বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশে প্রতি বছরই বিভিন্ন জেলায় বন্যা হয়। অনেক মানুষ তাদের জীবিকা হারায়। বন্যার্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ত্রানের ব্যবস্থা করা হয়। যা দুর্ভোগে থাকা মানুষদের বেঁচে থাকতে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে সাহায্য করে। বন্যা, ঘুর্ণিঝড় কিংবা ভূমিকম্পে আক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে দুর্ভোগে থাকা মানুষগুলোর জন্য ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সরকারিভাবে ত্রানের ব্যবস্থা করা হয়। ত্রাণ দেওয়া একটি মহৎ কাজ। এটি মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু অনেক সময় এটি শুধুমাত্র প্রদর্শন ও আত্মপ্রচারের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। ত্রাণ দেওয়ার সময় ছবি তোলার মাধ্যমে ব্যক্তিপর্যায়ের প্রচারণা শুরু হয়। যারা ত্রাণ দান করেন, তারা মূলত নিজেদের উদারতা এবং দাতব্য কাজকে প্রচারের মাধ্যমে তুলে ধরতে চান। কিন্তু ত্রাণ দিতে গিয়ে ছবি তোলা কি উচিত? বিশেষজ্ঞরা জানান, ত্রাণ বিতরণের সময় ছবি তোলা এবং তা প্রচার করা অনুচিত। আর এটা কেন অনুচিত জানেন? এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন সামাজিক, মানসিক, এবং নৈতিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
প্রথমত, ত্রাণ বিতরণের সময় ছবি তোলার মাধ্যমে বন্যার্তদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়। বন্যার্তরা ইতোমধ্যে একটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। তারা ত্রাণের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ সময় তাদের ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করলে তারা লজ্জিত বা অপমানিত হতে পারেন। তাদের দুর্বল ও অসহায়ভাবে উপস্থাপন করা মোটেই উচিত নয়। এই ধরনের ছবি তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। সমাজে তাদের অবস্থানকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে।
দ্বিতীয়ত, ত্রাণ কার্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা, তাদের দুঃখ লাঘব করা এবং পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু যদি ত্রাণ কার্যক্রমকে কেবলমাত্র আত্মপ্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে এটি ত্রাণের মৌলিক উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। ছবি তোলার মাধ্যমে ত্রান দাতার মনোযোগ নিজেই প্রচারিত হওয়ার দিকে সরে যায়। যা প্রকৃত অর্থে ত্রাণ কার্যক্রমের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং নিষ্ঠাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তৃতীয়ত, ত্রাণ বিতরণের সময় সহানুভূতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন ব্যক্তি যখন ছবি তোলেন, তখন সেই সহানুভূতি এবং আন্তরিকতার জায়গা থেকে সরে যেতে পারেন। ত্রাণ দেওয়ার সময় বন্যার্তদের প্রয়োজন এবং কষ্ট লাঘবের উপর মনোযোগী হওয়া উচিত। ছবি তোলার ফলে ত্রাণ কার্যক্রমটি একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়। তাতে মানবিক অনুভূতি কমে যায়।
চতুর্থত, ত্রাণ বিতরণের সময় ছবি তোলার মাধ্যমে সমাজে একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে। অনেকের ধারণা হতে পারে, ত্রাণদান কেবলমাত্র প্রদর্শনের জন্যই। যার কারণে ত্রাণদানের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। এতে সমাজে সত্যিকারের মানবসেবা কমে যেতে পারে এবং দাতব্য কাজগুলো শুধুমাত্র প্রচারণার জন্যই হয়ে যাবে।
পঞ্চমত, ত্রাণ বিতরণে ছবি তোলা শুধু যে দাতাদের উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে প্রভাবিত করে তা নয়, বরং এর কার্যকারিতাও হ্রাস পায়। ছবি তোলার সময় ও প্রচারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার ফলে প্রকৃত ত্রাণ কার্যক্রমে মনোযোগ বিভ্রান্ত হতে পারে। এতে সময় এবং সম্পদ উভয়ই অপচয় হয়। যা ত্রাণ কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য অর্জনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
সবশেষে, ছবি তুলে প্রচারণা করলে নৈতিক দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ত্রাণ দান নৈতিক দায়িত্ব। বিপদগ্রস্তের পাশে দাড়ানো সামাজিক দায়িত্বের অংশ। এই সময় নিজেদের প্রচারের দিকে মনোযোগ দিলে তা নৈতিকতার পরিপন্থী হবে। সুতরাং ত্রান দেওয়ার সময় সতর্ক থাকা উচিত, যেন প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধকে ধরে রাখা যায়। মনে রাখতে হবে, মানবিকতা যেখানে প্রাধান্য পায়, সেখানে আত্মপ্রচার বা প্রদর্শনীমূলক কর্মকাণ্ডের কোনো স্থান নেই। কাজেই, ত্রাণ বিতরণের সময় ছবি তোলা থেকে বিরত থাকা উচিত এবং দুর্ভোগে থাকা মানুষের প্রকৃত সাহায্য করার দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত।