২০২৪ সালে আলোচনার শীর্ষে ছিল জেন জি প্রজন্ম। বিশেষ করে তাদের ভাবনাগুলো ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। জেনারেশন জি’দের জেন জি বলা হয়। এই বছর তাদের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাধারা নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া এই প্রজন্ম প্রযুক্তি, সামাজিক পরিবর্তন এবং উদ্ভাবনের যুগে বেড়ে উঠেছে। তাই তাদের চিন্তাভাবনাও অনেকটাই আধুনিক। তারা গতানুগতিক চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে নতুনকে গ্রহণ করতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকে। জীবনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেও তারা পিছপা হন না। তাই প্রমাণ মিলেছে এই বছর। চলুন জেনে নেই, এই বছর অর্থাত্ ২০২৪ সালে জেন জিদের ভাবনাগুলোর মধ্যে আলোচিত বিষয় কোনগুলো ছিল।
প্রযুক্তি-ডিজিটাল সংস্কৃতিতে এগিয়ে
জেন জি এমন একটি প্রজন্ম যারা প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০২৪ সালে তারা কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী নয়, বরং নতুন উদ্ভাবনের চালক হিসেবেও পরিচয় দিয়েছে। তারা ডিজিটাল কানেক্টিভিটির অন্যতম নির্দশন। জেন জি ভার্চুয়াল দুনিয়াকে বাস্তব জীবনের সম্প্রসারণ হিসেবে দেখে। তারা সোশ্যাল মিডিয়াকে শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং নিজেদের প্রকাশ করার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হলেও, জেন জি অনলাইন প্রাইভেসি এবং ডেটা সুরক্ষার বিষয়ে সবসময়ই উদ্বিগ্ন। ২০২৪ সালে তারা আরও নিরাপদ এবং গোপনীয়তা-সম্মত ডিজিটাল পরিবেশের জন্য জোর দিচ্ছে।
এআই এবং অটোমেশনের বিষয়েও তারা এই বছর বেশ সচল ছিলেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারে জেন জি উচ্ছ্বসিত, তবে তারা এর নৈতিক দিক এবং সম্ভাব্য চাকরি হ্রাসের প্রভাব নিয়ে সচেতন।
পরিবেশ সচেতনতা-টেকসই উন্নয়নের দিকে জোর
জেন জি পরিবেশগত সমস্যাগুলোর প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। জলবায়ু পরিবর্তন, প্লাস্টিক দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় তাদের কাছে বড় উদ্বেগের বিষয়। ২০২৪ সালে, জেন জি পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তারা ফাস্ট ফ্যাশন এড়িয়ে সেকেন্ড-হ্যান্ড কেনাকাটা এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী।
গ্রেটা থুনবার্গের মতো পরিবেশবাদীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, জেন জি জলবায়ু আন্দোলনের সামনের সারিতে রয়েছে। তারা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে পরিবেশ সচেতনতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই প্রজন্ম কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশগত দায়িত্ব নিয়েও সচেতন। তারা টেকসই কার্যক্রম পরিচালনা না করা ব্র্যান্ডগুলোকে বর্জন করছে।
মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব
জেন জি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে আগ্রহী। তারা মানসিক সুস্থতাকে শারীরিক স্বাস্থ্যের সমতুল্য মনে করেন। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য তারা থেরাপি এবং সেলফ-কেয়ার সেন্টারের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ২০২৪ সালে তারা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের বিষয়ে আরও জোর দিয়েছেন। থেরাপি, মেডিটেশন, এবং সেলফ-কেয়ার রুটিনকে জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে বলেও তাদের বিশ্বাস। যদিও সোশ্যাল মিডিয়া তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তারা সচেতন। ফিল্টার সংস্কৃতি এবং শরীরের চিত্র নিয়ে তারা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন থাকে। বলা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তারা পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন।
কর্মসংস্কৃতি-ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রের নিশ্চিয়তা
জেন জি কর্মজীবনের বিষয়ে প্রচলিত ধারণা থেকে আলাদা। তারা ব্যক্তিগত মূল্যবোধ এবং কাজের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পেতে চায়। তারা ইতিবাচক কাজের পরিবেশ চায়। অফিসের পরিবর্তে রিমোট কাজ এবং হাইব্রিড মডেলে তারা বেশি আগ্রহী। জেন জি’রা একটি নির্দিষ্ট ক্যারিয়ার ট্র্যাকে আটকে থাকার পরিবর্তে, বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ খোঁজেন। তারা শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করতে আগ্রহী নন। বরং তারা এমন কাজ করতে চায়, যা তাদের মূল্যবোধ এবং সামাজিক প্রভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সামাজিক ন্যায়বিচার-বৈচিত্র্যের ভাবনা
