• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইতিহাসবিদ আহমদ ছফা


আজিজুল রাসেল
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২১, ০৯:৪৮ পিএম
ইতিহাসবিদ আহমদ ছফা

বড় লেখকদের বেলায় একটা সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদের পরিচয় নিয়ে। জ্ঞানের নানা শাখায় তাঁরা বিচরণ করেন। নানা বিষয় নিয়ে তাঁরা লেখেন। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান—সব বিষয়ই ঘুরেফিরে আসে তাঁদের লেখায়। বিস্তর বড় লেখকের উদাহরণ দেওয়া যায়, একই সঙ্গে যাদের আমারা সাহিত্যিক বলতে পারি, দার্শনিক কিংবা ইতিহাসবিদ বললেও চলে তাঁদের। কার্ল মার্কস বা গ্যেটে বা বঙ্কিমচন্দ্রকেও আমরা এ ধরনের লেখক বলতে পারি। অথবা বাংলার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা কবি, গল্পকার, নাট্যকার না গীতিকার বলব, এ নিয়ে ধন্দে পড়ে যাই। একই কথা তো নজরুলের বেলায়ও প্রযোজ্য। আহমদ ছফাকে যখন পাঠ করি কেন যেন একই রকম একটা বোধ হয় আমার। আহমদ ছফাকে কী বলব আমরা? কবি, কথাসাহিত্যিক, সমাজতাত্ত্বিক না ইতিহাসবিদ? আহমদ ছফা নিজেও হয়তো এটা নিয়ে কিছুটা চিন্তিতই ছিলেন—লোকে কী বলবে তাঁকে? কোন কর্ম ছাপিয়ে কোন কর্ম, কোন পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর কোন পরিচয় প্রধান হয়ে ওঠে, এ বিষয়ে ছফা আসলেই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। ছফার লেখার একটুখানি উদ্বৃতি দিই, বুঝতে পারবেন:

“বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনাটির প্রতি আমার অন্য একটা বিশেষ কারণে একটা বিরক্তিবোধ রয়েছে। যথেষ্ট না হলেও সাহিত্যের নানা শাখায় অবশ্যই কিছু দাহিকাশক্তিসম্পন্ন রচনা আমি লিখেছি। এই সকল রচনায় আমার মনন, মেধা এবং শ্রমের অধিকাংশ ব্যয় করেছি। কিন্তু মানুষ অনেক সময় আমার সাহিত্যকর্ম বলতে একমাত্র এই বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের উল্লেখ করে থাকেন। যদিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি, এই জিনিসটি আমাকে খুবই আহত করে। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছি, লোকে ওই লেখাটার কথা বলে কেন? আমার অন্যান্য রচনার কি কোন সাহিত্য মূল্য নেই? আমার অন্যান্য রচনাকে আড়াল করে রাখবার জন্য এই বইটির প্রতি একটা চাপা নালিশ সবসময়ই পুষে আসছিলাম।” (ছফা: ২০১৬: ৭)

আসলে আহমদ ছফা শুধু বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নিয়েই চিন্তিত ছিলেন না যে এটা আবার না তাঁর অন্য রচনাকে ছাপিয়ে যায়। আমার মনে হয়, আহমদ ছফার চিন্তা ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল লেখা ছাপিয়ে যেন না আবার চিন্তাশীল লেখাগুলো প্রধান হয়ে ওঠে। আহমদ ছফাকে আমি নাখোশ করব না। আমি আহমদ ছফার এক ধরনের লেখাকে অন্য ধরনের লেখা থেকে প্রধান-অপ্রধান করে দেখাব না। বরং আমি বলব আর সব বড় লেখকের মতো আহমদ ছফা লেখালেখির যে মাঠেই বিচরণ করেছেন, তিনি অসফল হননি। মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সব ক্ষেত্রেই। একটি কথা বলতে দ্বিধা নেই, আহমদ ছফা যে কীর্তি রেখে গেছেন, সে তুলনায় তাঁর কাজ এখনো খুব কমই আলোচিত হয়েছে। আজ পর্যন্ত আহমদ ছফাকে নিয়ে আলোচকেরা যা আলোচনা করেননি বা বলব একদম কম করেছেন, তা হলো আহমদ ছফার গভীর ইতিহাসবোধ। যে লেখাই লিখেছেন আহমদ ছফা, তাঁর লেখায় গভীর ইতিহাসবোধ লক্ষ করা যায়। আমার প্রস্তাব: আহমদ ছফা একজন ইতিহাসবিদও। তিনি শুধু সন-তারিখ বা ওকালতিকেন্দ্রিক ইতিহাস করেননি। পাদটীকার ভারে তাঁর বক্তব্য ধূমায়িত করেননি। গভীর চিন্তাবোধ এবং পর্যবেক্ষণ থেকে তাঁর ইতিহাসবোধ উৎসারিত। আহমদ ছফার ইতিহাসবোধের হদিস পাওয়া যায় তাঁর লেখা কবিতা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধে। গভীর ইতিহাসবোধ না থাকলে ওঙ্কারের মতো উপন্যাস, কবি ও সম্রাটের মতো কবিতা, বাঙালি মুসলমানের মন, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, কিংবা শতবর্ষের ফেরারি: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো লেখা, লেখা যায় না। সরাসরি প্রথার ভারে ভারী ইতিহাস খুব একটা লেখেননি ছফা। খুব অল্প বয়সে, চব্বিশ কি পঁচিশ হবে, সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস নামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। এখানে আমি মূলত আহমদ ছফার তিনটি লেখাকে কেন্দ্র করে তাঁর ইতিহাসবোধ হদিস করব।

