হালের নেটফ্লিক্স, হইচই, চরকির যুগে হঠাৎই মুক্তি পেল সারা আফরিন প্রযোজিত ও কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ‘নীল মুকুট’। বাংলাদেশী একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দেয়া হয়েছে ছবিটি। প্রচারসর্বস্ব যুগে নানান কৌশলের হোক সে বৈঠকী কিংবা নাটুকে কিংবা অভিনব; কোন প্রচারণাই দেখতে পেলাম না ‘নীল মুকুট’ নিয়ে। এও অবশ্য ঠিক যে অনেক শিল্পবোদ্ধারা বলে থাকেন, ভালো জিনিসের জন্য প্রচারণার দরকার হয়না, তা এমনিতেই সময়কে উৎড়ে যায়। কিন্তু পরিচালক প্রথমেই আফ্রিকান এক প্রবাদের মারফতে দর্শকদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে ‘সিংহী তার গল্প বলার আগ পর্যন্ত শিকারীকেই নায়ক বলে ধরে নেয়’। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন আশেপাশে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, অনলাইন হেনস্থাতে যখন দেখতে পাই নারীই একমাত্র আক্রমণের লক্ষ্য সেসময়ে এমন একটা উপযুক্ত সিংহীর গল্পের ভালো একটা প্রচারণা হলে মন্দ হতো না।
‘নীল মুকুট’ ডকুফিকশন। ডকুফিকশনটা বাংলাদেশ মহিলা পুলিশের একদল সদস্যদের নিয়ে, যারা হাইতি নামক আফ্রিকার দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ করতে যায়। হাইতি যাবার জন্য দেশের মাটিতে তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি এবং হাইতি যাবার পরে তাদের মিশনে কাটানো সময়কাল—এটা নিয়েই ডকুফিকশন।
ডকুফিকশনটা আমার মনে কেন দাগ কেটেছে সেই ব্যক্তিগত অনুভূতির আলাপে যাবার আগে কিছু নৈর্ব্যক্তিক আলাপ সেরে ফেলা ভাল। তথাকথিত চলচ্চিত্র কিংবা নাটকে নারীর যে একটা শুধুমাত্র গৃহস্থালী রূপ দেখতে পাই তার বিপরীতে নীল মুকুটের নারী পুলিশ দলের সদস্যরা শুধু দেশের শান্তি-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত না বরং একটা সংকট বিদ্ধস্ত দেশ হাইতিতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মিশনে শান্তিরক্ষা করছে। বলে রাখা ভাল, #MeToo নামক সামাজিক আন্দোলনের এই সময়ে নানান রকমের ওয়েব সিরিজ কিংবা সিনেমা দেখি যেখানে নারী অধিকারকে সামনে রেখে অনেক বয়ান হাজির করা হয়। সেসব চলচ্চিত্র অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সেসব চলচ্চিত্রে বাস্তবতার চেয়ে আমাদের কাল্পনিক উচ্চাশার অনেক প্রতিফলন লক্ষ্য করি। সেসবের তুলনায় কামার আহমাদ সাইমনের ‘নীল মুকুট’ একেবারে সরাসরি দেখাচ্ছে, একটা শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথাকথিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নারী নিজেদের কিভাবে সঁপে দিচ্ছে। সেসব কাজ করতে গিয়ে প্রগতিশীল নারীবাদের যে একটা কাল্পনিক ইউটোপিয়া; তার প্রতিফলনের চেয়ে ‘হয়ে উঠা’ নারীকে দেখতে পাই তার পূর্বের সংকোচ ও বর্তমানের উৎড়ে উঠার মধ্য দিয়ে।
‘নীল মুকুট’ আমার কাছে বেঁচে থাকার গল্প। সেই বেঁচে থাকা একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে হতে পারে, একজন বাংলাদেশী হতে পারে এবং সর্বোপরি নারী হিসেবে বেঁচে থাকার গল্প। ঊর্ধতন কর্মকর্তা শাহানা বা অধস্তন মোনালিসা নামে যে মূল চরিত্রে আলোকপাত করা হয়েছে, স্ক্রিনে দেখতে পাই তারা তাদের কাজের সময় তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কগুলো, পারিবারিক সমস্যা, স্বামীর সাথে বনিবনা, সন্তানের কাছ থেকে দূরে থেকেও সন্তানের দেখভাল নিশ্চিত করা ইত্যাদি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে। দশভুজা দূর্গা রমনীর সাক্ষাৎ করিয়ে দেন শাহানা কিংবা মোনালিসারা।
ব্যক্তিগত ভাল লাগার আলাপে আসা যাক। ডকুফিকশনের শুরুই হচ্ছে মোনালিসার গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মাধ্যমে। প্রবাসে অবস্থানরত যেকোন বাংলাদেশীকেই এ দৃশ্য ছুঁয়ে যাবে। খুব ছোট্ট কিন্তু অনেক তাৎপর্যপূর্ণ একটা সংলাপ আছে এই বিদায়ের সময়ে। মোনালিসা যখন বিদায় নিচ্ছিল তখন তার আত্মীয়দের বলছে এক অনিশ্চয়তার কথা: ‘যদি আর দেখা না হয় আমাদের?’ প্রবাসে যাবার সময় এই অনিশ্চয়তা সবার মধ্যেই কাজ করে। এছাড়া মোনালিসা যাচ্ছে শান্তিরক্ষা মিশনের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। যেকোন বিপদ ঘটতেই পারে। সামান্য কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ একটা বাক্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের বাংলাদেশী মানসের একটা প্রতিফলন পাওয়া যায়।
প্লেনে উঠার আগে বিভিন্ন সদস্য বারবার ভিডিও কলে পরিবারের সাথে ক্রন্দনরত নয়নে আলাপ সেরে নেওয়া, শাহানা যখন তার বোনের পারিবারিক জীবনের এক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে হাইতি যাবার আগে, এসব কিছুই স্পষ্ট করে তোলে আমরা আমাদের পেশার বাইরে অন্য অনেক কিছু। দিনশেষে আমরা পরিবারের, যেখানে নিজের স্বাভাবিকতা, নিজের আরাম, নিজের স্বস্তি খুঁজে পাই।
হাইতি যাবার পরে দেখতে পাই তাদের মধ্যেকার নানা খুনসুটি, ফ্রেঞ্চ-ইংরেজী ভাষা নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা, কলেরার ঔষধ নিয়ে এক অফিসার ও অধস্তন মেডিক্যাল স্টাফের মধ্যেকার অমায়িক যত্নআত্তি। শুধু তাই না, একটা শৃঙ্খলা বাহিনীতে চেইন অব কমান্ডের যে একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব থাকে তাও পরিচালক সূক্ষ্মভাবে দেখান। আমরা দেখতে পাই রোদের অজুহাতে এক সদস্য ডিউটি জ্যাকেট পরছেনা। তখন ঊর্ধ্বতনরা অধস্তনদের গাফিলতি নিয়ে সমালোচনা করছে।
এত সব কিছুর মাঝে ঠান্ডা স্রোতের মত বয়ে যায় দেশকে আকুলভাবে অনুভব করার মুহুর্তগুলো। শাহানা যখন বলে ‘বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে কোন দেশের তুলনা হয়?’ হাইতির আম মিষ্টি, এ কথা একজন বলার পর শাহানা বলে উঠে ‘আমাদের দেশের যেকোন একটা আম খাইয়ে দেখ ওদের, আর কখনো নিজেদের আম খাবেনা।’
১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের জীবনে ভিডিওকলে যখন সন্তান মিঁয়াও করে মাকে একটা চুমু পাঠাল সেসময় দর্শকের মন কেঁদে উঠে কোন রকমের আরোপিত সংগীত ছাড়াও। মোনালিসা তার ছেলের ভিডিও দেখে ছেলে বাবার কাঁধে উঠে উদোম গায়ে গ্রামের বাড়ির উঠোনে বৃষ্টিতে ভিজছে। পুরো ডকুফিকশনে এসব দৃশ্যে মন আটকে আছে এখনো। যে ভারী বৃষ্টির আওয়াজ প্রবাসে প্রবলভাবে অনুভব করে, সেই বৃষ্টির আওয়াজ যেন বাঁচিয়ে রাখে মোনালিসাকে।
আমাদের পোশাকি ও পেশাজীবনের নানা চড়াই উৎরাইয়ের মাঝে আমাদের পরিবার, আড্ডা, বন্ধু, খাবার, ঘ্রাণ, বৃষ্টি ইত্যাদি যেসব ছোট ছোট জিনিস বাঁচিয়ে রাখে সেই বেঁচে থাকার চিত্রায়ন দেখতে পাই। আমি সবসময় মনে করি, কামার আহমাদ সাইমনের কাজ আমার মনে দাগ কাটে অভিনব গল্পের জন্য। ‘নীল মুকুটে’র কথাই ধরি। প্রথমেই বুঝতে পারি এটা একটা শান্তিরক্ষী বাহিনীর মিশনের গল্প। মনের মধ্যে অভ্যাসবশত চলে আসে, অন্য সব হলিউড, বলিউড এর বিভিন্ন স্পাই মিশনের মত এখানে হয়তো অনেক একশন দৃশ্য, কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকিয়ে দেয়ার শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য ইত্যাদিই দেখতে পাব। কিন্তু না, দেখতে পেলাম উল্টো ব্যাপার, তাদের দৈনিক ক্লান্তিকর জীবনের বাইরে যে নিদারুণ, একঘেঁয়ে মূহূর্তে তারা নিজেদের সঞ্জীবনী শক্তি লাভ করেন সেই দৈনন্দিন পৌনঃপুনিকতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুন্দর করুণ মুহুর্ত দেখতে পাই।