জেন জি প্রজন্ম এই বছর সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষেও জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। তারা বৈচিত্র্য, অন্তর্ভুক্তি এবং সমতার পক্ষে কাজ করেন। এই প্রজন্ম লিঙ্গ পরিচয় এবং যৌনতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উদার। তারা লিঙ্গ সমতার অধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। তারা বর্ণবাদ এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তারা সর্বদাই সোশ্যাল মিডিয়া এবং বাস্তব জীবনে এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা ছড়ায়। প্রথাগত প্রতিবাদের পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অ্যাক্টিভিজম চালিয়ে যাচ্ছে এই প্রজন্ম। তারা পিটিশন, ক্যাম্পেইন এবং অনলাইন আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে সবসময়ই কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষা এবং দক্ষতায় নতুনত্ব
জেন জি প্রজন্ম শিক্ষার প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তারা একাডেমিক ডিগ্রির পাশাপাশি বাস্তব দক্ষতার ওপর জোর দিচ্ছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময় থেকেই তারা অনলাইন শিক্ষার প্রসারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই বছরও ব্যতিক্রম ছিল না। অনলাইন কার্যক্রম চালিয়ে তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিশুদের মাঝে শিক্ষা জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছে। জেন জি প্রচলিত ডিগ্রির চেয়ে দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা মনে করেন, শিক্ষা জীবন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
বিনোদন-মিডিয়ার আধুনিকতা
বিনোদনের ক্ষেত্রে জেন জি প্রজন্ম উদ্ভাবনী এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ মাধ্যম পছন্দ করে। ২০২৪ সালে তারা মূলত নেটফ্লিক্স, ডিজনি+ এবং ইউটিউবের মাধ্যমে বিনোদন গ্রহণ করছে। তারা টিভি চ্যানেলের তুলনায় অন-ডিমান্ড প্ল্যাটফর্ম বেশি পছন্দ করে। ভিডিও গেমিং তাদের বিনোদনের একটি বড় অংশ। ই-স্পোর্টস এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেমিং তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, জেন জি প্রজন্ম ইনফ্লুয়েন্সারদের জীবনধারা এবং পরামর্শে প্রভাবিত হয়। তবে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে প্রামাণিক এবং বাস্তববাদী বিষয়বস্তুর দিকে ঝুঁকছে।
আর্থিক স্বাধীনতা এবং বিনিয়োগে আগ্রহী
জেন জি প্রজন্ম আর্থিক দায়িত্ব এবং স্বাধীনতার বিষয়ে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তারা প্রচলিত আর্থিক পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন পন্থা অনুসরণ করছে। জেন জি ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে উৎসাহী থাকে। তারা ভবিষ্যতের আর্থিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এটি দেখে। এই প্রজন্ম অল্প বয়সেই নিজেদের সঞ্চয়ের বিষয়ে সচেতন। এমনকি বিনিয়োগও শুরু করছে। স্টক মার্কেট এবং ফিনটেক অ্যাপ তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চাকরি মধ্যেই ক্যারিয়ারকে সীমাবদ্ধ না রেখে, এর পাশাপাশি সাইড প্রজেক্ট এবং ফ্রিল্যান্স কাজের মাধ্যমে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
স্বাস্থ্য এবং ফিটনেস সচেতন
এই বছর জেন জি প্রজন্ম শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তারা ফিটনেসকে কেবল শরীরচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক শান্তি এবং সামগ্রিক সুস্থতার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। তারা ফিটনেস ট্র্যাক করার জন্য বিভিন্ন অ্যাপও ব্যবহার করে। পরিবেশগত সচেতনতার কারণে অনেকে ভেগানিজম বা প্ল্যান্ট-বেসড ডায়েটও গ্রহণ করছে।
২০২৪ সালে জেন জি একটি প্রগতিশীল, প্রযুক্তি-সচেতন এবং পরিবেশবান্ধব প্রজন্ম হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। তাদের চিন্তাধারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। তাদের ভাবনগুলো ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।