প্রথমটি আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থের নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ: ‘বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে’। অনেকটা ইতিহাসতাত্ত্বিক প্রবন্ধ এটি। আহমদ ছফা প্রবন্ধটি যখন লেখেন তখন এক উত্তাল সময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তখন সম্ভবত প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘বাঙালির ইতিহাস প্রসঙ্গে’। পরে হয়তো নামটি একটু পরিবর্তন করে রাখেন ‘বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে’। কবি সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘অভিযান’ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটি নাতিদীর্ঘ হলেও ছফার ইতিহাস পাঠ ও চিন্তার গভীরতা বোঝা যায় এ প্রবন্ধ দিয়ে। এ প্রবন্ধে ছফা বাংলার ইতিহাস লেখনী নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন, তাঁর আগে বা তাঁর সমসাময়িক খুব কম লেখকই তা করতে পেরেছেন। ছফা তাঁর প্রবন্ধ শুরুই করেছেন বঙ্কিমের একটি বিখ্যাত প্রবন্ধের লাইন উদ্ধৃত করে, ‘বাঙালির ইতিহাস চাই, নাহিলে বাঙালি বাঁচিবে না (চট্টোপাধ্যায় : ২০০৬: ৮১৩)।’ বহু বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘সাহেবরা যদি পাখি মারতে যান, তারও ইতিহাস লেখা হয় কিন্তু বাংলার কোন ইতিহাস নেই।’ বঙ্কিম যে বাংলার ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন, সেটা ঠিক ছিল। তিনি লিখেছিলেন, তাঁর সময় পর্যন্ত বাংলার যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তাতে বাংলা নেই, যা আছে তা খণ্ডিত। আর বাকিগুলোকে তিনি বালকদের জন্য লেখা ইতিহাস বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনায়ও বাংলার ইতিহাস ছিল খণ্ডিত। বঙ্কিমের আর আর লেখা তো বটেই ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ লেখাতেও দেখা যাবে বাংলার ইতিহাস বলতে তিনি শুধু হিন্দুদের ইতিহাসই বুঝতেন। মুসলমান সেখানে অচ্ছুত। এভাবে বঙ্কিমের বাংলার ইতিহাস উচ্চবর্গের ইতিহাস। শুধু একটি সম্প্রদায়ের ইতিহাস। একজন অসাধারণ মেধাবী লেখক হয়েও সাম্প্রদায়িকতা বঙ্কিমকে সংকীর্ণ করে দিয়েছিল। আহমদ ছফা নির্মোহভাবে এর কারণ খুঁজেছেন। ছফা লিখেছেন, ‘কিন্তু তেমন একখানি (পরিপূর্ণ বাংলার ইতিহাস) ইতিহাস লেখা তাঁরও পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। বাধা ছিল অনেক ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক। এ চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে বাঙালির ঠিকুজি কুলজি আবিষ্কার করে জনসমক্ষে তুলে ধরা ছিল অসম্ভব (ছফা: ২০১৭: ৭৬)।’ বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে আহমদ ছফা বাংলার ইতিহাস চর্চার দুর্বলতা এঁকেছেন এভাবে, ‘মন তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ইতিহাস এখনো স্বপ্নই থেকে গেছে। তথ্যের সমাবেশ করা সম্ভব, ঘটনা বর্ণনা করা যায়। সীমিত পরিসরে অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিল্প, সাহিত্যের ওপর ভাসা ভাসা আলোচনা, তা-ও করা যায় না এমন নয়। একটি গ্রন্থ এসবকে কোল দিয়ে ফুলে উঠতে পারে। কিন্তু ইতিহাস হয়ে উঠবে না (ছফা: ২০১৭: ৭৬)।’

