক ভারিক্কি। আনকোরা নতুন ক্যাফের দিকে অনড় স্থির তাক করা ছয়টি চোখের দৃষ্টি। সকলের চোখই সমান—আর বয়সভেদে আলাদা আলাদা—বিস্ময়ে ভরপুর।

বাবার চোখ কহিতেছিল, ‘আহা! কেয়া বাত! কেয়া বাত! এই গরিব দুনিয়ার যত সোনাদানা সব দেখি এখানে এই দেয়ালের গায়ে ঢালা হইয়াছে।’—ছোট্ট বালকটির চোখ: ‘কেয়া বাত! কেয়া বাত! এখানে ঢুকিতে পারে কেবল যাহারা আমাদের নাহান নহে!’ এক্কেবারে পুঁচকে ছোড়াটির কথা কি আর কহিব, উহার চোখে নাদান আর অতল একটা শিহরণ ছাড়া আর কিছুই নাই—এতই তাজ্জব সে।

গানওয়ালারা গাহিয়া থাকেন, প্রাণের আনন্দ মনে দয়ার আর হৃদপিণ্ডে করুণার সঞ্চার করে। কথাটা সেদিন সন্ধ্যায়—অন্তত আমার ক্ষেত্রে—সত্য প্রমাণিত হইয়াছিল। এই চোখের পরিবারটি দেখিয়া আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিয়াছিল। শুদ্ধ তাহাই নহে—সামনে সাজানো কাঁচের পাত্র আর সারি সারি মদিরাদান দেখিয়া লজ্জাও পাইয়াছিলাম কিঞ্চিৎ। ক্ষুধাতৃষ্ণা আমাদের যাহা পাইয়াছিল তাহার মাপে এইগুলি ছিল অতিকায়। আমার দৃষ্টিটা আপনার দৃষ্টি বরাবর ঘুরাইলাম। আশা করিয়াছিলাম, সেখানে, প্রিয়তমা আমার, আমার ভাবনাই দেখিতে পাইব। বড় সুন্দর আর বড় আশ্চর্য কোমল আপনার চোখ দুইটি; আপনার সবুজ নয়নে হুজুগদেবীর বাস যাহার মনের মাধুরীটা চাঁদ হইতে আগত। আপনার ঐ নয়নযুগে আমার নয়ন দুইটি যখন ডুবাইতে গেলাম আপনি বলিয়া উঠিলেন, ‘গাড়িবারান্দার মতো হা করা চোখ যত্তসব! এইগুলা দুই চোখের বিষ আমার! খানসামা ডাকিয়া বলিতে পারেন না, সরাইয়া দিক এইগুলি!’

তিলোত্তমা আমার, একজনের পক্ষে আরেকজনকে বুঝিতে পারাটা কি যে কঠিন! আর মানুষে মানুষে—মায় যাহারা একজন আরেকজনের প্রেমে হাবুডুবু তাহাদের মধ্যেও—চিন্তার আদান-প্রদান কি যে অসম্ভব! 

 

 

২৭

একটি বীরোচিত মৃত্যু

 

ফাঁসিয়ুল নামে এক আশ্চর্য ভাঁড় ছিলেন, তাঁহাকে রাজার বন্ধুমহলের একজন বলিয়াই গণ্য করা চলিত। বৃত্তির নির্বন্ধে যে সকল মানুষ কৌতুকবৃত্তি অবলম্বন করিতে বাধ্য, গুরুগম্ভীর বিষয়ে তাহাদের জীবন-মরণ ঝুঁকি লইবার মতো আকর্ষণ জন্মাইয়া থাকে; দেশমাতৃকা আর জনমুক্তির ধ্যানধারণা কোন কৌতুকাভিনেতার মাথায় অত্যাচারীর মতো চাপিয়া বসিয়াছে শুনিতে যত বিসদৃশই মনে হউক, ফাঁসিয়ুল একদিন কতিপয় বিক্ষুব্ধ ভদ্রলোকের পাতানো ষড়যন্ত্রে পা দিয়া বসিলেন।

যে সমস্ত বদরুচির লোক রাজাকে উৎখাত করিতে আর—সমাজের মতামত না লইয়া—সমাজে আমূল পরিবর্তন ঘটাইবার ইচ্ছাপোষণ করেন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রশক্তির হাতে তাহাদিগকে ধরাইয়া দিবার মতন ভালো মানুষের অভাব কোনদেশেই হয় না। সন্দেহভাজন অভিজাতগণ, একই কারণে ফাঁসিয়ুলও, গ্রেপ্তার হইলেন আর নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন।

আপনার পছন্দের অভিনেতাটিকে বিদ্রোহীদের সহিত যোগ দিতে দেখিয়া রাজার রাগান্বিত হইতে বাকি ছিল না, একথা আমি সানন্দে বিশ্বাস করিতে রাজি। এই রাজা আর দশ রাজার তুলনায় ভালো ছিলেন না, মন্দও ছিলেন না; তবে একটা মাত্রাতিরিক্ত মেজাজের কারণে সমগোত্রীয়দের তুলনায় তিনি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, একটু বেশি নিষ্ঠুর আর একটু বেশি অত্যাচারী হইয়া উঠিয়াছিলেন। শিল্পকলায় অনুরাগী এই রাজার ভোগবিলাস ছিল সত্য সত্যই অপূরণীয়। 

তিনি মানবসাধারণ আর নীতিধর্মের বেলায় পরিমাণমতো অবহেলা করিতে অভ্যস্ত ছিলেন, তবে নিজে ছিলেন সত্যকারের একজন শিল্পী, একমাত্র বিতৃষ্ণা ছাড়া সত্যকারের আর কোন বিপজ্জনক শত্রু তাঁহার ছিল না; এই জগজ্জোড়া স্বৈরাচারীর হাত হইতে ছাড়া পাইবার কি তাহাকে পরাস্ত করিবার মতলবে তিনি যে সমস্ত উদ্ভট প্রচেষ্টা চালাইতেন তাহার কল্যাণে কোন ক্ষমাহীন ইতিহাসবিদের চোখে—তাঁহার রাজ্যে শুদ্ধমাত্র বিনোদনের কিম্বা বিনোদনের সর্বোচ্চ পরিশীলিত রূপ বাকরুদ্ধ হইবার প্রবণতা ছাড়া অন্য বিষয়ে লেখার অনুমতি থাকিলে—নির্ঘাত “দানব” উপাধি তাঁহার প্রাপ্য হইত। এই রাজার বড় দুঃখটা এখানেই যে আপনার প্রতিভার যোগ্য সুপরিসর রঙ্গমঞ্চ কোনদিনই জোটে নাই তাঁহার। এই দুনিয়ায় অনেক তরুণ নিরো আছেন যাঁহাদের অতি সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যে হাসফাঁস করিতে হয়, যাঁহাদের নাম আর সদিচ্ছার কথা অনাগতকাল শতবর্ষের পর শতবর্ষ জানিতে পারিবে না। অবিমৃষ্যকারী ভাগ্যদেবতা রাজ্যপাটের তুলনায় ঢের বড় বড় প্রতিভা তাঁহাদের ভাগ্যে বরাদ্দ দিয়াছিলেন।

