পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতি নিজেকে বিভিন্ন রহস্যের আবরণে ঢেকে রেখেছে। তাই বলাই যায় আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে রহস্যের কোনো কমতি নেই। আবার সেই রহস্য উদঘাটনের মানুষের চেষ্টারও কোনো কমতি নেই। কৌতূহলী মানুষ শত শত বছর ধরে সেই সকল রহস্যের সমাধানে নিজেদের সময়, শ্রম, অর্থ এমনকি জীবন পর্যন্ত বাজি রেখে আসছে। ‘স্টোনহেঞ্জ’ তেমনি এক রহস্য। যা বছরের পর বছর ধরে মানুষ কে আকর্ষণ করেছে আর করেছে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন।
স্টোনহেঞ্জ এর নাম শুনলেই প্রথমেই মাথায় চলে আসে কারা এটি তৈরি করেছিল, কিভাবে আর কেনইবা এটি তৈরি করেছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে পাওয়া তথ্যের আলোকে তুলে ধরা হল রহস্যময় এ স্থানের কথা।
ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে স্যালিসবারি সমভূমিতে অবস্থিত পাথরের একটি প্রাগৈতিহাসিক ‘স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা কবরস্থান অথবা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এই স্টোনহেঞ্জ। নব্যপ্রস্তর যুগে তৈরিকৃত এই স্থাপনাটি এতই আগের যে এর সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়না। ইংল্যান্ড থেকে প্রায় ৮ মাইল বা (১৩ কিলোমিটার) উত্তরে অবস্থিত। মূলত খাড়া পাথরের তৈরি বলয়াকৃতির একটি স্মৃতিস্তম্ভ। বিজ্ঞানের দাবি অনুযায়ী গত ১০ হাজার বছর ধরে স্টোনহেঞ্জ বিবর্তিত হয়ে আসছে। বর্তমানে স্থাপনার যে অংশটি আমরা দেখি তা আনুমানিক ৪ থেকে ৫ হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। তবে মূল কাঠামোটি বর্তমান স্টোনহেঞ্জ কাঠামোর প্রায় ১৫ গুণ বড় ছিল।
যদিও স্টোনহেঞ্জ নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। অনেকের ধারণা, এটি একটি ধর্মীয় স্থান। শত শত পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তীও রয়েছে। এমনকি কেউ কেউ বিশ্বাস করেন এলিয়েনের কথাও। এক শ্রেণীর গবেষকরা মনে করেন এই ধর্মযাজক বিভিন্ন উৎসর্গমূলক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্য এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক ড. ইউলিয়াম স্টকলির গবেষণা ও প্রচারণায় উঠে আসে প্রাচীন কেল্টিক জাতির একজন ধর্মযাজক ‘ড্রইডরা’ স্টোনহেঞ্জের প্রস্তুতকারক। তবে বেশিদিন টেকেনি উইলিয়ামের মতবাদ বা গবেষণার মূল্যায়ন। আধুনিক রেডিও কার্বন ডেটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন কেল্টিকরা এই অঞ্চলে আসার এক হাজার বছর আগেই নির্মিত হয়েছিল স্টোনহেঞ্জ।
তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী একমত হয়েছেন যে তিনটি উপজাতি তিনটি ভিন্ন সময়ে স্টোনহেঞ্জ নির্মাণ করেছে। অনেকে প্রথম ধাপটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের চেয়ে এক হাজার বছর আগের হিসাব করলেও এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। প্রথম ধাপে এর বাইরের দিকের ৩৬০ ফুট ব্যাসের একটি বৃত্তাকার পরিখা খননের কাজ শুরু হয়, যার গভীরতা ছয় ফুট। পরিখার উত্তর-পূর্বে একটি বড় প্রবেশপথ ও দক্ষিণ দিকে একটি ছোট প্রবেশপথ আছে। এই পরিখা ও এর ঢালু কিনারাকে একত্রে ‘হেঞ্জ’ বলা হয়।
পুরো হেঞ্জজুড়ে রয়েছে ৫৬টি ছোট ছোট খাদ, এসবের প্রতিটির ব্যাস তিন ফুটের মতো। ১৭ শতকে জন অব্রে নামক এক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক এই খাদ বা গর্ত আবিষ্কার করেন। তার নামেই এগুলোর নামকরণ হয় ‘অব্রে হোল’। ধারণা করা হয়, গর্তগুলোকে ‘ব্লুস্টোন’ অথবা কাঠের তক্তা দিয়ে ভরাট করা হয়েছিল। ব্লুস্টোন হচ্ছে স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে ছোট আকারের পাথর, যেগুলো ভেজা অবস্থায় কিছুটা নীলাভ দেখায়।
দ্বিতীয় ধাপে ঠিক কী কাজ হয়েছিল সেই প্রমাণ খুব একটা দৃশ্যমান নয়। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, আগেরটি শেষ হওয়ার ১০০ থেকে ২০০ বছর পর শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের কাজ। এ সময় থেকে স্টোনহেঞ্জকে সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে। তখন কেন্দ্রে ছাদসদৃশ গঠন বানানো হয়। বৃত্তাকার পরিখায় শবদাহের জন্য নতুনভাবে আরও ৩০টি গর্ত খনন করা হয়।
তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বছর পর। প্রধান কাজ মূলত এ সময় হয় এবং এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ ধাপ। তখন অব্রে হোলগুলোর ব্লুস্টোন তুলে ফেলে বসানো হয় ৩০টি বিশালাকার ‘সারসেন’। স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে বড় পাথরগুলোকে সারসেন বলা হয়। এগুলো ২৫ মাইল দূরবর্তী মার্লবোরো নামক স্থান থেকে আনা হয়েছিল। প্রতিটি সারসেন উচ্চতায় ১৩ ফুট ও প্রায় ৭ ফুট চওড়া। এগুলার ওজন প্রায় ২৫ টন! ওই সময় আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া এত বড় পাথরগুলো কীভাবে টেনে আনা হয়েছে তা আজও বিস্ময়!
এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এক ডজন লোকের দ্বারা কাঠের ট্র্যাকওয়ে ব্যবহার করে ১ টনের একটি পাথর সরানো সম্ভব, তবে এই কৌশলটি আসলে প্রাচীন স্থপতিদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা তা অনিশ্চিত। বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনাও উত্থাপন করেছেন যে, শেষ বরফ যুগের হিমবাহ এই পাথর গুলোকে স্টোনহেঞ্জ এলাকার কাছাকাছি বয়ে এনেছে যার ফলে স্টোনহেঞ্জের স্থপতিদের এগুলো ওয়েলস থেকে এত দূর পর্যন্ত বহন করতে হয়নি। অন্য আরেকটি পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে যে বন্যার পানিতে পাথরগুলো ভেসে এসেছে। তবে এই পদ্ধতিটির ও সত্যতা পাওয়া যায়নি।
১৯৮৬ সালে স্টোনহেঞ্জকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা দেয় ইউনেস্কো। এরপর থেকে এর কাছে যাওয়া বন্ধ রয়েছে। স্টোনহেঞ্জের খুব কাছাকাছি পর্যটকদের চলাফেরা নিষিদ্ধ। এ কারণে দর্শনার্থীদের একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দেখতে হয় নব্যপ্রস্তরযুগীয় বিস্ময়টিকে। স্টোনহেঞ্জের গঠন খানিকটা জটিল। তবে এটি তৈরিতে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। ধূসর বর্ণের প্রায় ১৩ ফুট উচ্চতার পাথরগুলোতে ফুটে উঠেছে জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার সঙ্গে এই স্থাপত্যের খানিকটা মিল পাওয়া যায়। স্টোনহেঞ্জের পাথরগুলোর গঠনে আছে দুটি বৃত্তাকার ও দুটি ঘোড়ার খুরের নলের আকারবিশিষ্ট পাথরের সারি। এছাড়া কতগুলো পৃথক পাথর রয়েছে অল্টার স্টোন।
স্টোনহেঞ্জ একটি সমাধিস্থলই ছিল, আশেপাশের এলাকা থেকে পাওয়া হাড় ও কঙ্কাল থেকে সেই প্রমাণ পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয়, বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকা থেকে লোকজন এখানে উপাসনার জন্য আসতো। এতে ৬৩ জন মানুষের হাড়ের টুকরো খুঁজে পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। অদ্ভুত গঠনের স্টোনহেঞ্জকে পবিত্র স্থান হিসেবে ব্যবহার করতেন ধর্মযাজকরা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে স্টোনহেঞ্জ আদতে ছিল বছরের মাস ও দিনের হিসাব রাখার সৌর ক্যালেন্ডার। স্টোনহেঞ্জ নিয়ে নতুন এ গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক টিমোথি ডারভিল। বছরের মাস আর দিন থেকে শুরু করে অধিবর্ষের (লিপইয়ার) হিসাবও কীভাবে স্টোনহেঞ্জের মাধ্যমে করা হতো, গবেষণায় তুলে ধরেছেন তিনি।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটির সবচেয়ে বাইরের দিকের বৃত্তটি তৈরি করা হয় সারি করে বসানো ৩০টি সারসেন স্টোন দিয়ে। এগুলোর ওপর সাজানো ছিল ৩০টি পাথর। মাসের ৩০ দিন গণনা করতেই সারসেন স্টোনগুলো ব্যবহার করা হতো। স্টোনহেঞ্জে প্রতি মাসকে ভাগ করা হয়েছিল তিন সপ্তাহে। প্রতি ১০ দিনে এক সপ্তাহ গণনার জন্য সারসেন স্টোনগুলোর মধ্যে তিনটি নির্দিষ্ট করা ছিল।
মাসে ৩০ দিন করে ধরলে ১২ মাসে ৩৬০ দিন হয়। তবে অধিবর্ষ ছাড়া সৌর বছরে মোট দিনের সংখ্যা ৩৬৫। অধ্যাপক ডারভিল বলছেন, স্টোনহেঞ্জের বাইরের বৃত্তের ভেতরে পাঁচ জোড়া সারসেন স্টোন ঘোড়ার খুরের আকৃতিতে সারি করে বসানো ছিল। সেগুলো বাড়তি পাঁচ দিন গুনতে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া বৃত্তের বাইরে বেশ খানিকটা দূরে চার কোনায় চারটি ছোট পাথর ছিল। প্রতি চার বছর পর অধিবর্ষ আসে।অধিবর্ষের বাড়তি এক দিনের হিসাব রাখতেই ব্যবহার করা হতো ওই চার পাথর।
তবে রহস্যময় এই ‘স্টোনহেঞ্জ’ প্রাগৈতিহাসিক ‘স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা কবরস্থান, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান অথবা সৌর ক্যালেন্ডার যাই হোক না কেন এটিকে ঘিরে মানুষের যে কৌতূহল তা কখনই মিটবার নয়। কেননা কোনো ব্যাখ্যায় চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত নয় এবং সেটি করা কখনো সম্ভব হবে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যায়।