• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
মুক্তগদ্য

জীববিদ্যার গণিত


লাবণ্য প্রভা
প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১, ০২:০১ পিএম
জীববিদ্যার গণিত

সকল বোধই  ইচ্ছা নিরপেক্ষ। কিংবা ইচ্ছা নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই। তাই বিব্রত নই, কখনো বিব্রত নই রজনীর নিষিদ্ধ প্রহরে চুম্বনপ্রত্যাশী হতে। যাকে তোমরা আওয়ার অব উলফ বলো, তখনই তো মাহেন্দ্রক্ষণ কাম ও তৃষ্ণায় ভস্ম হওয়ার। পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে ক্রুদ্ধ নেকড়ের বিচরণ। জানালায় জানালায় আঁচড় কাটে। রক্তের ভেতর তুমুল নীরবতায় ডানা ঝাপটায়। উন্মাদ ঘুঙুর আমি তখন। তাণ্ডব নৃত্যে আকাশ-বাতাস কাঁপাই। এই দ্যাখো, একশ একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছি আঙিনায়। জন্ম আর মৃত্যুর কোনো বিরোধ থাকবে না। ছিল না কখনোই। ছিল না জীবিত আর মৃতদের মধ্যে দূরত্ব। তুমি তো জানোই, নিশ্বাসের খুব কাছাকাছি তাদের অবস্থান।

আর আওয়ার অব উলফেই লিখতে বসি আমি। আওয়ার অব উলফেই আশ্লেষে চুম্বন করি; চুম্বন করি বিষের পেয়ালায়। চুম্বন করি মৃত্যুর একবিন্দু আরক।

ইয়েস! আই অ্যাম লস্ট ইন দ্য মিস্ট। পাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাচ্ছ! এই সময়ই আমার বারুদের গন্ধে ঘুম ভেঙে যায়! বৃষ্টির মধ্যে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালে যেমন গন্ধ বের হয় সে রকম গন্ধ। ভয়েস রেকর্ডারে বলি: আমি ও মা মারা যাচ্ছি অচিরেই! জমাট লাভার ভেতর রেখে যাব জীবাশ্ম আমাদের! মানব প্রজাতির বিপন্নতার মুহূর্তে আমাদের জাগিয়ে দিয়ো!

২.

আর আমাকে বলো নগরীর কোন কোন নগ্নতা বিষয়ে তোমরা অবগত নও!

জানি, নগরের নগ্নতা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা নীরব থাকে। আর বিষয়টি অধিকতর তদন্তের মধ্যে পড়ে বলে জানান মেয়র। 

নগ্নতা বলতে তারা বোধ হয় কেবল পোশাকহীনতাকেই মনে করে।

আমি অসহিষ্ণু, বারবার জানতে চাই। আমাকে বলো, আসলেই তোমরা কি অবগত নও, নগ্নতা বিষয়ে! তোমরা কি দেখোনি রাজ অমাত্যরা কীভাবে দিনের পর দিন লুণ্ঠন করেছে! তারা তোমাদের নারীদের তুলে দিয়েছে বিশ্ববাজারে! তোমাদের শিশুদের মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা অবকাশ যাপনে গেছে বিলাসবাড়িতে! তোমরা কি অবগত নও, তোমাদের সন্তানদের হাতে কারা তুলে দিচ্ছে আসক্তির সমস্ত উপকরণ! 

তবে কেন তোমরা নগ্নতা নিয়ে নীরব! 

তোমাদের নগর নগ্ন, লোভের উল্লাস দৃশ্যমান।

নগরের পোলিশড দেয়াল ভেদ করে পুঁজবদ্ধ রক্তনালি বের হয়ে আসছে! নগরের একেকটি ঝলমলে প্রাসাদ একেকটি অন্ধকার দ্বীপ! এত দিনেও তা তোমাদের বোধগম্য নয়! 

তবু তোমরা নগ্নতা বলতে কেবল পোশাকহীনতাকেই বুঝবে!

খালি পেট, খালি পা, মাথার ওপর ছাদহীনতাকে কি নগ্নতা নয়! বিরামহীন দুর্নীতি কিংবা অনৈতিকতাও যে নগ্নতা, তা-ও কি তোমরা জানো না! 

দ্যাখো, তাদের ঝাঁ চকচকে কাচের দেয়াল ভেদ করে সব স্পষ্ট। তাদের শোবার ঘর, তাদের বিছানার তলায় জমাকৃত মুদ্রা, তাদের বালিশের তলায় মারণাস্ত্র, তাদের পুঞ্জীভূত কদর্যতা, তাদের মুখের অশ্লীল শব্দ বুনন, সব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।  

অথচ নগ্নতা বলতে তোমরা কেবল পোশাকহীনতাকেই মনে করো!

হে আমার পুত্র-কন্যারা শুনে রাখো, এই নগরে কোনো প্রেম নেই। ভালোবাসা নেই। আছে উন্মাদ কাম আর হিংসার উৎসব। ধর্ষিতার আর্তনাদকে তোমরা শিৎকার ভেবে ভুল করো না… 

৩.

শোবার ঘরেই ছিলাম। কিন্তু কীভাবে যেন চলে এসেছি বাইরে। নিজেকে জলাধারের পাশে দেখে অবাক হই আমি। মনে পড়ে, ঠিক ঠিক স্বপ্নের অর্থ করতে পারতাম বলে, রাজমহলে বেশ দাম ছিল। একদিন এক স্বপ্ন দৃশ্য বর্ণনা করে, মহারানিকে সতর্ক করেছিলাম। তাই কপালে জুটল বিতারণ। পাগল বলে, চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নগর পরিখা পার করে দিল। 

তারপর! ধীরে ধীরে শরীরখানা টেনে জলাশয়ের ধারে বসে থাকি। জনপদহীন জায়গায় প্রথমে ভয় লাগে। পরে সাহস করে গ্রামের এক কিশোরকে ডাকি। কিশোর আমায় ডোঙ্গায় কওর পার কওর দেয় নগরের ওই পাড়ে। সূবর্ণবলয় দিয়ে গ্রামবাসীকে অনুরোধ করলাম আমাকে একটি কুটির নির্মাণ করে দিতে। বলি: নিরিবিলি ঈশ্বর জপ করতে চাই। রাজ অমাত্য ছিলাম, কৌশল জানি। কেননা ধর্ম বিষয়ে সাধারণ মানুষ সব সময়ই সমীহ করে।

কুটির নির্মাণ হয়। সবাই চলে যায়।

কত বছর আগে! দশ বছর নয়, পনেরো বছর নয়, পঞ্চাশ বছর নয়, সহস্র সহস্র বছর! ঘড়ি থেকে কাঁটা মুছে দিলে আর সময় থাকে না, জানো তো! এখন আমার দিন নাই, রাত নাই। সব সময় স্বপ্ন দেখতে পারি। আহার নিদ্রা ভুলে স্বপ্ন দেখতে পারি।

দ্যাখো, নিজের অস্থি প্রজ্জ্বলিত করে হোমের আয়োজন করেছি। সে আয়োজনে উপস্থিত আমার সন্তানেরা। তারা বলে, জননী অভয় দাও, এই পৃথিবী যেন ফুল-ফল-লতাপাতায় পূর্ণ থাকে। প্রজাপতি বলে, সেই ফুলে ফুলে আমরা যেন উড়ে বেড়াতে পারি নির্বিঘ্নে।

অথচ আমি তাদের কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না। কেননা মানুষ ভয়ংকর রকম আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে!

৪.

আর আমার অন্য এক সন্তান এস্থার জানালায় তখন বৃষ্টি আঘাত করে। তার ঠোঁটের কোনায় মেঘ জমেছে। তার বুকের মধ্যে মেঘ জমেছে। তার চোখের পাতায় ঘন কালো মেঘ। তার বইয়ের পাতায় মেঘ ও কুয়াশা। এই সব মেঘ, এই সকল কুয়াশা পুঞ্জীভূত কান্নার মতো, তার জানালার বৃষ্টির ছাঁটের মতো আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। ভেজা ভেজা ছাতা, বৃক্ষ, ফুটপাত আর দালান নিয়ে শহরের মধ্যিখানে একটা নীলপদ্ম ফুটে ওঠে। এস্থার মন আচমকা ভয়ানক বিট্রে করে ওঠে। হু দ্য হেল য়্যু আর জাজিং মি! ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। 

মহল, আড়ম্বর ছেড়ে ডানাহীন কবুতরের মতো সে হাঁটে। একের পর এক দেয়াল টপকায়। পথে পথে মৃত নর্তকীদের গলিত ঘুঙুর পড়ে আছে!

এস্থা আর বাড়ি ফিরবে না।

৫.

আহ! উন্মুক্ত আগুন এবার আমাকেই নিরাময় করো। গুনে তিন মণ বেশি ধান পাঠাব মেলিসার মন্দিরে। আর দেব দুগ্ধবতী গাভী। 

আমাদের শিশুদের রক্তে প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে... 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!