একদিন আকস্মিকভাবে একটা গুজব ছড়াইয়া পড়িল যে শাহানশাহ সকল চক্রান্তকারীকে মাপ করিয়া দিতে মনস্থ করিয়াছেন; এই গুজবের উৎপত্তি সেই ঘোষণায় যাহাতে জানানো হইয়াছিল এক বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হইবে যাহাতে অন্যতম নায়ক চরিত্রে আর আপন জীবনকালের শ্রেষ্ঠ চরিত্রটা রূপায়িত করিবেন ফাঁসিয়ুল; লোকে কানাঘুষা করিতেছিল ঐ অনুষ্ঠানে নাকি দণ্ডপ্রাপ্ত ভদ্রলোকেরাও উপস্থিত থাকিবেন; অগভীর দৃষ্টিসম্পন্ন লোকজন ধরিয়া লইয়াছিল মর্মাহত রাজার মহানুভবতার এই তো নগদ প্রমাণ।

যে ব্যক্তি যুগপদ স্বভাবদোষে আর স্বেচ্ছায় উন্মার্গগামী প্রকৃতির হন তাহার পক্ষে কি ধর্ম কি ক্ষমা সবই সম্ভব, সর্বোপরি তাহাতে যদি তিনি কোন অজানা আনন্দের খনি পাইবার আশা করিতে পারেন। তবে আমার মতো যাহারা এই রহস্যময় আর অসুস্থ আত্মার আরো গভীরে প্রবেশ করিতে পারিয়াছেন তাহারা বলিবেন, কোন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষের অভিনয় প্রতিভা কতখানি বাকি থাকে রাজা তাহা বিচার করিতে চাহিয়াছিলেন—এই অনুমান সত্য হইবার সম্ভাবনা সীমাহীন। এই সুযোগে একটা পরম আগ্রহোদ্দীপক বিষয়ে সশরীরে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাইয়া লাভবান হইতে চাহিয়াছিলেন তিনি; আর চাহিয়াছিলেন কোন অনন্যসাধারণ পরিস্থিতিতে পড়িলে কোন শিল্পীর স্বাভাবিক প্রতিভা কতদূর পর্যন্ত পরিবর্তিত কিংবা প্রভাবিত হয় তাহা যাচাই করিতে; ইহার বাহিরে, তাঁহার মনে কমবেশি ক্ষমা করিয়া দেওয়ার কোন অভিপ্রায় ছিল কি? প্রশ্নটার পরিষ্কার কোন জওয়াব কখনোই পাওয়া যায় নাই।

পরিশেষে, বড় দিনটা আসিয়া গেল, এই ক্ষুদে রাজদরবারের তাবৎ শানশওকত প্রদর্শিত হইল, আর নিজের চোখে না দেখিলে বিশ্বাস করা কঠিন একটা সত্যকারের পবিত্র অনুষ্ঠান উপলক্ষে সীমিত সম্পদের অধিকারী কোন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণী কত জাঁকজমক দেখাইতে পারে। বর্তমান ক্ষেত্রে কথাটা দুই গুণ সত্য প্রমাণিত হইয়ছিল: এক নম্বরে, প্রদর্শিত ঐন্দ্রজালিক বিলাসিতার কারণে; তারপর, ঘটনার উপর আরোপিত নৈতিক ও রাহসিক তাৎপর্যের গুণে।

ফাঁসিয়ুল সাহেব সর্বোপরি সেরা অভিনয়টা দেখাইতেন নির্বাক কিংবা স্বল্পবাক চরিত্রে, যে সকল অতিলৌকিক নাটকের উদ্দেশ্য সর্বদা প্রতীকী রীতিতে জীবনের গূঢ়তত্ত¡ উপস্থাপন করা তাহাদের প্রধান প্রধান ভ‚মিকায়। তিনি প্রফুল্লচিত্তে এবং সম্পূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যের সহিত দৃশ্যে প্রবেশ করিলেন, ইহাতে অভিজাত জনগণের মনে বিরাজিত প্রশান্তি আর মহানুভবতার ভাবটা পাকাপোক্ত করিতে সহায় হইল।

 কোন অভিনেতার তারিফ করিয়া যদি বলা হয়, “দারুণ অভিনেতা বটে!” তো বলা হয় একটা সূত্র মানিয়া যাহার মর্ম হইতেছে অভিনীত চরিত্রের আড়ালে অভিনেতার চরিত্রটা—তাহার অভিনয়-কুশলতা, তাহার চেষ্টাচরিত্র, তাহার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোন ধরনের তাহা বলিয়া দেওয়া যায়; নয়নাভিরাম সকল প্রাচীন ভাস্কর্যে যদি অলৌকিক উপায়ে প্রাণসঞ্চার করিয়া সজীব করা যাইত, তাহারা যদি হাঁটাচলা করিতে আর চোখে দেখিতে পাইত তবে সৌন্দর্য বলিতে আমরা সচরাচর যে গড়পড়তা আর ভুলভাল ধারণা পোষণ করি তাহা ছাড়াইয়া ভাস্কর্য যেমন অন্যরকম সুন্দর দেখাইত, কোন অভিনেতাও যদি অভিনীত চরিত্রে সেরকম কিছু ঘটাইতে পারিতেন তবে তাহা হইত নিঃসন্দেহে অসাধারণ আর আদ্যোপান্ত অদৃষ্টপূর্ব একটা পদার্থ।

সেই সন্ধ্যায় ফাঁসিয়ুল হইয়াছিলেন আদর্শের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, যাহাকে জীবন্ত, সম্ভবপর, সত্যকার না ভাবাটা ছিল অসম্ভব। এই সঙ গেলেন, আসিলেন, হাসিলেন, কাঁদিলেন, কাঁপিয়া উঠিলেন—সবই মাথার চারিদিকে অক্ষয় একটা আলোর টোপর নাচাইয়া যাহা সকলের চোখে অদৃশ্য থাকিলেও আমার চোখে ছিল দৃশ্যমান; আর অদ্ভূত এক রসায়নযোগে তাহাতে মিশ্রিত হইয়াছিল শিল্পের আলোকরশ্মির সঙ্গে শাহাদাতের গৌরব। ফাঁসিয়ুল—কি জানি কোন বিশেষ কৃপার কল্যাণে—এমন কি চরম ভাঁড়ামির মুহূর্তেও নূরানি আর লোকোত্তর কিছু হাজির করিতেন। আমার কলমটা কাঁপিয়া উঠিতেছে, আর আপনাদের উদ্দেশ্যে এই অবিস্মরণীয় সন্ধ্যার একটা বিবরণ লিখিবার চেষ্টা করিতেই প্রাণে আবেগের যে অশ্রুধারা সদা হাজির তাহা দুই চোখে উঠিয়া আসিতেছে আমার। একটা অবাক, অকাট্য কায়দায় ফাঁসিয়ুল আমার চোখে প্রমাণ করিলেন, গহ্বরের ভয় ঢাকিয়া রাখিতে শিল্পের মৌতাত যত কার্যকর তত আর কিছুই নয়; প্রমাণ করিলেন কবরের পাড়ে দাঁড়াইয়াও এমন আনন্দে অভিনয় করা যায় যে তাহার কল্যাণে কবর আর কেয়ামতের সমস্ত ধারণাবর্জিত এক বেহেশতে পথ হারাইয়া ফেলার ফলে—যেমন হারাইয়াছিলেন তিনি—কবরটা দেখার পথে একটা প্রতিবন্ধক খাড়া হয়।