আহমদ ছফা যখন এ প্রবন্ধটি লিখছেন তখনো বাংলায় বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ ইতিহাস বলতে বুঝতেন সাল-তারিখ ধরে ধরে ঘটনার বিবরণ আর রাজা-মহারাজাদের ক্রমপঞ্জি বা যুদ্ধ-বিগ্রহের বিবরণ। বিশ্বের অন্য প্রান্তে স্বল্প পরিসরে তখন সাধারণ মানুষের ইতিহাস লেখা শুরু হয়ে গেছে ঠিক। সি এল আর জেমস এর বহু বছর আগেই তাঁর ‘দ্যা ব্লাক জ্যকবিনস’ লিখে ফেলেছেন, ইপি থমসনরা তলা থেকে ইতিহাস শুরু করে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস সে খবর ছফা ঠিকই জানতেন। তবে সেই ধারার ইতিহাসের ঢেউ তখনো প্রবলভাবে পৌঁছেনি বাংলায়। রণজিৎ গুহ এবং তাঁর দল, এরও অনেক পর, সত্তরের দশক যখন শেষ শেষ তখন নিম্নর্গের ইতিহাসের কথা ভাববেন। আবার আশির দশকের শেষ দিকে তাঁদের ইতিহাস থেকে উবে যাবে নিম্নবর্গ। আমাদের এই সময়েও দেখেছি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-ছাত্র এখনো সন -তারিখ, রাজরাজড়া বা যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস পড়ে এবং লিখে সময় পাড় করেন।

বাংলার ইতিহাস নিয়ে আহমদ ছফার অনুসন্ধান গভীর। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন বাংলার ইতিহাসে সাধারণ মানুষের স্থান নেই। এর কয়েকটি কারণও ছফা চিহ্নিত করেছেন। ছফার মতে বাংলার ইতিহাস যারা লিখেছেন তারা ঢালাই হওয়া মানুষ। প্রমথ চৌধুরীর উক্তি, ‘বাঙ্গালি গড়ে উঠেনি, ঢালাই হয়েছে’, আহমদ ছফা যথার্থ মনে করেছেন। ছফার মতে, বাঙালি ঢালাই হওয়া মানুষ। আর ঢালাই হয়েছে মূলত বিভিন্ন সময়ে যেসব মানুষ রাজশক্তির আনুকূল্য পেয়েছেন, কাছাকাছি থেকেছেন যারা রাজশক্তির। তবে তিনি বলেছেন বাংলাদেশের ‘আসল’ মানুষেরা কখনো ঢালাই হয়নি। আহমদ ছফার এই ঢালাই না হওয়া আসল মানুষ কারা? এই আসল মানুষ মূলত সাধারণ মানুষ। আরও স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ মানুষই আসল মানুষ। ছফার এই আসল মানুষের বড় অংশই কৃষক, বাকিরা শ্রমিক। ফ্রাঞ্জ ফানোঁ যেমনটা তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য রেচেড অব দ্য আর্থে’ বলেছেন পরাধীন দেশের সাধারণ কৃষকদের মধ্যেই আসল রূপের সন্ধান মেলে। তারা কোনো রাজশক্তির আনুকূল্য পাননি বা নেননি। যতটা পেরেছেন তারা মোকাবেলা করে গেছেন পরাধীনতা চাপিয়ে দেয়া শক্তির। তবে ছফা বলেছেন, এই ঢালাই না হওয়া আসল মানুষেরাও বাংলার ইতিহাস লিখতে পারেননি। বাংলার যে ইতিহাস আছে, তা লিখেছেন ঢালাই হওয়া মানুষেরাই। তাই বাংলার ইতিহাসে ঢালাই হওয়া মানুষের কথা, তাদের পছন্দ-অপছন্দই এসেছে। ছফার ‘আসল’ মানুষেরা সেখানে থেকে গেছে অপাঙক্তেয়।

