• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পবিত্র হজ পালনের সঠিক নিয়ম


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২১, ০১:১৯ পিএম
পবিত্র হজ পালনের সঠিক নিয়ম

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হচ্ছে হজ পালন। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মহা মূল্যবান ইবাদাত এটি। এই ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হলে  জীবনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। হজ পালনে মুসলিমদের শারিরীক পরিশ্রম, মানসিক পরিশ্রম, প্রচুর টাকা ব্যয়, প্রচুর ধৈয্যের পরীক্ষা দিতে হয়। পবিত্র স্থান মক্কায় ‍গিয়ে হজের ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নতের সমন্নয়ে সঠিক নিয়মে এই ইবাদত করতে হয়।

হজ শব্দটির অর্থ নিয়ত করা, সংকল্প করা, গমন করা, ইচ্ছে করা, প্রতিজ্ঞা করা। অর্থাৎ নিদিষ্ট  দিনে নিয়তসহ ইহরামরত অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করাই হচ্ছে হজ।

সঠিক নিয়ম-কানুন মেনে হজ পালন জরুরি। এরজন্য় হজের ফরজ, ওয়াজিব এরং সুন্নত সর্ম্পকে জানতে হয়। হজ ৩ প্রকার- হজ্বে ইফরাদ, হজ্বে কি্বরান, হজ্বে তামাত্তু। 

হজ্বে ইফরাদ

ওমরাহ্ ব্যতিত শুধু হজের জন্য ইহরাম বাঁধা এবং হজের সঙ্গে ওমরাহকে না মিলানো। (বদলী হজ্জের জন্যও এই হজ্জ)। এ প্রকার হজ পালনকারীকে শরিয়তের পরিভাষায় মুফরিদ বলে।
নিয়ত: 'আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াসছির হুলিওয়াতা কাব্বালহুমিনি্ন'। (বাংলা নিয়ত- আল্লাহ আমি ইফরাদ হজের উদ্দেশ্যে আপনার সন্তুষ্টির জন্য ইহরাম বাধলাম। তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন)।

হজ্বে কি্বরান

একই সঙ্গে একই স্থান থেকে হজ ও ওমরার নিয়ত করে উভয়টি পালন করা হয় এবং একই ইহরামে উভয়টি আদায় করা হয় তাহলে এই ধরনের হজকে শরিয়তের ভাষায় হজ্বে কি্বরান বলা হয়। এ প্রকার হজ পালনকারীকে কারিন বলে।
নিয়ত: 'আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল উ’মরাতা ফায়াচ্ছির লী-ওয়াতাক্াব্বাল মিন্নী'। বাংলা নিয়ত- (হে আল্লাহ আমি আপনার উদ্দেশ্যে হজে কি্বরানের জন্য ইহরাম বাঁধলাম তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন)।

হজ্বে তামাত্তু

হজের সঙ্গে ওমরাহকে এভাবে মেলানো যে, মিকাত’ থেকে শুধু ওমরাহর ইহরাম বাঁধা। এই ইহরামে মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ পালন করা। এরপর ইহরাম ভেঙে চুল কেটে হালাল হয়ে দ্বিতীয়বার নতুন করে হজের নিয়তে ৮ জিলহজ ‘মক্ক শরীফ’ থেকে হজের জন্য ইহরাম বাঁধা। শরিয়তের পরিভাষায় এই হজকে তামাত্তু বলে। এ প্রকারের হজ পালনকারীকে মুতামাত্তি বলা হয়। তামাত্তু করার ইচ্ছা থাকলে প্রথমে ওমরার নিয়ত করে এহরাম বাঁধুন।

হজের ফরজ ৩টি- 

  • ইহরাম বাধা
  • উ’কুফে আ’রাফা (আরাফাতের ময়দানে অবস্থান)
  • তাওয়াফুয্ যিয়ারাত করা।

হজের ওয়াজিব ৬টি- 

  • ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দ্বয়ের মাঝে ৭ বার সায়ী করা।
  • অকুফে মুযদালিফায় (৯ জিলহজ) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সুর্যদয় পর্যন্ত এক মূহুর্তের জন্য হলেও অবস্থান করা।
  • মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিক্ষেপ করা।
  • ‘হজে তামাত্তু’ ও ‘কি্বরান’ কারীরা ‘হজ’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা।
  • এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল ফেলে দেওয়া বা ছাটা
  • মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালীন তাওয়াফ করা।

হজের সুন্নত ৬টি- 

  • ইহরাম বাঁধার পূর্বে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হওয়া।
  • জিলহজের ৮ তারিখে মিনায় অবস্থান করা।
  • বেশী বেশী তালাবিয়া পাঠ করা।
  • জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফায় রওনা হওয়া । এই দিন জোহরের নামাজের পূর্বে গোসল করা।
  • ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের সামান্য পূর্বে মুজদালিফা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া।
  • ১০ ,১১, ১২ জিলহজ রাতে মিনায় অবস্থান করা।

