পবিত্র রমজান মাস চলছে। এই মাস মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ ছাড়া মহিমান্বিত এই রমজান মাসে রয়েছে শ্রেষ্ঠ রাত। লাইলাতুল কদরের রাত। রমজান মাসের শেষ বিজোড় রাত্রির যেকোনো এক রাত হয় লাইলাতুল কদর। পবিত্র এই রাতে নাজিল হয়েছিল মুসলিমদের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পবিত্র কোরআন। তাই এই রাতের কদর বেশি। প্রত্যেক মুসলমানরা সারা রাত দোয়া প্রার্থনা, জিকির করেই এই রাত যাপন করেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ‘কদর’ নামে একটি সুরা নাজিল করেছেন। সুরায় উল্লেখ রয়েছে, ‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। ’ এই লাইলাতুল কদরের রাতে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের ক্ষমা করেন এবং হজরত জিবরাইল (আ.)-সহ রহমতের ফেরেশতারা পৃথিবীতে আগমন করেন।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মাঝে রমজান আগমন করেছে। তাতে রয়েছে এমন রাত, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। যে সে রাত থেকে বঞ্চিত হলো, সে কল্যাণ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হলো। আর হতভাগা ব্যক্তি ছাড়া কেউ তার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয় না। -সুনানে ইবনে মাজাহ।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) শবে কদরের রাতে ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার করতেন। তিনি আত্মিক সাধনার মাধ্যমে কদরের রাত ও তার কল্যাণ অনুসন্ধান করতেন। রমজান মাসের শেষ ১০ রাতে তিনি সব ধরনের জাগতিক কাজকর্ম থেকে অবসর নিয়েছেন এবং আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতেন। এ রাতে রাসুল (সা.) অধিক পরিমাণ নামাজ আদায় করতেন। রাত্রী জাগরণ করতেন। সাহাবাদেরও নামাজ আদায় করতে বলতেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রত্যেক রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং মৃত্যুর বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেন। -সহিহ বোখারি
হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মতকেও রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর। ’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
রমজান মাসের ২৭ তারিখের রাতে শবে কদর হওয়ার ব্যাপারেও বর্ণনা রয়েছে। হজরত মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রা.) থেকে বর্ণিত-হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘কদরের রাত হলো- সাতাশের রাত। ’ -সুনানে আবু দাউদ
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে কদরের রাতে নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তার পেছনের সব পাপ মার্জনা করবেন। ’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
হজরত মুহাম্মদ (সা.) রমজানে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কদরের রাতে তেলাওয়াতের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিতেন। হজরত ফাতেমা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তার পিতা তাকে বলেছে, প্রতি রমজানে জিবরাইলকে (আ.) একবার কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। কিন্তু মৃত্যুর বছর তিনি তাকে দু’বার কোরআন শোনান। ’ -সুনানে বায়হাকি
শবে কদরের নামাজের নিয়ত
‘নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তায়া`লা রাকআ`তাই ছালাতি লাইলাতিল কদর-নাফলি, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা-জিহাতিল্ কা’বাতিশ্ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।’ অর্থ: আমি কাবামুখী হয়ে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য শবে কদরের দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার।
শবে কদরের নামাজ পড়ার নিয়ম
এই রাতে বিশেষ কোনো নামাজের নিয়ম নেই। দুই রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করতে হবে। যত খুশি নামাজ পড়তে পারেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরআন তেলাওয়াত করবেন, জিকির, দোয়া, ইস্তেগফার পড়বেন এবং তওবা করবেন। বেশি বেশি করে সুরা কদর ও সুরা ইখলাস পড়তে পারেন। নামাজ শেষে একটি দোয়া কমপক্ষে ১০০ বার পড়তে পারেন। দোয়াটি হলো_
‘সুব্হানাল্লাহি ওয়াল হাম্দু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, লা হা’ওলা কুয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহিল্ আলীয়্যিল আযীম।’
শবে কদরের রাতে যে দোয়া বেশি পড়তে হয়
শবে কদরের রাতে মুহাম্মদ (সা.) বেশি বেশি দোয়া করতেন এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলি, কদরের রাতে আমি কী বলব, তিনি বলেন, তুমি পড়বে- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফউন। তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি।“ অর্থ: হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন। -সুনানে নাসায়ি
এ ছাড়া পবিত্র এই রাতে আরও একটি দোয়ার বর্ণনা হাদিসে পাওয়া যায়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ (সা.) নিম্নের দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করতেন- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফিয়াতা ফিদ-দুনইয়া ওয়াল আখিরা। আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফওয়া ওয়াল আ-ফিয়াতা ফি দিনি ওয়া দুনইয়ায়া ওয়া আহলি ওয়া মালি। - আল আদাবুল মুফরাদ। (অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দুনিয়া ও আখেরাতের অনুগ্রহ চাই। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আমার ধর্ম, আমার জাগতিক জীবন, আমার পরিবার ও সম্পদের ব্যাপারে ক্ষমা ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি।)
শবে কদরের রাতে যেভাবে আমল করবেন
পবিত্র শবে কদরের রাতে প্রথমে গোসল করে পরিষ্কার পোশাক পরিধান করুন। এশার নামাজ আদায় করে নিন। এরপর রাত ১২টার আগ পর্যন্ত কোরআন পড়তে পারেন। বেশি বেশি নফল আর হাজতের নামাজ আদায় করুন। রাত ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত জিকির করতে পারেন। যেমন-
- সুবহানাল্লহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লহু আকবার। (১০০ বার করে)
- লা ইলাহা ইল্লাল্লহ (২০০ বার)
- আস্তাগফিরুল্লহ (কমপক্ষে ৫০০ বার, যত বেশি সম্ভব হয়)
- বেশি বেশি দুরুদ পড়া।
- সুবহানাল্লহি ওয়াবিহামদিহি (কমপক্ষে ১০০ বার)
- "লা ইলাহা ইল্লাল্লহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুওয়া আ`লা কুল্লি শাইয়্যিন কদির" (কমপক্ষে ১০০ বার)
- দোয়া ইউনুস - "লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায্ যলিমীন" ।(যত পারেন)
- "সুবহানাল্লহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লহিল `আযীম।" (কমপক্ষে ১০০ বার) ।
- "লা হাওলা ওয়ালা কুওওতা ইল্লা বিল্লাহ" বেশি বেশি পড়তে পারেন।
- সুরা ইখলাস যত বেশি পড়ুন।
- স্যায়েদুল ইস্তগফার পাঠ করুন।
রাত ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তাহাজ্জুদ পরুন অন্তত ৮ রাকাত। রুকু ও সিজদায় বেশি সময় দিন। সিজদায় দোয়া করতে পারেন। তাহাজ্জুদের পর তিন রাকাত বিতরের নামাজ পড়ুন। সাহরি খাওয়ার আগেই হাত তুলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। এরপর সাহরি খেয়ে ফজরের নামাজ আদায় করুন।