মেয়েদের বড় করে তোলার সময় বাবা-মায়েরা একটা কথা খুব বেশি ব্যবহার করেন, তা হচ্ছে ‘মানিয়ে নেওয়া’। আপনি হয়তো বলবেন এতে খারাপ তো কিছু নেই। সবার সঙ্গে মানিয়ে না চললে ভালো থাকা যায় না, সংসারে শান্তিও বজায় থাকে না। তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এই মানিয়ে চলা শেখাতে গিয়ে আপনি আপনার মেয়েকে আরও একটি বার্তা দিয়ে দিচ্ছেন যে, ভবিষ্যতে সংসারে সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার দায়িত্বটা তার ওপরই বর্তাবে। কিন্তু ছেলেদের মানুষ করার ক্ষেত্রে এমন ‘মানিয়ে চলা’ শিক্ষার প্রশ্ন আসে না। কারণ ছেলেদের ক্ষেত্রে ভালো ক্যারিয়ারই প্রথম লক্ষ্য। বিয়ে, সংসার তাদের তালিকায় অনেক পরের দিকে থাকে।
আজকাল কিন্তু মেয়েদের জীবনচর্যায়ও পরিবর্তনের পাল তুলেছে। গত বেশ কয়েক বছরের বিভিন্ন পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন মেয়েরা পড়াশুনায় ছেলেদের থেকে বেশ এগিয়ে গিয়েছে। এখন মেয়েরা নিজেদের ক্যারিয়ার শক্তভাবে গড়ে তুলতে চায়। শুধু বিয়ে, সংসারকেই একমাত্র ভবিষ্যৎ ভাবতে তাদের এখন ঘোর আপত্তি। পড়াশোনা, বুদ্ধি, সাহস, লক্ষ্য কোথাও নেই কোনো খামতি। তাই ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে যে আত্মবিশ্বাস, বিচক্ষণতা দেখা যায় তার প্রভাব জীবনের অন্যান্য সিদ্ধান্তের বেলায়ও পড়ে। অনেক মেয়েই বাবা-মাকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিচ্ছেন বিয়ে নিয়ে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা। বাবা-মা একটু বিব্রত হলেও, মেয়েদের কথার গুরুত্বও তারা দিচ্ছেন। মেয়েরা এখন জীবনটাকে নিজের মতো করে দেখতে চাইছে। কিন্তু তারপরও একটা বিশ্বাস সমাজে গেঁথে আছে যে, মেয়েদের বিয়ে হওয়া খুব জরুরি। স্বামী না থাকলে একটা মেয়ে অসম্পূর্ণ। বিয়ে না করাও যে একটা সিদ্ধান্ত হতে পারে, তা হজম করতে গেলে এখনও সমাজ বিষম খায়। কিন্তু শত বাধার পরও ইচ্ছেরা মাথা চাড়া দেয়। এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হকের সঙ্গে। তিনি জানান এর আদ্যপ্রান্ত। এ সময়ের মেয়েদের এই ইচ্ছেকে সম্মান জানাতেই চলুন দেখে নিই কীভাবে বিয়ে না করেও ভালো থাকা যায়।
স্বনির্ভরতা
নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হলে প্রথমেই যা দরকার তা হলো স্বনির্ভরতা। আপনি যদি বাইরের জগতে নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাহলেই আপনার সিদ্ধান্তে যথেষ্ট ওজন থাকবে। তাছাড়া চাকরি বা ব্যবসায় নিজের সাফল্য আপনাকে দেবে বাড়তি আত্মবিশ্বাস। আপনি অনেকটাই জোর দিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন। আপনার আশেপাশের মানুষও তখন আপনার কথায় প্রভাবিত হবে। তাই নিজের জীবনের চাবিকাঠি হাতের মুঠোয় রাখার জন্য প্রথম শর্ত অবশ্যই স্বনির্ভরতা।
সহায়তা বলয়
আপনি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আপনি জীবন থেকেও নির্বাসিত। সমমনা মানুষদের সঙ্গে নিজের একটা বলয় গড়ে তুলুন। যারা আপনার বিয়ে না করা নিয়ে মাথা ঘামান না কিংবা অযথা কৌতূহল দেখান না, তেমন মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখুন। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করুন। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যান। তাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করুন। বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটান। তবে বিয়ে না করা বা একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু প্রশ্নের মুখমুখি আপনাকে প্রায়ই হতে হবে। তার জন্য প্রস্তুতি রাখুন। যারা এমন প্রশ্ন করবে তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিন আপনার ভালো থাকার কথা।
আগাম পরিকল্পনা
একা থাকার জন্য শুধু সাহস থাকলেই চলবে না, আরও প্রয়োজন পরিকল্পনা করে চলার মানসিকতা। আপনার বিপদে আপদে তাৎক্ষণিক সাহায্য পেতে অসুবিধা হতে পারে। তাই যেকোনো বিপদ মোকাবিলা করার জন্য একটা পরিকল্পনা করে রাখুন। অফিস বা ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া এবং তা ফেরত দেওয়ার প্ল্যান আগে থেকেই করে রাখুন। এছাড়া চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর একটা বড় অঙ্কের টাকা যেন আপনার হাতে থাকে। হাতের কাছে কিছু হাসপাতাল, ডাক্তারদের তালিকা এবং ফোন নম্বর রাখুন। বন্ধুদের সঙ্গে নিজের শরীরের অবস্থা শেয়ার করুন।
ইতিবাচক শখ
আপনি নিজেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারপরও আপনার বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের সঙ্গে আপনার মনে কখনো কখনো একটা তুলনা আসতেই পারে। এছাড়া আপনার বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই হয়তো বিবাহিত। তারা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকবেন। আপনার প্রয়োজনে সবসময় তাদের নাও পেতে পারেন। তখন একটা শূন্যতা আপনাকে গ্রাস করতে পারে। তাই বন্ধুবান্ধবের বাইরেও নিজের একটা জগৎ তৈরি করুন। নিজের কোনো শখ নিয়ে এই জগৎ তৈরি করতে পারেন। লেখালিখি, গানবাজনা এসবের জন্য সময় বের করুন। এইসব নিয়ে যেসব সংস্থা আছে, সেগুলোতে যোগ দিন। দেখবেন, দারুণ সময় কাটছে। আর যদি তেমন কোনো শখের কাজ না থাকে তাহলে যোগ দিতে পারেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়। কিছুটা সময় কাটাতে পারেন বিভিন্ন অনাথ আশ্রম বা বৃদ্ধাশ্রমে। এসব কাজ আপনাকে মানসিক তৃপ্তি দেবে। এছাড়া ভবিষ্যৎ সুখে-দুঃখে আপনার চারপাশের এসব মানুষ আপনাকে পারিবারিক সহায়তা দেবে।
মনে রাখবেন, জীবন একটাই। নিজের ব্যক্তিগত জীবন কীভাবে কাটাবেন সে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। আপনি বিয়ে না করে একা থাকার যে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, সেটা অবশ্যই আপনার বিশেষত্ব। আর বিয়ে না করে আনন্দে থাকতে পারার দৃষ্টিভঙ্গি সেই বিশেষত্বেরই পরিচায়ক।