হজের নিয়ত

আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াচ্ছিরহু-লী অ-তাকাব্বালহু মিন্নী। বাংলা নিয়ত- 'হে আল্লাহ আমি পবিত্র হজ পালনের জন্য ইহরাম বেঁধে নিয়ত করলাম, তা সহজ করে দিন এবং কবুল করে নিন।'

ইহরাম

পবিত্র মক্কা শরীফ পৌছানোর আগে ইহরাম বাঁধতে হবে। সরাসরি মক্কায় গেলে বিমানে ওঠার আগেই ইহরাম বেঁধে নিন। কারণ জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ‘ইয়ালামলাম’ মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থানটি পড়বে। ইহরামের কাপড় পরিধানের পর নিয়ত করে নিতে হবে। 'তালবিয়া’ পড়ে নিতে হবে। ইহরামের কাপড় পড়ে বিমানে উঠুন। এরপর বিমান ছাড়ার পর নিয়ত করে তালবিয়া পড়ে নিন।

মিকাত

হজ বা উমরাহ পালনকারী ব্যক্তির জন্য বিনা ইহরামে যে নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করা নিষিদ্ধ, তাই হলো মিকাত। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের সম্মানার্থে প্রত্যেককে নিজ নিজ মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। মনে রাখবেন, ইহরাম না বেঁধে মিকাত পার হলে এর জন্য দম বা কাফফারা দিতে হয়। অন্যথায় গুনাহ হবে।  মিকাত ৫টি-

  • যুল হুলায়ফা বা বীরে আলী: মদীনাবাসী এবং মদীনা হয়ে মক্কায় প্রবেশকারীদের মিকাত।
  • ইয়ালামলাম: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ থেকে  জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশকারীদের মিকাত।
  • আল-জুহফা: সিরিয়া, মিসর এবং সেদিক থেকে আগতদের মিকাত।
  • কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবির: নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত এবং
  • যাতুল ইর্ক: ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত।

আরও পড়ুনসাহরি ও ইফতারের সময়সূচি ২০২২

তালবিয়া

”লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক, লাব্বাঈক, লা-শারীকা-লাকা লাব্বাঈক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারীকালাক।”
অর্থ-' আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোন অংশীদার নেই।'

ইহরাম অবস্থায় যা করবেন না-

  • সেলাইযুক্ত কোন কাপড় বা জুতা ব্যবহার করা যাবে না। এক্ষেত্রে স্পঞ্জ সেন্ডেল ব্যবহার করতে হবে।
  • মস্তক ও মুখমন্ডল ঢেকে রাখা যাবে না (ইহরামের কাপড়সহ যে কোন কাপড় দ্বারা)।
  • পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা যাবে না।
  • চুলকাটা  বা ছিড়ে ফেলা যাবে না।
  • নখকাটা যাবে না।
  • ঘ্রানযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো যাবে না।
  • স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা যাবে না।
  • যৌন উত্তেজনামূলক কোন আচরণ বা কোন কথা বলা যাবে না।
  • শিকার করা যাবে না।
  • ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা যাবে না।
  • চুল দাড়িতে চিরুনী বা আঙ্গুলী চালনা করা যাবে না। যাতে ছিড়ার আশংকা থাকে।
  • শরীরে সাবান লাগানো যাবে না।
  • উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোন জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা যাবে না।
  • কোন ধরনের গুনাহের কাজ করা যাবে না।

 

হজের প্রথম দিন- ৮ই জিলহজ

ইহরাম অবস্থায় (ফরয) মক্কা থেকে হজ্জের নিয়তে মিনায় রওনা হোন। এ দিন কাজ দু’টি কাজ করতে হবে- ইহরাম (ফরজ), ৫ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা (সুন্নাত)- যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ৯ তারিখ ফজর।

হজের দ্বিতীয় দিন- ৯ই জিলহজ

আরাফাতে অবস্থান (ফরজ) করতে হবে এবং অকুফে মুযদালিফায় (ওয়াজিব)। ফজরের নামাজ মিনায় পড়ে আরাফাতের ময়দানের দিকে রওনা হতে হবে। আরাফাতে সূর্য হেলার পর অর্থাৎ ১২টার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা হজের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। ওয়াক্ত মতো তাবুতে (মসজিদে নামেরায় না গেলে) বা আরাফার ময়দানে যেকোন স্থানে জোহরের নামাজ আদায় করুন। আসরের নামাজ আসরের সময় আদায় করুন, নির্দিষ্ট সময় বা আগে পরে, পৃথক পৃথক ভাবে। ‘মসজিদে নামেরায়’ জোহর ও আসরের জামাত এক আযান দুই ইকামাতে একত্রে আদায় করলে একত্রে দুই ওয়াক্ত আদায় করতে হয়, ওটার নাম ‘জমে তাক্বদীম’। কিন্তু তাবুতে বা অন্য কোন স্থানে একত্রে নয়। ভিন্ন সময় ভিন্ন ভাবে ওয়াক্ত মতো আদায় করতে হবে।)