পুরা জনতা, যাহারা যতটা সম্ভবপর ততটা উদাসীন আর দায়িত্বহীন, যথাশিগ্গির শিল্পীর সর্বশক্তিমান আধিপত্যের সম্মুখে আত্মসমর্পণ করিয়া বসিল। কেহই আর স্বপ্নেও মৃত্যুর, বেদনার কথা ভাবিল না, ভাবিল না সর্বোচ্চ শাস্তির কথাও। যে সজীব সপ্রাণ শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বহুগুণবর্ধিত আনন্দ দিতে পারে তাহার সম্মুখে সকলেই, কোনরকম উশকুশ না করিয়াই, আত্মনিবেদন করিয়া বসিল। আনন্দ আর অনুরাগের বিস্ফোরণে সৃষ্ট অবিরাম বজ্রধ্বনির জোরে দালানটির খিলান করা ছাদ বার বার কাঁপিয়া উঠিল।

খোদ রাজাও, উত্তেজিত হইয়া, দরবারের অভিনন্দনধ্বনির সহিত নিজেরটাও মিশাইয়া দিলেন।

এই অবসরে, তাঁহার উত্তেজনাটা যে অবিমিশ্রিত ছিল না তাহা মর্মভেদী চোখে যিনি দেখেন তাহার চোখে ধরা পড়িয়া গিয়াছিল। তিনি কি ভাবিয়াছিলেন তাঁহার অত্যাচার করার ক্ষমতাটা মার খাইয়াছিল? মানুষের কলিজায় কাঁপন ধরাইবার আর প্রাণটা নিস্তেজ করিয়া দিবার ক্ষমতাটা অপদস্থ হইয়াছিল? তাঁহার আশা-আকাঙ্ক্ষা নিরাশ আর তাঁহার পূর্ব পরিকল্পনা হতভম্ব হইয়া পড়িয়াছিল? এই ধরনের অনুমান—হুবহু যুক্তিসঙ্গত নয়, তবে একদম অযৌক্তিকও নয়—আমার মনে আসিয়াছিল যখন আমি রাজার চেহারাটা নিবিড় মনে পর্যবেক্ষণ করিতেছিলাম, সেই চেহারার স্বাভাবিক রঙের উপর আরেক প্রস্ত নতুন রঙের প্রলেপ অবিরাম বসিতেছিল, একপ্রস্ত তুষারের উপর আরেক প্রস্ত তুষার যেভাবে বসিয়া থাকে। তাঁহার ঠোঁট দুইটি জোরে জোরে, আরো জোরে, বারবার শক্তভাবে বন্ধ হইয়া আসিতেছিল। এমনকি যখন তিনি মৃত্যুকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা আপনকার পুরানা বন্ধু, আশ্চর্য ভাঁড়ের প্রতিভায় মুগ্ধ হইয়া লোকদেখানো হাততালি দিতেছিলেন তখনও তাঁহার চোখ হইতে একটা অন্তর্গত আগুন ঠিকরাইয়া বাহির হইতেছিল যাহা দেখায় ঈর্ষা আর বিদ্বেষের আগুনের মতন। একটা বিশেষ মুহূর্তে, আমি দেখিলাম মহামান্য তাঁহার পিছনে বসা একটা কাজের ছেলের দিকে ঝুঁকিতেছেন আর উহার কানে কানে কিছু একটা বলিতেছেন। সুদর্শন ছেলেটির দুষ্টুমিভরা মুখ একটা স্মিতহাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল; তারপর সে দ্রুতবেগে রাজার কামরা হইতে বাহির হইল যেন বা জরুরি কোন কাজের ডাক পাইয়াছে।

আরো কয়েক মিনিট পার হইবার পর একটা তীব্র, দীর্ঘ বাঁশির আওয়াজ ফাঁসিয়ুলকে তাঁহার অভিনয়ের একটা তুঙ্গ মুহূর্তে থামাইয়া দিল আর যুগপদ তাঁহার কর্ণকুহর বিদ্ধ আর হৃদপিণ্ড বিদীর্ণ করিল। প্রেক্ষাগৃহের যে জায়গা হইতে এই অপ্রত্যাশিত অননুমোদনটা ছোঁড়া হইয়াছিল সেই জায়গা হইতে বারান্দা দিয়া হাসি চাপিয়া একটা শিশু ছুটিয়া গেল।

ফাঁসিয়ুল কাঁপিয়া, স্বপ্ন হইতে জাগিয়া, প্রথমে চোখ দুইটা বন্ধ করিলেন, তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার খুলিলেন, চোখগুলি কতটা যে বড় করিলেন তাহার মাপজোক নাই, তারপর মুখটা এমনভাবে হা করিলেন যেন জোরে জোরে শ্বাস নিতে হইতেছে, একটু সামনে আগাইলেন, একটু পিছনে সরিলেন, আর তারপর মরিয়া মেঝের উপর পড়িয়া গেলেন।

তরবারির মতো ক্ষিপ্র এই বাঁশিটি কি প্রকৃত প্রস্তাবে জল্লাদের হতাশার কারণ ঘটাইল? রাজা কি নিজেও তাঁহার এই চতুরতার নরঘাতী কার্যকারিতার কথাটা আগে হইতেই জানিতেন? সন্দেহ পোষণের অবকাশ আছে। তাঁহার প্রীতিভাজন আর অননুকরণীয় ফাঁসিয়ুলের জন্য কি তাঁহার প্রাণ কাঁদিয়াছিল? এসব কথায় বিশ্বাস করিলে শান্তি পাওয়া যায়, আর কতক যুক্তিও আছে তাহাতে।

অপরাধী ভদ্রলোকগণ সেদিন শেষবারের মতো একটা কৌতুক নাট্যাভিনয় দেখিয়া আনন্দলাভ করিয়াছিলেন। ঐ রাতেই তাঁহাদের জীবনলীলা সাঙ্গ করা হয়। 

তাহার পর হইতে, নানাদেশে যুক্তিসঙ্গত কারণে প্রশংসিত অনেক মূকাভিনেতা * * * দেশের দরবারের আমন্ত্রণে অভিনয় দেখাইবার উদ্দেশ্যে আগমন করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহাদের কেহই ফাঁসিয়ুলের বিস্ময়কর প্রতিভার সমান উচ্চতায় পৌঁছিতে পারেন নাই, পারেন নাই তাহার সমান সমাদর লাভ করিতেও।

 

 

২৮

জাল টাকা

 

তামাকের দোকান ছাড়িয়া বাহির হইতেছি, এমন সময় আমার বন্ধুটি বড় যত্নের সহিত নিজের খুচরা টাকাটা ভাগ ভাগ করিয়া লইলেন; তাহার সদরিয়ার বাম পকেটে ঢোকাইলেন ছোটখাট সোনার মুদ্রা কয়টি; ডান পকেটে ছোটখাট রূপার মুদ্রা; পায়জামার বাম পকেটে, অনেকগুলি তামার পয়সা; পরিশেষে, ডানদিকে, বড় মনোযোগ সহকারে দেখিয়া লওয়া একটা দুই ফ্রাঁ রূপার মুদ্রা।

