• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মব জাস্টিস কেন ঘটছে, এর পরিণতিই বা কী


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪, ০৬:১৪ পিএম
মব জাস্টিস কেন ঘটছে, এর পরিণতিই বা কী
ছবি: সংগৃহীত

অন্যায় করবে, এর বিচার হবে। অপরাধের শাস্তি হবে। যেকোনো দেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পন্থা এটাই। এই কার্যক্রম পরিচালনায় কাজ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপরাধীকে আটক করে আইনগতভাবে বিচার করা হয়। বিচারক সেই বিচার নির্ধারণ করেন। নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন করে অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি দেওয়া হয়। এটাই বিশ্বের সব দেশের বিচারব্যবস্থা।

তবে এর বাইরেও একটি বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। যা অনেকটাই বিতর্কিত এবং সমালোচিত। আর তা হলো ‘মব জাস্টিস’। ‘মব’ অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। ‘জাস্টিস’ অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। ‘‍‍মব জাস্টিস‍’ হলো উত্তাল জনতার দ্বারা পরিচালিত বিচার বা শাস্তি প্রদান করা। ‘মব জাস্টিসে’ উত্তেজিত জনতা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাউকে মারধর, নির্যাতন কিংবা হত্যার মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে থাকে।

বলা যায়, এই বিচারকাজে সাধারণ জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। কোনো অপরাধ বা অপরাধীকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় বিচার না করে, নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সামান্য অপরাধের জন্যও কারো প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই এই প্রক্রিয়া যেকোনো দেশের জন্যই ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধের প্রতি দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় মব জাস্টিসের মতো ঘটনা ঘটে। তবে এতে নিরীহ মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়ে। এটি আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ এতে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কার্যকলাপ ঘটে থাকে। যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হতে পারে।

মব জাস্টিস কেন ঘটে
কয়েকটি পরিস্থিতিতে মব জাস্টিস হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি হঠাৎ উত্তেজনার পরিবেশে ঘটে থাকে। কোনো অপরাধ বা অন্যায় যেমন চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ বা হত্যার অভিযোগের কারণ স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। যা প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আর আক্রোশের বশে ‘মব জাস্টিস’ হতে পারে।

দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অবিশ্বাস বা নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি থেকেও মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্রুত বা কার্যকরভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কিংবা কিছু মানুষ উত্তেজিত জনতাকে আরও উত্তেজিত করে তুলতে পারে। যা থেকে মব জাস্টিসের মতো ঘটনা ঘটে।

অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি উত্তেজিত জনতার সামনে এসে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর না করে নিজেরাই শাস্তি দেয়। মারধর, নির্যাতন করে জনতা মব জাস্টিসের মতো ঘটনা ঘটায়।

আবার অনেক সময় গুজবের কথা শুনেই জনতা উত্তেজিত থাকে। আর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মারধর করে। এক্ষেত্রে জনতা উত্তেজিত থাকে বলে সত্য আর গুজবের মধ্যে পার্থক্য বোঝে না। তাই এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো নিরীহ ব্যক্তিও জনগণের হামলার শিকার হতে পারে।

দেশ বা কোনো স্থানের পরিস্থিতি উত্তাল থাকলে উত্তেজিত জনতা প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সহিংস হয়ে ওঠে। যার কারণে প্রতিপক্ষ কাউকে পেলেই মারধর, শারীরিক নির্যাতন, হত্যার ঘটনা ঘটায়। যা মব জাস্টিসের অন্যতম কারণ হতে পারে।

সামাজিক অসাম্যের কারণেও নিম্নবর্গের মানুষরা আইনের সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হয়। ফলে নিজেরাই আইন নিজের হাতে তুলে নেয় এবং অপরাধ প্রমাণ ছাড়াই শাস্তি দেয়। যা মব জাস্টিসের অন্যতম কারণ।

এছাড়াও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। যা থেকে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে।

মব জাস্টিস-এর কারণে যা যা হতে পারে
বিশেষজ্ঞদের মতে, মব জাস্টিস গুরুতর এবং ধ্বংসাত্মক হয়। যা ব্যক্তি, সমাজ এবং আইন ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মব জাস্টিসে প্রায়ই নিরীহ মানুষও ভুক্তভোগী হয়। অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও অনেকে জনরোষের শিকার হন। গুজব বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সমাজের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে ধ্বংস করে।

আইনের শাসনকে অবমাননার অন্যতম রূপ হচ্ছে মব জাস্টিস। আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা না থাকলেই মানুষ নিজেই শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব নেয়। যা আইনব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা এবং কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

মব জাস্টিসের মাধ্যমে সমাজের বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা চিত্র উঠে আসে। সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়। সহিংসতার পুনরাবৃত্তি হয়।

মব জাস্টিস দেশের বিচার প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে। ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত বা শাস্তি পায় না।

মব জাস্টিস হলো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম কারণ। আইনগত প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে কাউকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার বিচারবহির্ভুত হত্যার সমতুল্য। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নীতি অনুযায়ী এটি অপরাধ।

এছাড়াও মব জাস্টিস ছড়িয়ে গেলে অপরাধের চক্রও বেড়ে যাবে। অপরাধীরাও মব জাস্টিস তৈরি করে নিজেদের স্বার্থ হাতিয়ে নেবে। আইন নিজের হাতে তুলে অপরাধীরাও নির্দ্বিধায় নিজের কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

মব জাস্টিস প্রতিরোধের উপায় কী
· সমাজে মব জাস্টিস প্রতিরোধে কঠোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং কার্যকর আইন প্রয়োগ জরুরি। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং সম্পদ দিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে।

·  মব জাস্টিস পরিস্থিতি প্রতিরোধে দ্রুত এবং সঠিকভাবে অপরাধীদের আটক এবং বিচার প্রক্রিয়ার কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। আইনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

·  উত্তেজিত জনতার মাধ্যমেই মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। তাই জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মব জাস্টিস আইনত অপরাধ এবং এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর- এই বিষয়গুলো জনগণকে জানাতে হবে। বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়ে প্রচারাভিযান চালনো যেতে পারে।

· আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অপরাধ-এই নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অনৈতিক এবং অনুচিত এটা স্পষ্টভাবে বোঝাতে হবে।

· গুজব থেকেও মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। গুজব প্রতিরোধে সতর্ক থাকতে হবে। যেকোনো বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে যেন কোনো উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

· সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মব জাস্টিসের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আবার এসব মাধ্যমে যেন গুজব না ছড়িয়ে পড়ে সেদিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে।

· সম্মানিত ব্যক্তি, ধর্মীয় নেতা এবং সমাজসেবীরা মব জাস্টিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জনগণকে মব জাস্টিসের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করতে পারেন। পুলিশকে জনগণের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

· বিচারব্যবস্থা যেন দ্রুত এবং সঠিকভাবে কাজ করে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা পেলে জনগণ মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটাবে না। তাই বিচার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন।

· বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও দক্ষ করে তুলতে হবে। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

· গণমাধ্যমক এবং সামাজিক মাধ্যমকে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে হবে। সঠিক খবর এবং তথ্য প্রদান করতে হবে। জনগণকে কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে উত্তেজিত করা যাবে না।

· উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে মব জাস্টিসের মতো ঘটনাকে আটকে দেওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে গুজবের বিষয়ে কিংবা কোনো পরিস্থিতির সঠিক তথ্য দিয়ে কিংবা মব জাস্টিসের ঘটনা দ্রুত রিপোর্ট করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

Link copied!