অকুফে মুযদালিফায় (ওয়াজিব) মানে সূর্যাস্তের পর সাথে সাথে মাগরিব না পড়ে মুযদালিফায় রওনা হোন। মুযদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ  এক আযান দুই এক্বামাতে একত্রে আদায় করুন। এটা ওয়াজিব এটার নাম ‘জামে তাখীর জামাতে পড়া উত্তম। মুযদালিফায় অবস্থান (ওয়াজিব) মুযদালিফায় থাকার সময় পাহাড়ে অথবা তার পাদদেশে যেকোন ঘাস দুবলা থেকে খুঁজে খুঁজে পাথর মারার জন্য ৭২টি (চানাবুটের ন্যায় কঙ্কর) ছোট ছোট পাথর সংগ্রহ করে ইহরামের কাপড়ে বেঁধে নিন।

১০/১১/১২ তিন দিনে (৪৯টি পাথর) তিন শয়তানকে মারতে হবে। ১ম দিন ৭টি, ২য় দিন ২১টি, ৩য় দিন ২১টি (সর্বমোট ৪৯টি )। তবে বেশি পাথর সংগ্রহ করা সুন্নত। 

হজের তৃতীয় দিন-১০ই জিলহজ

এই দিন ৪টি কাজ করতে হয়- বড় শয়তানকে পাথর মারা, কোরবানি, মাথার চুল ফেলে দেওয়া, তাওয়াফে যিয়ারত করা। মুযদালিফায় ফজরের  নামাজ পড়ে সূর্য উদয়ের আগ পর্যন্ত অবস্থান করুন (ওয়াজিব)। মিনায় পৌছে বড় শয়তানকে ৭টি পাথর সূর্য হেলে পড়ার আগেই (১২টার পূর্বেই) মারুন। (সুন্নাত)। তারপর তামাত্তু ও কি্বরান হজকারীরা কুরবানী করুন (ওয়াজিব)। এরপর ইহরাম খুলে হালাল হয়ে স্বাভাবিক পোষাক পরিধান করুন। কিন্তু কোরবানির আগে নয়। (তবে ইফরাদ হজ্জকারী কুরবানী না করলেও চলবে)। চুল ফেলে দেওয়ার পর মক্কায় গিয়ে (সম্ভব হলে উত্তম) এই দিনই তাওয়াফে যিয়ারত করুন। এই দিনই করা সর্বোত্তম। এটা ফরজ। তাওয়াফ শেষে মিনায় এসে রাত্রি যাপন করুন (সুন্নাত)।

চতুর্থ দিন- ১১ই জিলহজ

১০ তারিখে কোরবানি, চুল ছাটা ও তাওয়াফে যিয়ারত না করে থাকলে এই দিন করুন। সূর্য হেলার পর থেকে (১২টার পর) মিনায় তিন শয়তানকে সূর্যাস্তের পূর্বে (প্রথম ছোট, তারপর মেজ অতঃপর বড়) ৭+৭+৭=২১টি পাথর মারুন (ওয়াজিব)। মিনায় রাত্রি যাপন করুন (সুন্নাত)।

পঞ্চম দিন- ১২ই জিলহজ

তাওয়াফে যিয়ারত ১০/১১ তারিখে না করে থাকলে এই দিন সূর্যাস্তের আগে অবশ্যই করুন। মিনায় সূর্য হেলার পর থেকে (সুন্নাত সময় হলো) সূর্যাস্তের আগে ৭+৭+৭=২১টি পাথর (ছোট, মেজ ও বড় ) শয়তানকে মেরে সূর্যাস্তের আগেই মক্কায় রওনা হওয়ার চেষ্টা করুন।

যা খেয়াল রাখতে হবে_

  • ১১/১২ তারিখ সূর্য হেলার পূর্বে পাথর মারলে আদায় হবে না। পূণরায় মারতে হবে। নতুবা দম বা কাফফারা দিতে হবে।
  • ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগে মীনা ত্যাগ করে মক্কায় রওয়ানা হতে হবে। তা না হলে ১৩ তারিখ পূনরায় তিন শয়তানকে ৭+৭+৭=২১টি পাথর (ছোট, মেজ ও বড় ) মেরে (পূর্বের নিয়মে) এরপর মক্কায় আসতে হবে।
  • তাওয়াফে যিয়ারতের উত্তম সময় ১০ই জিলহজ্জ থেকে ৩ দিন। শেষ সময়  ১২ই জিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
  • মক্কা থেকে মিনায় রওয়ানার পূর্বে যদি নফল তাওয়াফ করে হজের নিয়ত সায়ী না করে থাকেন (বা মিনায় আসেন) তাহলে হজের পরে তাওয়াফে যিয়ারতের পর অবশ্যই হজের সায়ী করুন (ওয়াজিব)।
Link copied!