“তুলনাহীন, চুলচেরা ভাগাভাগি!” মনে মনে বলিলাম আমি।

আমাদের সামনে পড়িল একটি গরিব লোক, তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে হাতের টুপিটা সামনে তুলিয়া ধরিলেন।—এই সাহায্যপ্রার্থী চোখগুলির নীরব বাকপটুতার অধিক অস্বস্তিকর কিছুর সহিত আমার পরিচয় নাই; দয়ামায়া আছে এমন কোন ব্যক্তি যিনি এই ভাষাটা পড়িতে পারেন তিনি জানেন উহাদের ভিতর যতটা বিনয় দেখা যায় ভর্ৎসনাও তাহার চেয়ে কম নয়। বেত্রাঘাতে জর্জরিত কুকুরের অশ্রুভেজা চোখের মতন এইসব চোখেও জটিল আবেগ-অনুভূতির ঘনঘটার মতন কিছু একটা চোখে পড়ে।

আমার বন্ধুর দেওয়া ভিক্ষার পরিমাণটা ছিল আমি যাহা দিলাম তাহার তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি; তাহাকে আমি বলিলাম: “ঠিক কাজই করিয়াছেন আপনি; আপনি বিস্মিত হইবার পর সবচেয়ে বড় আনন্দের কাজ হইল আর কাহাকেও বিস্মিত করা।” তিনি আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিলেন, “টাকাটা কিন্তু জাল,” যেন বা নিজের অপব্যয়ের সমর্থনে একটা যুক্তি দেখাইলেন তিনি।

এদিকে আমার মাথায়, যাহা সর্বদা বেলা দুইটা বাজিলেও বারোটার খোঁজ করে (প্রকৃতি আমাকে এই ক্লান্তিকর প্রতিভাটাই দান করিয়াছেন!), হঠাৎ একটা ভাবনার উদয় হইল, আমার বন্ধুর করা এই ব্যবহারটা ক্ষমার যোগ্য প্রমাণিত হইতে পারিত শুদ্ধমাত্র একটি কারণে: কোন হতদরিদ্র মানুষের জীবনে মনে রাখার মতো একটা ঘটনা ঘটাইবার মতলবে, কিম্বা—হইতে পারে—কোন ভিখারির হাতে জাল টাকা পড়িলে তাহার কি বিচিত্র পরিণতি হইতে পারে—হোক তাহা ভয়ংকর বা অন্য কিছু—তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে তিনি কাজটা করিয়াছিলেন। টাকাটা কি আসল টাকায় বাড়িয়া বহুগুণ হইতে পারিত না? তাহাকে কারাগারেও ঠেলিয়া দিতে পারিত না? উদাহরণস্বরূপ, কোন খাবারের দোকানদার, কোন মুদি হয়তো জাল টাকা ব্যবসায়ী কি জাল টাকা চালানকারী ভাবিয়া তাহাকে তো গ্রেপ্তারও করাইতে পারিত। এই জাল মুদ্রা সম্বল করিয়া কোন বেচারা ফটকাবাজারী হয়তো দুইচারি দিন বড়লোক বনিবার সুযোগ পাইয়া যাইত। আমার বন্ধুর মনে পাখা ধার দিয়া আর সম্ভব সমস্ত কল্পিত অনুমান হইতে সম্ভব সমস্ত উপসংহারে পৌঁছিয়া আমার অবাধ কল্পনা আপনার পথে আগাইয়া চলিল।

কিন্তু অকস্মাৎ আমার দিবাস্বপ্নটা তিনি মাঝপথে ভাঙিয়া দিলেন, আমার বলা কথাটাই আওড়াইয়া বলিলেন: “আজ্ঞে, ঠিক কাজই করিয়াছেন আপনি; কোন মানুষকে তিনি যতটা আশা করিয়াছেন তাহার বেশি দান করিয়া অবাক করার অধিক সুখকর, আনন্দদায়ক কাজ আর হইতেই পারে না।”

তাহার চোখের শাদা অংশে চোখ রাখিলাম আমি আর দেখিয়া অবাক হইলাম, চোখ হইতে তর্কাতীত একটা আন্তরিকতার আলো ঠিকরাইয়া বাহির হইতেছে। পরিষ্কার বুঝিয়া লইলাম, তিনি চাহিয়াছিলেন যুগপদ দানশীলতার পরিচয় দিতে আর ভালোমতো একটা ব্যবসায়ও সফল করিতে; চল্লিশটা পয়সা বাঁচাইতে আর আল্লাহতায়ালার মনটাও জয় করিতে; নিঃখরচায় বেহেশতে প্রবেশ করিতে; পরিশেষে, দানবীর পরিচয়ে বিনাপয়সায় একটা সুনাম ক্রয় করিতে।

একটু আগেই আমি ধরিয়া লইয়াছিলাম, এই যে অপরাধটা তিনি করিয়াছিলেন নিছক আনন্দলাভের বাসনা হইতে—তাহার পক্ষে তাহা সম্ভব; তিনি যে কোন গরিব মানুষের ক্ষতি করিয়া মজা লুটিতে চাহিয়াছিলেন তাহা আমার চোখে একটু বিসদৃশই ঠেকিয়াছিল; কিন্তু হিসাব কষিতে বসিয়া তিনি যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয়টা দিয়াছেন তাহা আমি কোনদিনই ক্ষমা করিতে পারিতাম না। কোন মানুষের ক্ষতি করাটা কখনোই ক্ষমার যোগ্য কাজ বিবেচিত হইতে পারে না, তবে কাজটা যে ক্ষতিকর তাহা জানা থাকিলে অপরাধ খানিক হইলেও লঘু হয়; কিন্তু যে অপরাধ করা হয় নির্বুদ্ধিতার প্রকোপে তাহা ক্ষমার একেবারেই অযোগ্য।

 

২৯

অকৃপণ খেলোয়াড়

 

গতকাল, বড় রাস্তার ভিড়ে, মনে হইল অজানা-অচেনা একটা লোক আমার গা ঘেঁষিয়া গেল—লোকটার সহিত পরিচিত হইবার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের; আর যদিও কোনদিন দেখি নাই তবুও তাহাকে দেখা মাত্রই চিনিয়া ফেলিলাম। একই কথা, তিনিও নিশ্চয়ই আমার সহিত পরিচিত হইবার বাসনা পোষণ করিয়া থাকিবেন কেননা যাইতে যাইতে আমার দিকে তাকাইয়া চোখ টিপিয়া অর্থপূর্ণ একটা ইশারা করিলেন তিনি; আমিও তড়িঘড়ি তাহার পিছু পিছু গেলাম। সাবধানে পিছু পিছু চলিয়া বেশিক্ষণ না যাইতেই ভূগর্ভে অবস্থিত আলোঝলমল একটা গৃহে প্রবেশ করিলাম; ঐ গৃহে প্রকটিত আভিজাত্যের কাছাকাছি পৌঁছিয়াছে এমন বাড়ি পারির অভিজাত পাড়ায় একটিও পাওয়া যাইবে না। এই মর্যাদাবান দালানটার পাশ ঘেঁষিয়া এতবার আসা-যাওয়া করিয়াছি, অথচ প্রবেশপথটা কদাচ খেয়াল করি নাই—ব্যাপারটা আমার একটু আশ্চর্যই ঠেকিল। নেশার আমেজের মধ্যেও সেখানে চমৎকার একটা পরিবেশ বিরাজ করিতেছিল, যে পরিবেশে জীবনের জালজঞ্জালজট যে ভয় দেখায় তাহা প্রায় নিমেষের মধ্যেই ভুলিয়া যাওয়া যায়; সেখানে একটা গম্ভীর, প্রশান্তির নিঃশ্বাস লওয়া যায় যেমন প্রশান্তির স্বাদ অন্তহীন বৈকালিক আলোকবিধৌত, সম্মোহিত দ্বীপে অবতরণরত পদ্মভুকের দল লাভ করিয়াছিলেন, সুরধুনী জলপ্রপাতের ঘুমপাড়ানিয়া গান শোনা সুখের আবহে যাহাদের মনে জন্মগ্রহণ করিতেছিল কোনদিন স্ব স্ব গৃহদেবতার, বৌঝিয়ের, সন্তান-সন্ততির কাছে আর না ফেরার আর মহাসাগরের ঊর্মিমালায় আরবার না চড়ার বাসনা। 

ঐ জায়গায় নর ও নারীর আশ্চর্য সব চেহারায় মৃত্যুময় সুন্দরের ছাপ; মনে পড়িল এইসব চেহারা আমি কোন না কোন দিন, কোন না কোন দেশে—আগেভাগেই—দেখিয়াছিলাম কিন্তু কোথায় কখন তাহা হুবহু স্মরণ করা আমার পক্ষে সম্ভবপর প্রতীয়মান হইল না। সচরাচর অপরিচিত কোন কিছু দেখিলে মনে যে ধরনের ভয়ভীতির সৃষ্টি হয় এইগুলি দেখিয়া আমার কিন্তু তেমন কিছু হইল না, বরং তাহাদের জন্য মনে একটা ভাই ভাই সমবেদনার ভাব উদিত হইল। তাহাদের চেহারাসুরতে যে বিশেষ অভিব্যক্তি দেখা যাইতেছিল তাহার সংজ্ঞা স্থির করিতে হইলে হয়তো বলিতাম ইহাদের চোখের চাহিতে বিতৃষ্ণার ভয়ে অধিক ভীত আর নিজেদের সজীব ভাবিবার দুর্মর বাসনায় অধিক দীপ্ত—এহেন আবেগমণ্ডিত—চোখ আমি কোনদিন দেখি নাই।

আমার গৃহস্থ আর আমি আসন গ্রহণ করিতে করিতে—ইহার মধ্যেই—আমরা পরস্পরের পুরাতন আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হইয়া উঠিয়াছিলাম। আমরা খাওয়া-দাওয়া সারিলাম, আর এই দুনিয়ায় যত ধরনের অত্যাশ্চর্য মদিরা পাওয়া যায় সবই মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে পান করিলাম; আর কথাটা মোটেও কম আশ্চর্যজনক নয় যে বিস্তর সময় কাটিয়া গেলেও, মনে হইল আমার নেশা তাহারটা তুলনায় মোটেও বেশি হয় নাই। ইহার ভিতর, আমাদের সঘন পানবিরতির পথে বাধ সাধিতেছিল জুয়া—সেই অতিমানবিক মজার লুট; আর বলাটা আমার কর্তব্য বটে—একধরনের বেপরোয়া, চিন্তালেশহীন মনে এই সর্বস্ববাজির জুয়ায় আমার আত্মাটা হারাইয়া বসি আমি। আত্মা পদার্থটা এমন ধরাছোয়ার অতীত, সর্বদা এমন নিষ্কর্মা আর মাঝে মধ্যে এমন বিড়ম্বনার কারণ যে যখন উহা হারাইলাম তখন হাঁটিতে বাহির হইয়া নিজের দর্শনার্থী পত্রটা হারাইলে বা যেটুকু মন খারাপ হয় তাহার একটু কমই মন খারাপ হইয়াছিল আমার। 

আমরা দীর্ঘক্ষণ কয়েকটা চুরুট সেবন করিলাম যাহাদের স্বাদ আর অতুলনীয় সুগন্ধ অচেনা দেশ আর অজানা সুখস্মৃতির টানে আত্মায় কাতরতাসংযোগ করিল, আর এ সমস্ত সুখের নেশায় উল্লসিত হইয়া, কানায় কানায় পূর্ণ একটা মদিরাদান হাতে লইতে লইতে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো যে কথাটা তাহাকে বলিলাম তাহাতে তিনি আদৌ অসন্তুষ্ট হইয়াছেন এমন মনে হইল না: “আপনার অমর স্বাস্থ্যের সম্মানে, বুড়ো খান্নাস!”

আমরা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করিলাম নিখিলের বিষয়ে, ইহার সৃষ্টজগত আর তাহার ভাবী বিনাশের বিষয়ে; এই শতাব্দীর অতিকায় ধারণা অর্থাৎ প্রগতি আর কামেলিয়াত বিষয়ে আর—সাধারণভাবে—মানবীয় মোহবন্ধনের যাবতীয় রূপ লইয়া। এই প্রসঙ্গের আলাপে মহামান্যের লঘু আর অকাট্য রঙ্গরসিকতার ভাণ্ডারে কখনো টান পড়ে নাই; আর হাসিঠাট্টা করিবার সময় তিনি যে পরিচ্ছন্ন শৈলী আর ঠাণ্ডা মাথার পরিচয় দিয়া বক্তব্য পেশ করিতেন তাহা আমি মানবকুলের সবচেয়ে বেশি খ্যাতিমান কথকদের মধ্যেও দেখি নাই। আজ পর্যন্ত বিচিত্র যত দর্শন মানবকুলের মাথা নষ্ট করিয়াছে তাহাদের অর্থহীনতা ব্যাপারটি তিনি আমাকে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইলেন, আর এমন কি কয়েকটা একান্ত গোড়ার কথা পর্যন্ত আমাকে বিশ্বাস করিয়া বলিবার মতো কৃপাও করিলেন যাহার মাহাত্ম্য আর স্বত্ত্বস্বামিত্ব কাহারো কাছে ফাঁস করা আমার উচিত হয় না। দুনিয়ার তাবত দেশে তাহার যে দুর্নাম তাহা লইয়া তিনি কোনক্রমেই আপত্তি করিলেন না, আশ্বস্ত করিলেন তিনিই সেই জন যিনি কুসংস্কার নির্মূলের আগ্রহে সকলের অগ্রণী; আমার সকাশ স্বীকারও করিলেন শুদ্ধমাত্র একবার বাদে আপনকার ক্ষমতা লইয়া তিনি কখনো ভয় করেন নাই; তিনি ঐবেলা এক জায়গায় আপন সহকর্মীদের তুলনায় ঢের সেয়ানা এক বক্তাকে মিম্বর হইতে বলিতে শুনিয়াছিলেন: “আদরের ভাইবেরাদরগণ, আপনারা যখন আলোকজ্বালা প্রগতির গৌরবগাথা শোনেন কদাচ ভুলিবেন না, শয়তানের শ্রেষ্ঠ কৌশলের মধ্যে আছে এইটি: সে আপনাদের বিশ্বাস করাইতে চাহে যে সে মারা গিয়াছে!”

