চলমান জীবনযাত্রা হঠাৎ থমকে যাওয়া, এরপর আবারও চলমান। ২০২১ সালের এই বছরটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এভাবেই পেরিয়ে যায়। পুরো বছরজুড়েই ছিল করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক, যা জীবনযাত্রার চলমান গতিতে প্রভাব ফেলে। বছরের শুরুতে ছিল অনলাইন ক্লাস, হোম অফিস, মাস্ক পরা, সামাজিক অনুষ্ঠান কমে যাওয়া, মেলার আয়োজন বন্ধ, সুরক্ষা ব্যবস্থা, মোবাইল ব্যবহার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ড। মাঝামাঝি সময় এসে গতি ফিরে পায় জীবনযাত্রায়। অনলাইন থেকে ক্লাসে ফেরা, হোম থেকে সশরীরে অফিসে ফেরা সবই আবারও শুরু হয়।
বছরজুড়েই জীবনগতিতে এই পরিবর্তনগুলোর দিকে পেছন ফিরে দেখব সালতামামির এই আয়োজনে।
অনলাইন ক্লাস থেকে শ্রেণিকক্ষে ফেরা
গত বছর থেকেই শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বাড়ি থেকেই অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইমেন্ট করতে হয়েছে তাদের। করোনার প্রভাবে দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ায় সরকার। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বয়সী শিক্ষার্থীরাই অনলাইনে ক্লাস করেছে। রুদ্ধশ্বাস হয়ে পড়েছিল শিক্ষার্থীদের জীবন। এরপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে অনলাইন ক্লাস থেকে শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। সপ্তাহে এক দিন করে ক্লাস চালু হয় শ্রেণিকক্ষে। শুরু হয় থেমে যাওয়া পরীক্ষাগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীর উপস্থিত থেকে পরীক্ষা দেন শিক্ষার্থীরা। পাঠ্য বিষয় কমিয়ে মূল বিষয়ের ওপর পরীক্ষা হয় এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের। কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনেই অনুষ্ঠিত হয় সব পরীক্ষা।
হোম অফিস থেকে অফিস কার্যালয়
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশেই করোনা পরিস্থিতির লকডাউনে হোম অফিস চালু করে। গত বছর থেকেই চালু থাকা এই সিস্টেম চলমান ছিল এই বছরও। বাংলাদেশেও বছরের শুরুর ভাগে লকডাউন পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি অফিসের কার্যক্রম বাসা থেকেই অনলাইনে পরিচালিত হয়। হোম অফিসে থেকে কর্মঘণ্টাও বেড়ে যায়। দিনের বেশির ভাগ সময় অফিসের কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। তবে লকডাউন শেষ হলেই কাজের গতিতে ফিরে আসে অনেকে। শুরু হয় নিয়ম বেঁধে অফিসে আসা-যাওয়া। থেমে থাকা কাজগুলোও নতুনভাবে শুরু হয়।
নিত্যপণ্যের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি
এই বছরের জীবনযাত্রায় নিত্যপণ্যের মূল্যেরও ঊর্ধ্বগতি ছিল। করোনার সময়ে চাহিদা অনুযায়ী নিত্যপণ্যের মজুত রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। এছাড়া যাতায়াতের অসুবিধায়ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে ব্যক্তি জীবনে। আয় কমে যাওয়ায় ক্রেতারা উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে প্রায়ই হিমশিম খান। অন্যদিকে পণ্য মজুত ও বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েন ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও করোনার প্রভাবে তা লাগামহীনভাবে বেড়েছে।
মাস্ক পরা
করোনাকালীন জীবনযাত্রায় মাস্ক হলো নিত্যদিনের সঙ্গী। ঘর থেকে বের হওয়া মানেই মুখে মাস্ক পরা। সুরক্ষা পেতে এর বিকল্প নেই। মাস্ক পরায় সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করতে বিভিন্ন ধরনের ও ডিজাইনের মাস্ক বের হয়েছে। কাপড়ের মাস্কের এসেছে নতুনত্ব। ফ্যাশন হাউসগুলোও তাল মিলিয়ে পোশাকের সঙ্গে ম্যাচিং মাস্ক রাখে। তবে বছরজুড়ে এবার কালো মাস্কের ব্যবহার বেশি হয়েছে। বিশ্ব ফ্যাশনেও কালো মাস্ক ট্রেন্ডিংয়ে ছিল। দেশেও এর প্রভাব পড়ে। তরুণ-তরুণীসহ মধ্য বয়সীরাও কালো মাস্কে বেশ ফ্যাশন করেছেন এই বছর।
সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার শুরু
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বিশালাকারে অনুষ্ঠানের আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। এই বছরের লকডাউনের পরিস্থিতিতেও এই নির্দেশ জারি ছিল। ঘরে ঘরেই সেরে নেওয়া হয় বিয়ে, জন্মদিনসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান। তবে বছরের মাঝামাঝিতে লকডাউন উঠে গেলে আবারও শুরু হয় উত্সব আয়োজন। বিয়ের মৌসুম শুরু হতেই ঘর থেকে বেরিয়ে বড় পার্টি সেন্টারে আয়োজন হয়। আয়োজনে কেউ কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছে। তবে অধিকাংশই স্বাস্থ্যবিধির শর্ত উপেক্ষা করে উত্সব আনন্দে মেতে উঠেছে। চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে জীবনগতিতে। রঙিন পোশাকে, জমকালো আয়োজনে সারা দেশেই মুখরিত হয়ে উঠেছে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো।
মেলার আয়োজন
সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বন্ধ ছিল মেলার আয়োজনও। দেশজুড়ে কোথাও কোনো মেলা আয়োজন ছিল না। এমনকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার আয়োজন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দফা পিছিয়ে অবশেষে বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিবছরের ১ জানুয়ারি থেকে এই মেলা আয়োজন করা হয়। কিন্তু করোনা মহামারি ঠেকাতে ২০২০ ও ২০২১ সালের আয়োজন ছিল স্থগিত। তবে করোনা সংকট কিছু কাটিয়ে উঠলে আবারও মেলার আয়োজনের ঘোষণা দেয় সরকার। বিশাল আয়োজনে এই মেলার আয়োজন হবে আগামী বছরের শুরুতেই।
মোবাইল ফোন আসক্তি
করোনা মহামারির লকডাউনে যখন চারপাশ বন্ধ, তখন ঘরে বসে সবার একটাই মাধ্যম ছিল মোবাইল ফোন। ছোট-বড় সবারই মোবাইল আসক্তি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ছোটরা গেম খেলে দিনের বেশির ভাগ সময়ই মোবাইল ফোনে কাটিয়েছে। বিশেষ করে পাবজি গেমে বিশ্বজুড়ে ছোটদের আসক্তি বেড়েছে। অন্যদিকে বড়রা হোম অফিসের কাজে বা অবসরে মুভি দেখতে দিনের বেশি সময় ব্যস্ত থেকেছেন মোবাইল ফোনে। তাই এই বছর মোবাইল ফোন জীবনযাত্রার অন্যতম প্রধান অংশ ছিল। শ্রেণিকক্ষে ফেরা কিংবা অফিসে ফিরে যাওয়ার পর মোবাইল ফোনের আসক্তি কিছুটা কমেছে। বিশেষজ্ঞরা একে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।