রাফি যখন ছোট, মা সুমনা ভাবতো ওর মতো দুরন্ত শিশু বোধহয় যেন আর হয় না। এটা ভাঙছে, ওটা ধরছে, দাদুর সঙ্গে কুস্তি করছে- ওকে সামলাতে সামলাতেই সুমনার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। এখন রাফির বয়স ৯ বছর। বেশ বড় হয়ে গেছে। সুমনা ভেবেছিল বড় হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে ছেলে। কিন্তু যেই সেই ঘটনা, এখন বদলে গেছে তার দুরন্তপনার ধরন। এখন আর ওর ক্ষেত্রে দুষ্টু কথাটা খাটে না। এককথায় ওকে বলা যায় আগ্রাসী। সবসময় মারমুখী হয়ে আছে। বাসায় কোনো ছোট ছেলেমেয়ে এলেই তার সঙ্গে শুরু করে মারামারি। এমনকি স্কুল থেকেও নালিশ পেতে পেতে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায় সুমনার। মাঝে মাঝে রাগের মাথায় দু-একটা চড়থাপ্পড় মারতে গেলেও ছেলে এমনভাবে তেড়ে আসে, যা দেখে ভয়ে বুক শুকিয়ে যায় তার। এদিকে ছেলের মন নেই পড়াশোনাতেও। মাঝে মাঝে সুমনা ভাবে সন্তানের এমন আগ্রাসী ব্যবহারের জন্য কোনও ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করবে। কিন্তু নিজের ছেলেকে অসুস্থ ভাবতেও মন সায় দেয় না তার।
আধুনিক জীবনযাত্রার প্রভাব যখন প্রকট হয়ে ওঠে, শিশুদের কোমল মনে তখনই দেখা দেয় অ্যাগ্রেশন বা মারমুখী আচরণ। সবার চেয়ে সেরা হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে এই শিশুদের জীবনে হতাশা, চাপ, চিন্তা সব কিছুই যেন হয়ে যায় মাত্রাছাড়া। এছাড়া বাবা-মায়ের প্রত্যাশার বোঝা তো রয়েছেই। যা টানতে টানতে ক্লান্ত শিশুদের ব্যবহার হয়ে ওঠে আরও হিংসাত্মক। এই আগ্রাসী মনোভাবের পেছনে যে কারণটা বড় হয়ে দাঁড়ায়, তা হলো অন্যকে ব্যথা বা কষ্ট দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার জানান, শিশুরা তাদের এমন আগ্রাসী ব্যবহার ব্যক্ত করে কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে। যেমন:
১. মারামারি করা (বিশেষত নিজের থেকে ছোট, দুর্বল ছেলেমেয়ে বা পশুপাখিকে মারা)।
২. কোনো কারণ ছাড়াই অন্যদের লাথি মারা বা থুতু ছিটানো।
৩. অকারণেই নিজের বা অন্যের জিনিসপত্র নষ্ট বা ক্ষতি করা।
৪. রেগে গেলে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা ছুঁড়ে মারা।
আপনিও কি সন্তানের নামে স্কুল থেকে অভিযোগ পাচ্ছেন? অন্যদের সঙ্গে কি আপনার সন্তান মারামারি করছে? আপনার সন্তান রেগে গিয়ে কি জিনিসপত্র ভাঙছে? সন্তানের এমন আগ্রাসী মনোভাবের জন্য লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছে হয়? এমন অবস্থায় কীভাবে সন্তানকে সামলে নিবেন তার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মেখলা সরকার।
ডা. মেখলা সরকার জানান, সন্তানের আগ্রাসী মনোভাবের পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। যেমন:
- আত্মবিশ্বাসের অভাব।
- ফ্রাস্ট্রেশন বা স্ট্রেস।
- নিজের সমস্যা ঠিকমতো বোঝাতে না পারা।
- পরিবারের কোনও সদস্য বা চেনা মানুষের আগ্রাসী ব্যবহার নকল করার চেষ্টা।
- আগ্রাসী শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা।
- যৌন নিপীড়ন।
- বাবা-মায়ের ওপর অতিরিক্ত রাগ বা অভিমান।
- সবার থেকে মনোযোগ না পাওয়া।
- টিভি বা কম্পিউটার গেমসের অতিরিক্ত প্রভাব।
সন্তানের আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ পেলে অভিভাবক হিসাবে আপনি যা করবেন এবং যা করবেন না সে বিষয়েও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মেখলা সরকার।
- যদি আপনার সন্তানের মধ্যে এমন আগ্রাসী মনোভাব নজরে আসে, তাহলে খুঁটিয়ে দেখুন এই ব্যবহার কি তার সাধারণ ব্যবহার, না কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে সন্তান আগ্রাসী হয়ে উঠছে।
- এমন ব্যবহার যদি দেখেন ওর ব্যক্তিত্বের অঙ্গ হয়ে উঠেছে, সেক্ষেত্রে ওর ভেতর জমে থাকা এনার্জি খরচ করার একটা ইতিবাচক উপায় খুঁজুন। ফুটবল, টেনিস, ক্রিকেট বা বাস্কেটবলের মতো খেলায় উৎসাহ দিন।
- যদি দেখেন কোনও বিশেষ মুহূর্তে আপনার সন্তান আগ্রাসী হয়ে উঠছে, তাহলে এর পেছনে কী কারণ আছে তা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। অনেকসময় বাসার কাছের মানুষরা বা শিশুর বন্ধুরা মজা করার জন্য কোনও বিশেষ নাম ধরে ডেকে শিশুকে ক্ষেপিয়ে তোলে। এমন সামান্য কোনও ঘটনায় শিশুর আগ্রাসী হয়ে ওঠার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন ব্যবহারে আপনার সন্তান কোণঠাসা বা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তাই এমন ব্যবহার যেন কেউ ওর সঙ্গে না করে তা খেয়াল রাখুন।
- অনেক সময় শিশুরা না বুঝেই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। কিন্তু যদি দেখেন শিশু কোনও আগ্রাসী ব্যবহার করছে, তাহলে তার প্রতিবাদ করুন। ওই শিশুকে সেখান থেকে সরিয়ে দিন। মারধর বা বকাঝকা করবেন না। কিন্তু আপনার আচরণে ওকে বুঝিয়ে দিন এই ব্যবহার আপনি একেবারেই সমর্থন করছেন না।
- বাসার বড়রা যদি কথায় কথায় চিৎকার করেন বা জিনিসপত্র ভাঙেন, সেই প্রভাব শিশুদের ওপর পড়বেই। এক্ষেত্রে নিজেদের সংযত রাখুন।
- আপনার সন্তান খুব রেগে গেলে তাকে পছন্দের কিছু করতে দিন। যাতে ও মজা পায় এবং রাগ সামলে নেয়।
- সন্তানের মুখে যদি কোনও খারাপ ভাষার প্রয়োগ শোনেন তাহলে বুঝিয়ে বলুন, এ ধরনের কথা বলা উচিত নয়।
- ছোট থেকেই শিশুকে সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন। নাচ-গান, ছবি আঁকা, অভিনয় করা ওর মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করবে।
- কোনোভাবেই যদি দেখেন সন্তানের ব্যবহারে পরিবর্তন আনতে পারছেন না, তাহলে সাহায্য নিন কোনও অভিজ্ঞ কাউন্সিলরের।