এই মশহুর বক্তার স্মৃতিচারণা স্বাভাবিকভাবেই গড়াইয়া চলিল উচ্চতর জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের বিষয়ে, আর আমার আশ্চর্য সঙ্গী আমাকে দিব্য দিয়া বলিলেন, অধ্যাপকদের লেখা, বক্তৃতা আর বিবেকে প্রেরণা যোগাইতে—বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই—তিনি কসুর করেন না; আর—নিজে আড়ালে থাকিয়াও—জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধকদের তাবত সম্মেলনে প্রায় সর্বদাই সশরীরে হাজির থাকেন। 

এই অপর্যাপ্ত বদান্যতার কারণে মনে বল পাইয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম আল্লাহতায়ালার খবর কি আর হালে তাঁহার সহিত দেখাসাক্ষাত ঘটিয়াছে কিনা। কিছুটা বিষণ্ণমনে উদাসীন ভঙ্গিতে তিনি উত্তর করিলেন: “দেখাসাক্ষাৎ হইলে আমরা কুশল বিনিময় করিয়া থাকি, তবে অন্তর্গত ভদ্রতার আড়ালে পুরানা শত্রুতার স্মৃতি লুকাইতে না পারা দুই ভদ্রলোকের মতন আর কি!”

এতটা দীর্ঘ সময় কোন মরণশীলকে মহামান্য কদাচ দান করিয়াছিলেন কিনা সংশয়, আর আমারও ভয় ছিল পাছে সুযোগের অপব্যবহার করিয়া বসি। শেষমেষ, সুবেহ সাদেকের শাদা আলো যখন কাঁচে টোকা দিতে শুরু করিয়াছে এই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব—ঘটনা কি না জানিয়াই এত কবি যাহার গুণগান গাহিয়াছেন আর এত দার্শনিক বড় খাটাখাটনি করিয়া যাহার সেবায় নিরত হইয়াছেন—আমাকে বলিলেন: “ইচ্ছা হয়, আপনার মনে আমার একটা সুন্দর স্মৃতি অক্ষয় থাকিয়া যায়, আর জানিয়া রাখিবেন যাহাকে লইয়া এত বাজেকথা ছড়ানো হইয়াছে সেই আমি কখনও কখনও—আপনাদের একটি ইতর শব্দ ধার করিয়া বলি—ভদ্র শয়তান হইতে পারি! আপন আত্মাটি হারাইয়া যে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি আজ আপনি হইয়াছেন শেষ পর্যন্ত সে ক্ষতিটা পূরণার্থে আপনাকে একটা বাজি দান করিতেছি যাহার কল্যাণে ভাগ্য যদি আপনার পক্ষে রায় দিতেন তবে যাহা পাইতেন এক্ষণে তাহাই পাইবেন—মানে সারাজীবন যে বিতৃষ্ণা আপনার যাবত অসুখ আর তাবত হতচ্ছাড়া প্রগতির গোড়ায় সেই কদর্য বিতৃষ্ণার হাত হইতে ছাড়া পাইবেন আর তাহার উপর বিজয় অর্জন করিবেন। আপনার মনে কোনদিন এমন কোন বাসনার উদয় হইবে না যাহা বাস্তবায়ন করার কাজে আমি আপনাকে সহায়তা করিব না। আপনি রাজত্ব করিবেন আপন জাতির ইতরজনের উপর; তোষামোদ আর সমাদর আপনার পায়ে লুটাইবে; টাকাপয়সা, সোনারূপা, হীরাজহরত, পরীর প্রাসাদ আপনাকে খুঁজিয়া মরিবে আর গ্রহণ করার জন্য অনুনয় করিবে—এসব উপার্জনের জন্য কোন চেষ্টাচরিত্রই করিতে হইবে না আপনার। অধিক কি, আপনার কল্পনাদেবী যেমন আদেশ করেন সদাসর্বদা তেমন, ঘন ঘন দেশ আর মহাদেশ বদল করিতে পারিবেন আপনি; যে সমস্ত মনোহর দেশে চিরবসন্ত বিরাজমান আর যে সকল দেশের নারীদের মনে হয় পুষ্পের ন্যায় মনোলোভা সে সকল দেশে বিরতিহীন ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগ করিবেন আপনি, ইতি আদি, ইতি আদি...”—কথাগুলি যোগ করিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিলেন আর সুন্দর একটা স্মিতহাসি উপহার দিয়া আমাকে বিদায় করিলেন।

এহেন বিশাল সমাবেশের সম্মুখে আপনাকে অপমান করার ভয় না থাকিলে তাঁহার এই অসামান্য মহানুভবতায় শুকরিয়া জ্ঞাপন করিবার নিমিত্ত আমি এই অকৃপণ খেলোয়াড়ের পায়ে সানন্দে লুটাইয়া পড়িতাম; কিন্তু তাঁহাকে ছাড়িয়া আসিবার পর—ধীরে ধীরে—অনারোগ্য অবাধ্যতাটা আমার বুকে আবার ঢুকিয়া পড়িল; এহেন অপরিমেয় সৌভাগ্যে বিশ্বাস অধিকক্ষণ ধরিয়া রাখার সাহস আমার হইল না, আর, একটা নির্বোধ অভ্যাসের বশে—শুইয়া পড়ি পড়ি অবস্থায়—আমার প্রার্থনা তেলাওয়াত করিতে করিতে, আধা-আধি ঘুমের ভিতর, পুনরাবৃত্তি করিলাম: “ও আল্লাহ! ও আমার প্রভু, আল্লাহ! শয়তান যেন আমাকে দেওয়া কথাটা রাখে সে ব্যবস্থা করো!”

 

৩০

দড়ি

এদুয়ার মানে সমীপে

 

 

“মানুষে মানুষে, কিংবা মানুষে জিনিশে বন্ধন যেমন সংখ্যাহীন,”—কথাটা এক বন্ধু আমাকে বলিতেছিলেন—“মায়া-মরীচিকাও হয়তো তেমনই সংখ্যাহীন। আর মরীচিকা যখন উবিয়া যায়—অর্থাৎ যখন ব্যক্তি কিংবা ঘটনা আমাদের আওতার বাহিরে যেভাবে আছে সেভাবেই দেখিতে পাই—তখন দুর্বোধ্য একটা বেদনার মুখোমুখি হই আমরা; এই জটিলতার অর্ধেক উবিয়া যাওয়া  প্রেতমূর্তিটার শোকে, অর্ধেক নবোদিতের মুখোমুখি হইবার—আসল ঘটনার মুখোমুখি হইবার—সুখপ্রদ বিস্ময়ে। যদি স্বতঃসিদ্ধ, নিত্যকৃত, চির অপরিবর্তিত কোন ঘটনা থাকে, আর যাহার স্বভাব সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করা অসম্ভব, তাহার নাম মাতৃস্নেহ। উত্তাপ নাই এমন আলোর কথা ভাবা যেমন কঠিন, মাতৃস্নেহ নাই এমন মায়ের কথা ভাবাও তেমন কঠিন; কোন মায়ের আপন সন্তান বিষয়ে যাবতীয় কাজ আর যাবতীয় কথা মাতৃস্নেহ হইতে উৎসারিত হয় ধরিয়া লওয়াটা কি ষোল আনা যুক্তিসঙ্গত নহে? তাহা হইলে, ইত্যবসরে ছোট্ট একটা গল্প শুনিয়া রাখুন যাহা অত্যন্ত স্বাভাবিক মায়া-মরীচিকার মতো আমাকে যারপরনাই হতবাক করিয়াছিল।