বাংলার ইতিহাসে সাধারণ মানুষেরা কেন নেই, তার আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন আহমদ ছফা। তাঁর মতে ‘আগের যুগের ইতিহাস লিখিয়েরা সাধারণ মানুষের শ্রম-চেষ্টা-কল্পনা এবং ধ্যানকে কখনো ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে ধরে নেননি। তার ফলে ইতিহাস থেকে ইতিহাসের আসল উপাদানই বাদ পড়ে গেছেন। তবে সাধারণ মানুষেরা কেন তাদের ইতিহাস লিখতে পারেননি, সেটিও খুঁজেছেন ছফা। সেই দোষ তিনি ‘ঢালাই হওয়া’ মানুষদের দেননি। আহমদ ছফার মতে, ‘বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এককাট্টা হয়ে ইতিহাসের চেহারা পাল্টাবার জন্য নিজেদের বিক্রম এবং সংঘশক্তির আস্থায় আস্থাবান হয়ে এগিয়ে আসেননি কখনো। ঐতিহাসিকও তো সমাজের একজন। সমাজ যদি না এগোয়, ঐতিহাসিক তো আর হাওয়ায় ইতিহাসের উপকরণ খুঁজতে পারেন না। সাধারণ মানুষ যদি পৃথিবীতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে না ওঠে, তাদের অতীতকে গৌরবময়ী করে ঐতিহাসিক দেখাতে পারেন না। তাই বাঙালির স্বপ্ন এখনও স্বপ্নই থেকে গেছে (ছফা: ২০১৭ : ৭৭)।’

যথার্থ উপলব্ধি ছফার। আহমদ ছফার এই উপলব্ধি থেকে জর্মন দার্শনিক হেগেলের কথা স্মরণ করা যায়। ইতিহাস দর্শন ও বিশ্ব ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হেগেল একদা ভারতের ইতিহাস নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। হেগেল বলেছিলেন, ভারতের কোনো ইতিহাস নেই। ভারতের ইতিহাস পরাধীনতার ইতিহাস। ভারত কোনো পরদেশ জয় করতে পারেনি। ভারতের ইতিহাস শুধু পরাজয়ের ইতিহাস। ‘ফিলজফি অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রিতে’ হেগেল এই বলে পরাধীনতাবাদ বা উপনিবেশবাদকে জায়েজ করেছিলেন যে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ অপরাপর বিশ্বে স্বাধীনতার মর্ম ছড়িয়ে দেবে। হেগেলের মত ছিল, ইউরোপ যদি এর সভ্যতা পৃথিবীর অপরাপর মানুষের ওপর আরোপ করে, তাহলে সেখানকার মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে। হেগেলের এই শর্ত ঔপনিবেশিত মানুষেদের স্বাধীনতা বঞ্চিত করে। হেগেলের মত ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ পৃথিবীর অপরাপর মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বশর্ত। অবশ্য হেগেল যে দৃষ্টিভঙ্গি বা জায়গা থেকে মন্তব্য করেছেন ছফার দৃষ্টিভঙ্গি তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা উল্টো। ছফা বলেছেন, নিজের ছাপ ইতিহাসে রাখতে হলে তাকে পরাধীনতার গ্লানি মুছে স্বাধীন হতে হবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আহমদ ছফা সেই সম্ভাবনা দেখেছিলেন। ছফার মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার সাধারণ মানুষের ইতিহাস লেখার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। তাঁর মতে, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ‘মরণপণ লড়াইয়ের’ মধ্যে নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল।

