বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যা প্রাণহানি, সম্পদহানি এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। বন্যার সময় জানমাল রক্ষা করার জন্য সতর্কতা, প্রস্তুতি এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই পানিবন্দী হয় সাধারণ মানুষ। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেই পানিবন্দী মানুষের হাহাকার শোনা যায় প্রতিবছর। বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাত্ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। হিমালয়ের বরফগলা ও বৃষ্টির পানিতে দেশের প্রধান নদী ও উপনদীগুলোর পানি তুলনামূলকভাবে উচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হয়। এরপরই দেশের বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হয় বন্যায়।
বাংলাদেশের মানুষ এই পর্যন্ত প্রায় অনেকবারই বন্যার ভয়াবহতা দেখেছে। ১৯৮৮, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয় গোটা দেশ। সেসব পরিস্থিতিতে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই বছরও বন্যার ভয়াবহতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে গেছে ফেনীর উত্তরের তিন উপজেলা। শতাধিক গ্রামের লাখো মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বসতি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এই অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। তবুও স্থানীয়দের বন্যা পরিস্থিতিতে নিরাপদ থাকতে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে বন্যার কবল থেকে জানমাল রক্ষা করতে কিছু নির্দেশনা মানা অত্যন্ত জরুরি। বন্যার সময় জানমাল রক্ষার জন্য কিছু করণীয় পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো_
বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কতা অনুসরণ করুন
বন্যার পূর্বাভাস এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া সতর্কতা সম্পর্কে সর্বদা আপডেট থাকুন। রেডিও, টেলিভিশন বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে আবহাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করা হয়। যদি বন্যার সতর্কতা শুনতে পান তবে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন।
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রস্তুত রাখুন
বন্যার সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হতে পারে। এজন্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র আগে থেকে প্রস্তুত রাখুন। যেমন- প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী, প্যাকেটজাত শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির বোতল, প্রয়োজনীয় ওষুধ, ব্যাটারি চালিত রেডিও এবং ফ্ল্যাশলাইট, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র (যেমন পরিচয়পত্র, জমির দলিল) জলরোধী ব্যাগে সংরক্ষণ করুন। সেই সঙ্গে মোবাইল ফোনের চার্জার এবং পাওয়ার ব্যাঙ্ক নিতে ভুলবেন না। বিশুদ্ধ খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য চৌবাচ্চার ব্যবস্থা করতে পারেন।
নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করুন
বাড়ির আশেপাশে উচ্চতর বা উঁচু স্থানগুলো চিহ্নিত করুন। যেখানে বন্যার পানি আসার আগে আশ্রয় নিতে পারেন। পরিবার ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থানের পরিকল্পনা তৈরি করুন। আবার সরকার থেকে নির্ধারিত স্থানেও আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিশেষ করে টাকা-পয়সা, জমির দলিল, শিক্ষা সনদ নিরাপদ স্থানে রাখুন।
বাড়ির প্রস্তুতি নিন
বন্যার পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িকে প্রস্তুত করে নিন। বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ, গ্যাস লাইন এবং পানি সরবরাহ বন্ধ করুন। বাড়ির নিচু স্থানে রাখা মূল্যবান জিনিসপত্র এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উঁচু স্থানে সরিয়ে নিন। দরজা এবং জানালাগুলো ভালোভাবে বন্ধ করে দিন। যাতে বন্যার পানি ভেতরে ঢুকতে না পারে। কুয়ো বা অন্যান্য পানির উৎস ঢেকে রাখুন, যাতে পানি দূষিত না হয়।
নিরাপদে আশ্রয় নিন
বন্যার পানি বাড়তে থাকলে এবং বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, তাহলে দেরি না করে নিরাপদ স্থানে চলে যান। পানির স্তর যদি দ্রুত বাড়তে থাকে, তাহলে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিন। যেমন ছাদ বা কোনো টিলায় আশ্রয় নিতে পারেন। শস্য ও বীজ সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ স্থানে মাচা তৈরি করতে হবে। গৃহপালিত পশু নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
জলপথ এড়িয়ে চলুন
বন্যার সময় রাস্তা, সেতু বা জলাশয়গুলোর উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এ ধরনের জায়গা দিয়ে চলাচল করা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। বন্যার পানি অনেক সময় স্রোতধারাকে আড়াল করে। যা বিপজ্জনক হতে পারে। তীব্র স্রোতধারায় হেঁটে বা গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।
জরুরি পরিস্থিতিতে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকুন
বন্যার সময় জরুরি অবস্থার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকুন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সবসময় একত্রে থাকুন। যদি কেউ সমস্যায় পড়ে, তবে তার পাশে থাকার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে জরুরি সেবা যেমন ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিন।
পুনরায় বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে সতর্কতা অবলম্বন করুন
বন্যার পানি কমে গেলে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাড়িতে ফিরে আসার আগে সতর্কতা অবলম্বন করুন। কোনো ধ্বংসস্তূপ বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে তা এড়িয়ে চলুন। বৈদ্যুতিক লাইন বা গ্যাস সংযোগে ক্ষতি হলে নিজে থেকে মেরামত করার চেষ্টা করবেন না, বরং পেশাদারদের সাহায্য নিন।
বন্যার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন
বন্যার পর পানি, খাদ্য এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশুদ্ধ পানি পান করুন এবং খাবার ভালোভাবে রান্না করে খান। বন্যার পানি স্পর্শ না করা এবং পানি থেকে আসা ময়লা বা বর্জ্য এড়িয়ে চলা জরুরি। বন্যার দূষিত পানি পান করা যাবে না। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ফিটকিরি ব্যবহার করে পানি পান করতে হবে। বন্যার পানিতে গোসল করা, জামা-কাপড় ধোয়া যাবে না।
অন্যের সহযোগিতা করুন
বন্যার সময় একে অপরকে সাহায্য করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশী এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলুন। প্রয়োজনে নিজের বা অন্যদের সাহায্যের জন্য স্থানীয় সেবা বা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। বৃদ্ধ, শিশু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও গর্ভবতী নারীর ওপর বিশেষ নজর দিন। বিশেষ করে শিশুদের পানিতে নেমে খেলতে দেওয়া যাবে না। এতে বড় কোনো বিপদ হতে পারে।