“আমার ছবি আঁকা ব্যবসায়ের কারণে চলার পথে যে সব চেহারা-সুরত, যে সব শরীর-স্বাস্থ্য চোখে পড়ে সবই মনোযোগ দিয়া দেখিতে বাধ্য হই, আর এই প্রতিভা আমাদের চোখে—আর দশ মানুষের তুলনায়—কাজটাকে সাংঘাতিক জীবন্ত আর সাংঘাতিক অর্থময় করিয়া কি যে তুরীয়ানন্দ যোগায় তাহা আপনি জানেন।

“শহর হইতে দূরের যে মহল্লাটায় আমি থাকি, আর যেখানে এক বাটি হইতে আর বাটির মধ্যকার ফাঁকা জায়গাটা ঘাসে ভরিয়া গিয়াছে, সেখানে শরীর-স্বাস্থ্যের চঞ্চলতায় আর দুষ্টুমিতে অন্যদের ছাড়াইয়া যাওয়া একটা ছোকরা সবসময়ই আমার চোখে পড়িত, সে একেবারে গোড়াতেই আমার মন কাড়িয়া লইয়াছিল। একাধিকবার আমার সামনে বসিয়া ছবি আঁকার সুযোগ দিয়াছিল সে, তাহাকে আমি অনেকবার ক্ষুদে বোহেমিয়ানের, অনেকবার ফেরেশতার, আর অনেকবার পুরাকথার মদনরূপ দান করিয়াছিলাম। তাহার হাতে দিয়াছিলাম ভবঘুরের বেহালা, কণ্টকের মুকুট আর ভগবদপ্রেমের পেরেক, এবং রতির মশাল। এই ছোড়ার যাবতীয় হাসিঠাট্টায় শেষ পর্যন্ত এতটা প্রাণমনে মজিয়াছিলাম যে তাহার গরিবগুর্বো মা-বাবাকে বলিলাম উহাকে যেন আমার হাতে আহলাদের সহিত তুলিয়া দেন; প্রতিজ্ঞা করিলাম উহার গায়ে ভালো কাপড়চোপড় চড়াইব, কিছু টাকাপয়সাও দিব আর আমার ছবি আঁকার তুলিটুলি পরিষ্কার করা আর ছোটখাট ফাইফরমাশ খাটার বেশি কোন কাজ দিব না। হাতমুখ ধোয়ার পর ছোকরাটা বেশ দেখিতে হইল, আর আমার বাসায় যে জীবন সে যাপন করিতেছিল তাহাকে—মা-বাবার ঝুপড়িতে মাথায় পাতিয়া লওয়া জীবনের তুলনায়—বেহেশত মনে হইল তাহার। এখানে শুদ্ধমাত্র একটি কথাই আমাকে বলিতে হইতেছে, এই ছোট্ট ভালোমানুষটি মাঝেমধ্যে তুলনাহীন সংকটে আর বয়সের সহিত বেমানান বিষন্নতায় ভুগিয়া আমাকে হতবাক করিত, আর কিছুদিনের মধ্যেই তাহাকে অতিমাত্রায় চিনি আর মদের আসক্তিতে পাইয়াছিল; মাত্রাটা এতই বেশি ছিল যে—আমার বিস্তর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও—একদিন সে আবারও এই জাতীয় একটা নতুন ছিচকা চুরিতে লিপ্ত হইল। প্রমাণ পাইয়া তাহাকে মা-বাবার কাছে ফিরাইয়া দিব বলিয়া ভয় দেখাইলাম। পরে আমি বাহিরে গেলাম, আর কাজের চাপে খানিক বেশি সময়ই বাড়ির বাহিরে কাটাইলাম।

“বাড়ি ফিরিবার সঙ্গে সঙ্গেই যে জিনিশটা প্রথম আমার চোখে পড়িল তাহাতে সাংঘাতিক ভয়ে কি হতভম্বই না হইয়াছিলাম! দেখিলাম আমার ছোট্ট ভালোমানুষটি, আমার জীবনের এই দুষ্ট সঙ্গীটি আলমারির একটা পালা হইতে ঝুলিয়া রহিয়াছে! পা দুইটি মেঝে প্রায় ছুঁই ছুঁই, একটা চেয়ার—যাহা সে নিঃসন্দেহে পায়ে ঠেলা দিয়া সরাইয়া দিয়াছে—একপাশে উল্টাইয়া রহিয়াছে; তাহার মাথাটা ঝাঁকুনি খাইয়া এক কাঁধের উপর হেলিয়া গিয়াছে; মুখটা ঝুলিয়া রহিয়াছে, আর বড় বড় করিয়া খোলা চোখ দুইটা এমন ভয়ানক স্থিরদৃষ্টিতে তাকাইয়া ছিল যে প্রথম প্রথম আমার মনে হইয়াছিল ধড়ে প্রাণটা বুঝি তখনও আছে। দড়ি হইতে তাহাকে নামানোর কাজটা আপনারা যতটা সহজ মনে করিতেছেন ততটা সহজ ছিল না। ইহার মধ্যেই সে ভারি দড় হইয়া গিয়াছিল; আর দপ করিয়া সে মাটিতে পড়ুক এটা—কি কারণে বলা মুশকিল—আমার মন কিছুতেই মানিয়া লইতে প্রস্তুত ছিল না। দরকার পড়িল তাহার গোটা ভারটা এক বাহুর উপর লইয়া অন্য বাহু বাড়াইয়া হাতে দড়িটা কাটিবার। তবে এই কাজটা সারিয়াও সব কাজ সারা হইল না; ক্ষুদে দানবটি করিয়াছিল কি, চিকন শক্ত যে রশিটা সে ব্যবহার করিয়াছিল তাহা মাংসের অনেক গভীর পর্যন্ত কাটিয়া ঢুকিয়া গিয়াছিল, তাই এক্ষণে ছোট্ট কাঁচি হাতে দুই পাশে ফুলিয়া-ফাপিয়া ওঠা মাংসের খাঁজে দাবিয়া যাওয়া রশির সন্ধান চালাইবার ডাক পড়িল। 

“আপনাকে বলিতে ভুলিয়াছি, আমি প্রাণপণে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাইয়াছিলাম; কিন্তু প্রতিবেশীদের কেহই আমার সাহায্যে আগাইয়া আসিতে রাজি হইলেন না, তাহারা সভ্য জগতের যে আচার-অভ্যাস তাহার অনুগত ছিলেন; কি কারণে জানি না দড়িতে ঝোলা মানুষের ঘটনায় কখনো সংস্রব রাখিতে চাহে না কেহ। শেষ পর্যন্ত একজন ডাক্তার আসিলেন, আর জানাইলেন কয়েক ঘণ্টা আগেই শিশুটির মৃত্যু হইয়াছে। অনেকক্ষণ পরে—দাফনের প্রয়োজনে—তাহার কাপড়চোপড় খুলিয়া লইতে হইলে দেখা গেল মৃতদেহ এতটাই শক্ত হইয়া পড়িয়াছে যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াইতে পারার আশা ছাড়িয়া দিয়া কাপড়চোপড়মুক্ত করার জন্য তাহার গায়ের পোশাক-আশাক ছিঁড়িয়া আর কাটিয়া ফেলিতে হইল।

“যে কমিশারকে—নিয়মমাফিক—দুর্ঘটনার খবরটা জানাইতে বাধ্য হইলাম তিনি আমার দিকে আড়চোখে তাকাইয়া—নিঃসন্দেহে, খুব সম্ভব নির্দোষ আর দোষী নির্বিশেষে সবাইকে ভয় দেখাইবার একটা বদ্ধমূল আর পেশাগত প্রবণতায় তাড়িত হইয়া—আমাকে বলিলেন: ‘ব্যাপারটা কেমন জানি সন্দেহজনক ঠেকিতেছে!’