আহমদ ছফা লিখেছেন, “চরিত্রের যা কিছু মহৎ, শ্রেষ্ঠ এবং সত্য তার ওপর দাঁড়িয়েই তারা ফ্যাসিবাদী পাকিস্তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মানুষকে দাস করে রাখবার জন্য মানুষ যে জঙ্গলের আইন চালু করেছে। গত পঁচিশে মার্চ তারিখের পর থেকে সেই নৃশংস বনের আইন প্রয়োগ করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে খাঁচায় আটক রাখবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে তারা। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ পশুশক্তির দাস না থেকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণধ্বনি তুলেছেন। বস্তুত বাংলাদেশের এ সংগ্রাম প্রাগৈতিহাসিক পাকিস্তানি ডাইনোসরের বিরুদ্ধে সভ্য স্বাধীনতাকামী মানুষের মানুষী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। এই সংগ্রামের এসিড স্পর্শে বাঙালি মানসিকতার খুব দ্রুত পালাবদল ঘটেছে। পূর্বেকার সংস্কারের জের রণ রক্ত সফলতার মধ্য দিয়ে তার চেতনা থেকে বুড়ো পাতার মতো ঝরছে প্রতিদিন। আর বিশ্বের এতাবৎকালের মানবসমাজের সংগ্রামী অভিজ্ঞতার সারৎসার তার চেতনায় স্থান করে নিচ্ছে এবং নতুন মানুষ হয়ে উঠেছে প্রতিদিন। যেকোনো জাতির জন্য আদর্শবদ্ধ দুঃখের হিমশীতল স্পর্শের চাইতে মহৎ শিক্ষা আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ যারা লড়াই করেছেন, যারা ছিন্নমূল হয়ে শরণার্থী শিবিরে বাস করেছেন সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, হবেন। অনেকে প্রিয়জন বিসর্জন দিয়েছেন, দিচ্ছেন এবং দেবেন। বাঙালি জাতি সামগ্রিকভাবে এমন ত্যাগ, এমন আত্মবিসর্জন ইতিহাসের আর কোনো পর্যায়ে করেনি। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আত্মবিশ্বাসের মরচে প্রচণ্ড বাস্তব আঘাতের মুখে ঝরছে এবং চরিত্রের যা সত্যিকার শক্তি বা সৃষ্টিশীলতায় বিকাশ লাভ করছে। এই লড়াই প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিয়ে বাংলার ইতিহাসের ভারকেন্দ্রে ঢালাই হওয়া মানুষেদের সমাজ থেকে বাংলার পাললিক মৃত্তিকার আসল সন্তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় আসন্ন হয়ে উঠেছে, তার স্থপতি বাংলার সাধারণ জনসাধারণ। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, নারী পুরুষ, লেখক, শিল্পী এবং সর্বস্তরের মানুষ।” (ছফা: ২০১৭: ৭৮)

          আর এভাবেই আহমদ ছফা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালার ইতিহাসে’র একটি মোক্ষম জবাব দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর ভাবধারার যেসব ‘আধুনিক’ মানুষ বাংলার সাম্প্রদায়িক ইতিহাস রচনা বা প্রত্যাশা করেন তাঁদেরকে দেখিয়েছেন তাঁদের কল্পিত বা চর্চিত বাংলার ইতিহাস ত্রুটিপূর্ণ এবং খণ্ডিত। আহমদ ছফা জোর দিয়েছেন, বাংলার ইতিহাস রচনা করতে হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমান, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, নারী-পুরুষ এবং সর্বস্তরের মানুষের ইতিহাসই সেখানে থাকতে হবে।

ছফা দেখিয়েছেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাস তৈরির যে সম্ভাবনা তৈরি করেছিল বাংলার পূর্বাংশের মানুষেরা, সে সম্ভাবনা বঙ্কিমের মতাদর্শ ধারণকারীদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। বাংলার পূর্বাংশের মানুষেরা যে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করেছে তা পুরো ভারতবর্ষের জন্যই দৃষ্টান্তস্বরূপ। ছফা, সেসব তাত্ত্বিকের বিশ্লেষণকে ভ্রান্ত বলেছেন, যারা ভারতীয় জনগণের একজাতির দাবি তুলেছেন।

‘সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থে আহমদ ছফা লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে ভারতের কংগ্রেস দলীয় তাত্ত্বিকেরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মতাদর্শগত ভিত্তিটির ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তাঁদের প্রচার প্রপাগাণ্ডার ধরনটি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে এসেছিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সকল ভারতীয় জনগণের একজাতিত্বের যে দাবি তুলে ধরেছিল, বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে সেই জিনিসিটিই আবার নতুন করে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটির অনুসারী শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের জন্মকে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধন বলে ব্যাখা করে আসছেন। কিন্তু এই ব্যখ্যাটির মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁক বরাবরই থেকে যাচ্ছে। অবশ্যই প্রশ্ন করা প্রয়োজন, ভারতের হিন্দু-মুসলমান দু’টি জাতি আলাদা এটি যেমন সত্যি নয়, তেমনি সত্য নয় ভারতের সব জাতি মিলে একটি জাতি।” (ছফা: ২০১৬: ১৬)

