চৈত্র সংক্রান্তি, অর্থাৎ বাংলা বছরের শেষ দিন। এই দিনটি বাঙালি সংস্কৃতির এক বিশেষ দিন। এটি পুরোনো বছরের শেষ ক্ষণকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতির দিন হিসেবেও বিবেচিত। বাঙালির লোকজ সংস্কৃতিতে এই দিনটি ঘিরে রয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান, মেলা, পূজা এবং বিশেষভাবে চৈত্র ভোজ। এটি হলো একটি রীতিমাফিক ভোজ, যেখানে নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করা হয়।
চৈত্র সংক্রান্তিতে চৈত্র ভোজ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হলো পুরোনো বছরের গ্লানি দূর করে, পরিবার-প্রতিবেশীকে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করা এবং মিলনের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। কৃষিভিত্তিক সমাজে এটি নতুন ফসল তোলার পরের সময়, তাই এই সময় ধান, চাল, তেল, মশলার অভাব থাকে না। যা ভোজ আয়োজনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। এতে সামাজিক ও আত্মিক সম্পর্কের বন্ধন মজবুত হয়।
চৈত্র ভোজে কী কী খাবার থাকে
চৈত্র ভোজে সাধারণত মৌসুমি খাবার, লোকজ রান্না এবং কিছু বিশেষ খাবার থাকে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে_
তেতো দিয়ে শুরু
চৈত্র ভোজের শুরুতেই তেতো খাওয়ার একটি রীতি রয়েছে। লোকবিশ্বাস অনুসারে, তেতো খেলে শরীর শুদ্ধ হয় এবং গ্রীষ্মকালীন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। নিমপাতা ভাজি, তেতুল পাতা দিয়ে তেতুল তরকারি, চিচিঙ্গা, করলা ভাজি, তেঁতো চচ্চড়ি – যেখানে করলা, পটল, বেগুন, নিমপাতা ইত্যাদি একসঙ্গে রান্না হয়।
ভর্তা ও ভাজি
বাংলা ভোজন সংস্কৃতিতে ভর্তা একটি অপরিহার্য উপাদান, যা চৈত্র ভোজে বিশেষ গুরুত্ব পায়। আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, সরষে-পুঁই শাক ভর্তা, শুকনা মরিচ ও সরষে তেলে পটল ভর্তা, ধনে পাতা ভর্তা, শুকনা চিংড়ির ভর্তার আয়োজন করা হয়। এর সঙ্গে থাকে নানা রকমের ভাজি যেমন- ধুন্দুল ভাজি, শিম ভাজি, ঝিঙ্গা ভাজি, কচুশাক ভাজা ইত্যাদি।
ডাল ও শাকসবজি
চৈত্র ভোজে সাধারণত মসুর বা মুগ ডাল পরিবেশিত হয়। লাউ বা পেঁপে দিয়ে রান্না ডাল, কুমড়া-মটর ডাল এবং নানান রকম শাক যেমন পুঁই, নটিশাক, লাল শাকের আয়োজন থাকে।
মাছের নানা পদ
বাংলা রান্নায় মাছের গুরুত্ব অপরিসীম, আর চৈত্র ভোজেও এর ব্যতিক্রম হয় না। রুই মাছের কালিয়া,
ইলিশ মাছের পাতুরি বা ভাজা, সর্ষে ইলিশ, চিংড়ি মাছ দিয়ে কচু বা লাউ, টাকি মাছ শুকনা, শোল মাছের দোপেয়াজা এবং ছোট মাছ দিয়ে শুঁটকি বা শাক মিশিয়ে রান্নাও করা হয়।
মাংস ও ডিমের আয়োজন
যদিও মাছ-ভেজের আধিক্য বেশি, তবুও অনেক পরিবারে মুরগি বা খাসির মাংসের আয়োজনও দেখা যায়। মুরগির ঝোল, খাসির রেজালা এবং ডিমের কারির আয়োজন থাকে।
পিঠা-পায়েস ও মিষ্টান্ন
চৈত্র ভোজ শেষে মুখরোচক মিষ্টি খাবার পরিবেশন করা হয়। নারকেল দিয়ে পায়েস, চিতই বা পাটিসাপটা পিঠা, দুধ-চিনির মোয়া, খেজুর গুড় দিয়ে কলাই পিঠা, নারকেল নাড়ু এবং দই ও মিষ্টির (যেমন সন্দেশ, রসগোল্লা) আয়োজন থাকে।
পান ও মুড়ি-মুড়কি
ভোজের শেষ রীতি হিসেবে থাকে পান খাওয়া। অনেকে মুড়ি-মুড়কি বা চিড়া-মুড়ি, নারকেল ও গুড় মিশিয়ে মুখশুদ্ধি হিসেবে পরিবেশন করে।
চৈত্র ভোজে প্রতিটি পদেই লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, লোকজ জ্ঞান, ঋতু চেতনা এবং পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার বার্তা। এটি পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের একত্রিত করে, হৃদয়ে এনে দেয় সম্প্রীতির উষ্ণতা।