গত ৯ আগস্ট শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক ও আমার শিক্ষক শাহাদুজ্জামানের লেখা পড়ছিলাম ‘নীল মুকুট’ নিয়ে। তিনি ‘নীল মুকুট’ এর উপর অসাধারণ একটা পর্যালোচনা করেছেন। তিনি এই ডকুফিকশনের দুর্বলতার কথা বলতে গিয়ে মূলত দুটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, তিনি বলছেন যে মিশনে যাবার আগে যে উদ্বেগ ও চ্যালেঞ্জের বয়ান পরিচালক হাজির করেছেন তা যেন অনেকটাই নিরুদ্বেগ হয়ে আসে হাইতি মিশনকালে। আমার কাছে মনে হল, পরিচালক হয়তো এখানে দৈনন্দিন জীবনের কথাই বলতে চেয়েছেন যা একটু আগেই উল্লেখ করলাম। আরেকটা হতে পারে, এ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ একটা মিশনে অনেক গোপনীয় বিষয় থাকে । তাতে একজন ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার কতটুকু অনুপ্রবেশের অধিকার পান সেটাও একটা প্রশ্ন। আমি ভুলও হতে পারি, তবে এটা এড়িয়ে যাবার মত বিষয় না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা শাহাদুজ্জামান বলেছেন যে , ঊর্ধতন কর্মকর্তা শাহানার গল্প যতটা দেখি, অধঃস্তন মোনালিসার কর্মকাণ্ড ততো দেখা যায় না। অর্থাৎ, শ্রেণিমাত্রার ব্যাপারে একটা ফাঁক রয়েই যায় বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি একমত, যদিও এই ডকুফিকশন বহুধা পরিচয়ের সীমানা ভেঙে একটা মানবিক গল্প হাজির করেছে দর্শকের সামনে। শাহানা, মোনালিসা কিংবা শাহজাদী কখনো পুলিশ কর্মকর্তা, কখনো ভিডিওকল শেষে ক্রন্দনরত মমতাময়ী মা, কখনো স্ত্রী, কখনো বাবা মায়ের আদরের মেয়ে, কখনো ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ অমান্য করা অধঃস্তন, কখনো অধঃস্তনদের উপর শাসাতে থাকা ঊর্ধতন কড়া কর্মকর্তা, কখনো অন্য দেশের পুরুষ শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যথার্থভাবে কাজ করা চৌকস কর্মকর্তা, কখনো হাইতির কাপড়ের দোকানে গুলিস্তানি কায়দায় দরদাম করে জ্যাকেট কেনা এক চপলা বাংলাদেশী নারী, এবং মনে প্রাণে বাংলাদেশের ঘ্রাণ ও সবুজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা এক একজন সজীব প্রাণ। এতসব পরিচয়ের ভীড়ে শ্রেণিচেতনা হারিয়ে গেলেও এর মানবিকতার আবেদনের কোথাও ঘাটতি দেখিনা।
‘নীল মুকুটে’র আরো একটা দারুণ দিক হল: এর শব্দ সম্পাদনা। এই পর্যবেক্ষণের জন্য আমার বন্ধু কামরুল হাসানকে ধন্যবাদ দিতে চাই। সে ‘নীল মুকুট’ দেখার পরেই আমাকে বলেছিল যে এর শব্দের কাজ এক কথায় অসাধারণ হয়েছে। সে এভাবে বলাতে আমার নজর সবসময় শব্দের দিকেই ছিল। শব্দের ব্যবহারে বাস্তবতার আঁচ পাওয়া যায় যা মাঝে মধ্যে দর্শক আলাদাভাবে ভুলেই যেতে পারে যে এখানে পরিচালক শব্দের উপর আলাদা কিছু কাজ করেছেন। অর্থাৎ, তা এতই নিখুঁত ছিলো যে বাস্তবতাই প্রতিফলিত করে।
কামার আহমাদ সাইমন ও সারা আফরিন জুটি এর আগেও ‘শুনতে কি পাও’ দিয়ে আমাদের আলোড়িত করেছেন। এবার মুগ্ধ হলাম ‘নীল মুকুট’ দেখে। সত্যি কথা বলতে, যে কোন শিল্প মাধ্যমে মূল যে ব্যাপারটা, তা হল: বিষয় যাই হোক, তা যেন সকলকে ছুঁয়ে যেতে পারে, এই ব্যাপারটাই বেশি অনুভূত হয়েছে ‘নীল মুকুট’ দেখার পর। মনে হয়েছে এটা যে কেউ দেখতে বসলেই অনুভব করবে শাহানা কিংবা মোনালিসার জীবনের স্পন্দন-নাজুকতা-দুঃখ-কষ্ট-দৃঢ়তা।
সামনের দিনে আরো অনেক না বলা সিংহ সিংহীর গল্প দেখার প্রত্যাশা রইল কামার আহমাদ সাইমন ও সারা আফরিন জুটির কাছে। তথকথিত রাস্তায় তো সবাই গল্প বলেন, যে অল্প কয়েকজন ভিন্ন পথ বেছে নেন তাদের জন্য ধন্যবাদের পাশাপাশি আরেকটু বাড়তি ভালোবাসা প্রাপ্যই বটে।
ঋণ স্বীকার
১. অভিনব বিষয়বস্তু নিয়ে কামারের ‘নীল মুকুট’, শাহাদুজ্জামান, ৯ আগস্ট, ২০২১ (প্রথম আলো)