দুর্গাপূজা হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, আসাম এবং ত্রিপুরায় এই উত্সব ব্যাপকভাবে পালিত হয়। পূজার বিভিন্ন তিথি ও পর্যায়ের মধ্যে ষষ্ঠী দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দিনেই দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন ও অধিবাস ঘটে। ষষ্ঠী পূজার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন আচার, অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি সমৃদ্ধ। এই দিনটি দুর্গাপূজার মূল আয়োজনের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
ষষ্ঠী তিথি দুর্গাপূজার একটি অন্যতম বিশেষ দিন। এই দিনে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের বিশেষ আয়োজন থাকে। এটি মূলত দেবীর "কলাবউ" স্থাপনের মাধ্যমে পূজা শুরু করার দিন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দেবী দুর্গা তার সন্তানদের নিয়ে কৈলাস থেকে পৃথিবীতে আসেন তার ভক্তদের অসুর শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে। তাই ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর প্রতিমা ও তার পুজোর প্রধান আচার শুরু হয়। ষষ্ঠী থেকে শুরু হওয়া এই পূজার সময়ে ভক্তরা আনন্দে মেতে ওঠেন এবং দেবী দুর্গার প্রতি তাদের ভক্তি নিবেদন করেন। ষষ্ঠীর প্রধান আচার ও অনুষ্ঠানের মধ্যে কী কী থাকে চলুন জেনে নেই এই আয়োজনে।
বোধন
ষষ্ঠী তিথির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো দেবীর বোধন। বোধন বলতে দেবী দুর্গার জাগরণকে বোঝায়। পুরাণ অনুসারে, মহালয়ার পরদিন থেকে দেবী দুর্গা মর্ত্যে আগমন করেন এবং ষষ্ঠীতে তাকে জাগ্রত করা হয়। বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণ ও আচার-বিধির মাধ্যমে দেবী দুর্গার বোধন করা হয়। বোধন আচারটি সাধারণত সন্ধ্যার পর শুরু হয়। যখন দেবী দুর্গার মুখাবয়ব উন্মোচিত করা হয়।
কলাবউ স্থাপন
ষষ্ঠীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো কলাবউ স্থাপন। কলাবউ হলো একটি কলাগাছ। যাকে দেবী দুর্গার একটি রূপ হিসেবে পূজা করা হয়। কলাগাছটিকে একটি শাড়ি দিয়ে ঢেকে শঙ্খ নদীতে বা জলাশয়ে স্নান করানো হয় এবং পরে তা মণ্ডপে স্থাপন করা হয়। এই আচারকে দেবীর নবপত্রিকা স্থাপনও বলা হয়। যেখানে কলাগাছসহ অন্যান্য নয়টি পাতা দেবীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
অধিবাস
ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার অধিবাস করা হয়। যার অর্থ দেবীর পূজামণ্ডপে বসবাসের সূচনা। এই আচারটি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়। অধিবাসের মাধ্যমে দেবীকে পূজার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাকে অধিষ্ঠান করানো হয়। পূজার মন্ত্র, ঢাকের আওয়াজ ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে এই আচারটি অনুষ্ঠিত হয়। অধিবাসের পর থেকেই মূল পূজার কার্যক্রম শুরু হয়।
সন্ধ্যায় প্রতিমা দর্শন
ষষ্ঠী তিথির সন্ধ্যায় প্রতিমা দর্শন ঐতিহ্যবাহী আচারের মধ্যে একটি। এই সময়ে ভক্তরা মণ্ডপে গিয়ে দেবীর প্রথম দর্শন লাভ করেন। প্রতিমা দর্শন এবং পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া পূজার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সন্ধ্যার সময় আলোকসজ্জা, ঢাকের শব্দ এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মণ্ডপের পরিবেশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে। ভক্তরা একে অপরকে আশীর্বাদ জানান এবং নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে নেন।
আলপনা দেওয়া
ষষ্ঠীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য আচার হলো আলপনা বা মণ্ডপ সজ্জা। এই দিনে মণ্ডপের চারপাশে এবং পূজা স্থলের সামনে মাটি বা চালের গুঁড়ো দিয়ে সুন্দর আলপনা আঁকা হয়। এতে দেবীর প্রতি ভক্তির প্রকাশ ঘটে। আলপনা পূজার পরিবেশকে আরও পবিত্র ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও উৎসব
ষষ্ঠী তিথিতে পূজার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হলেও, এর পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমও হয়। বিশেষ করে সন্ধ্যায় মণ্ডপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান, নাচ এবং নাটকের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, যেমন মণ্ডপ সজ্জা, প্রতিমা তৈরির প্রতিযোগিতা ইত্যাদি এই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও, ষষ্ঠী থেকে শুরু করে প্রতিদিনই পূজা মণ্ডপে ভক্তদের ভিড় জমতে থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়ে ভক্তরা বিভিন্ন মণ্ডপ পরিদর্শনে যান, যা ‘পূজা পরিক্রমা’ নামে পরিচিত।
খাদ্য ও প্রসাদ
ষষ্ঠী তিথিতে ভক্তরা বিশেষ প্রসাদ গ্রহণ করেন। সাধারণত খিচুড়ি, পায়েস, ফল এবং মিষ্টি প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়। এছাড়াও, এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও ভোগের আয়োজন করা হয়, যা ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।