আহমদ ছফার এই আবিষ্কার, এই উপলব্ধি বাংলার তথা ভারতের অনেক তুখোড় ইতিহাসবিদ করতে পারেননি বা করতে চাননি। বাংলা তো বটেই, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের গভীর পাঠ না থাকলে এ উপলব্ধি সম্ভব নয়। আহমদ ছফা ইতিহাসকে মৃতভাবে পাঠ বা মোকাবেলা করেন না। তাঁর লেখায় অতীত এবং বর্তমান একাকার হয়ে যায়। তিনি অতীত অনুসন্ধান করেন বর্তমানকে বোঝার জন্য। তাই আমাদের অনেক মেকানিক্যাল বা প্রথাবদ্ধ ইতিহাসবিদের সাথে আহমদ ছফার বড় পার্থক্য। লাঁকা একদা বলেছিলেন, “অতীতকে ইতিহাস বলা চলে না। ইতিহাস বর্তমানের মাপকাঠি। অতীত শুদ্ধ বর্তমানে আসিয়াই ইতিহাস পদবাচ্য হয়।” (বাংলা তর্জমা: সলিমুল্লাহ খান) জানি না, আহমদ ছফা লাঁকা পড়েছিলেন কি না! না পড়লেও দোষ নেই। কথায় আছে মহৎব্যক্তিরা একই রকম ভাবেন। এ সময়ের একজন তুখোড় ইতিহাসবিদ অভিযোগ করেছেন, আহমদ ছফার লেখায় ঐতিহাসিক সময়কাল দু-একটি ভুলভ্রান্তি রয়েছে। আসলে আহমদ ছফা ইতিহাসের সাল থেকে ইতিহাসের গভীর পাঠেই মনোযোগ দিয়েছিলেন বেশি। সে ক্ষেত্রে ছোটখাটো ভুল আমরা মার্জনা করতেই পারি।

দার্শনিক হেগেল তাঁর ‘ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য ফিলজফি অব হিস্ট্রি’ গ্রন্থে ইতিহাসের মেথড বা পদ্ধতিকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ১. অরিজিনাল হিস্ট্রি, ২. রিফ্লেক্টিভ হিস্ট্রি ও ৩. ফিলোজফিক হিস্ট্রি। রিফ্লেকটিভ ইতিহাসকে হেগেল আবার চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। একটা হল ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি। যার উদ্দেশ্য হলো পুরো মানুষ, দেশ বা বিশ্বের ইতিহাস করা। আরেক ধরনের রিফ্লেকটিভ ইতিহাস হলো প্রাগমেটিক। রিফ্লেকটিভ পদ্ধতির তৃতীয় ধারটি হলো ক্রিটিক্যাল রিফ্লেকটিভ হিস্ট্রি। এ ছাড়া চতুর্থ একটি ধারাও করেছেন যাকে তিনি বলেছেন ফাইনাল টাইপ অব রিফ্লেকটিভ হিস্ট্রি। ক্রিটিক্যাল রিফ্লেকটিভ হিস্ট্রি প্রথাগত ইতিহাস যে ধারায় হয়, তেমন নয়। এটা হলো ইতিহাস লেখার ইতিহাস এবং ইতিহাস লেখার বিশ্লেষণ। মানে ইতিহাসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, ইতিহাসবিদদের লেখাকে বিচার-বিশ্লেষণ করা। আমার মনে হয়, আহমদ ছফা এ কাজটি করতেই বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং করেছেন।

 

দোহাই

ছফা, আহমদ। (২০১৭)। বাঙালি মুসলমানের মন । ঢাকা: বাঁধন পাবলিকেশন্স।

ছফা, আহমদ। (২০১৬)। সাম্প্রতিক বিবেচন: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। ঢাকা: হাওলাদার প্রকাশনী।

ছফা, আহমদ (২০১৮)। শতবর্ষের ফেরারি: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঢাকা: খান ব্রাদার্স এ- কোম্পানি।

Hegel, G.W.F. (1988). Introduction to the Philosophy of History. Cambridge: Hackett Publishing Compaû.

Sarkar, S. (1997). Writing Social History. New Delhi: Oxford University Press.

Stone, A. (2017). Hegel and Colonialism. Hegel Bulletin. 41(2), 247-270. doi:10.1017/hgl.2017.17.

Tibebu, T. (2011). Hegel and the Third World: The Making of Eurocentrism in World History. New York: Syracuse University Press.

Link copied!