“এক্ষণে বড় একটা কাজ বাকি রহিয়া গেল, একমাত্র এই চিন্তাটাই ভয়াবহ উদ্বেগের কারণ হইয়া দাঁড়াইল আমার; মা-বাবাকে খবরটা দিতে হইবে। ঐদিকে কদম বাড়াইতে আমার পা দুইটি রাজি হইল না। শেষমেশ সাহস করিলাম। কিন্তু মহাহতবাক হইয়া খেয়াল করিলাম মায়ের কোন ভাবান্তর নাই, তাহার চোখের কোণায় কোন অশ্রুবিন্দুই দেখা গেল না। ধরিয়া লইলাম অত্যধিক ভয়াবহতায় আক্রান্ত হইয়া তাহার এই আশ্চর্য আচরণ, আর মনে পড়িল সুপরিচিত প্রবাদ বাক্যটি: ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’।

“আর বাবার কথা কি বলিব, তিনি অর্ধেক নির্বোধের মতো আর অর্ধেক স্বপ্নদ্রষ্টার মতো কথা একটা বলিয়াই তৃপ্তিলাভ করিলেন: ‘তারপরও, যাহা হইয়াছে তাহা হয়তো ভালই হইয়াছে; একদিন না একদিন তাহার পরিণতিটা করুণই হইত!’”

“ইত্যবসরে মৃতদেহটা আমার বসিবার ঘরের খাটিয়ার উপর রাখা হইল; আর একজন কাজের বুয়ার সহায়তায় আমি শেষকৃত্যের প্রস্তুতি লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম, এমন সময় আমার চিলেকোঠায় ঢুকিলেন মা জননী। বলিলেন, ছেলের মৃতদেহটা তিনি দেখিতে চাহেন। সত্যের খাতিরে বলিতে হয়, আপন দুঃখে উন্মত্ত হইবার সুযোগ হইতে তাহাকে নিবৃত্ত করিতে আর এই পরম ও পবিত্র সান্তনায় বাধ সাধিতে পারিলাম না আমি। তারপর তিনি আমাকে বলিলেন তাহার পুত্রধন যে জায়গায় গলার ফাঁসটা লাগাইয়াছিল সেটা দেখাইতে। ‘আহা! না! বেগম সাহেবা, উহাতে আপনার ভালো হইবে না’—আমি তাহাকে উত্তর দিলাম। আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার চোখ দুইটা যখন শোকাচ্ছন্ন আলমারির দিকে ঘুরিয়া গেল তখন একটা ত্রাস আর একটু ক্রোধ মেশানো বিষাদের সহিত নজরে পড়িল আলমারির পালার উপর পোতা পেরেকটা আর তাহার সঙ্গে তখনও ঝুলিয়া থাকা দড়ির একটা লম্বা মাথা। দুঃখের শেষচিহ্নটি উপড়াইয়া লইবার জন্য সজোরে লাফাইয়া উঠিলাম, আর যেই খোলা জানালা দিয়া জিনিশটা বাহিরে ফেলিয়া দিতে যাইতেছি, বেচারী ভদ্রমহিলা আমার বাহু আঁকড়াইয়া ধরিলেন, আর অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠে বলিলেন: ‘আহা! সাহেব! ঐটা আমাকে রাখিতে দিন! দোহাই আপনার! আপনার পায়ে পড়ি!’ আমার মনে হইল, হতাশা, নিঃসন্দেহে, তাহাকে এতই ভয়কাতর করিয়া তুলিয়াছিল যে এতক্ষণে স্নেহে অভিভূত হইয়া যে জিনিশটা তাহার পুত্রের মৃত্যুর কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল তাহা একটা ভয়ানক আর প্রাণপ্রিয় স্মারকস্বরূপ রাখিতে চাহিতেছেন তিনি।—পেরেক আর রশিটা তিনি দখল করিলেন।

“শেষমেশ! শেষমেশ! সব কাজ ফুরাইল। এক্ষণে আমার কাজে ফিরিয়া যাওয়াটা—নিত্যদিনের তুলনায় অধিক মন লাগাইয়া কাজ করাটা, এই ছোট্ট লাশটা আমার মাথার কোষে কোষে যেভাবে দাবড়াইতেছিল, আর যাহার প্রেতমূর্তি বড় বড় চোখের স্থির দৃষ্টিতে যেভাবে আমাকে হয়রান করিতেছিল তাহাকে একটু একটু করিয়া তাড়াইয়া দেওয়াটা—বাকি রহিল। কিন্তু পরের দিন একগাদা চিঠি পাইলাম: কতকগুলি আমার বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়ার লেখা; অন্য কতকগুলি আশপাশের বাড়িঘরের বাসিন্দাদের পাঠানো; একটা দ্বিতীয় তলার; অন্যটা তৃতীয় তলার; অন্যটা চতুর্থ তলার, এবং এইক্রমে অন্যান্য তলার, কোন কোনটা একটু হালকা রসিকতা করিয়া লেখা, যেন বা তাহাদের সনির্বন্ধ প্রার্থনাটুকু এই পরিহাসরসিকতার আড়ালে লুকাইতে চাহিতেছেন; অন্য কোন কোনটা একেবারেই বেহায়া ধরনের আর লেখার নিয়মকানুনবর্জিত, কিন্তু সব কয়টার একটাই লক্ষ্য—অর্থাৎ আমার হস্ত হইতে শোকাবহ আর প্রশান্তিপ্রদ দড়ির একটা টুকরা পাওয়া। স্বাক্ষরকারীগণের মধ্যে—আমার বলিতে হয়—পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যাই ছিল বেশি; কিন্তু—কথাটা ভালো করিয়া খেয়াল করিবেন—সকলেই কিন্তু কলঙ্কিত আর ইতর শ্রেণীর লোক ছিলেন না। চিঠিগুলি আমি রাখিয়া দিয়াছি।

“তখন আমার মাথায় একটা হঠাৎ আলোর ঝলকানি হইল, আর বুঝিতে পারিলাম কি কারণে মা জননী এতটা জেদের সহিত আমার হাত হইতে রশিটা ছিনাইয়া লইয়াছিলেন আর কোন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হইয়া সান্তনা পাইতে চাহিয়াছিলেন।”

 

তর্জমা: সলিমুল্লাহ খান

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!