রমজান মাস চলছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে গরমও। রোজাদাররা সারা দিন রোজা রেখে ইফতারের টেবিলে বসেন। ইফতার প্লেটের সামনে বসে অপেক্ষা করেন মাগরিবের আজানের। আজানের ধ্বনি শুনেই একটি খেজুর মুখে তুলে নেন। এরপর এগিয়ে যান শরবতের গ্লাসের দিকে। শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতেই যেন সারা দিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই শেষ। রোজার পর ইফতারের প্রকৃত তৃপ্তি মেলে শরবতের এক চুমুকেই।
শরবতের প্রচলন চলে এসেছে যুগ যুগ ধরেই। যদিও সেই সময় শরবতে তেমন বৈচিত্র্য ছিল না। কিন্তু জনপ্রিয়তা ছিল। ইফতার, অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সবকিছুতেই ছিল শরবত। নতুন জামাইকে বরণ করতেও শরবত খাওয়ানো হতো। মিষ্টি মুখে সমাদর করার রীতিতেই শরবতের বিস্তার ঘটে প্রতিটি ঘরে ঘরে।
মুহূর্তেই শরীর, মনে সজীবতা ফিরিয়ে আনতে শরবতের জুড়ি নেই। ‘ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে’ বইয়ে লেখক ও গবেষক হাকিম হাবিবুর রহমান ঢাকার ইফতারের চিত্র তুলে ধরেছেন। বইয়ে লেখক জানান, দেড় শ বছর আগে যেকোনো মৌসুমেই ঢাকায় পাওয়া যেত পুদিনাপাতা, ক্ষীরা আর ধনেপাতা। আর পাওয়া যেত আখ। গোলাপ বা কেওড়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে সুবাসিত করা হতো। যা বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে বেশি প্রচলন ছিল ফালুদা ও তোকমার শরবত। ওই সময় বেলের শরবতেরও জনপ্রিয়তা ছিল।
৩০ বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে ইফতারে শরবতের বেশ আয়োজন ছিল। ওই সময় গুড় দিয়েই শরবত বানানো হতো। আবার বাতাসার শরবতও ছিল জনপ্রিয়। এখনো গুড়ের শরবতে যুক্ত হয়েছে লেবু, তোকমাসহ নানা উপকরণ।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা শরবতের এই জনপ্রিয়তা এখনও কমেনি। বরং শরবতে এসেছে বৈচিত্র্য। নিত্যনতুন উপকরণ দিয়ে বানানো হচ্ছে শরবত। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে জনপ্রিয়তা বেড়েছে ভিন্ন স্বাদের শরবতের। পুরান ঢাকার শরবতে রয়েছে মোঘল ঐতিহ্য। বিউটি লাচ্ছি, আনন্দ জাফরানি, ডিসেন্ট স্পেশাল কাশ্মীরি, রয়্যাল পেস্তা শরবত এখনও বিখ্যাত। দুধ, মালাই, পেস্তা, জাফরান ও চিনি দিয়ে বানানো এসব শরবত এখনও ঐতিহ্য বহন করে। প্রস্ততকারকেরা শরবতে আধুনিকায়ন করতে অনেক উপাদান দেশের বাইরে থেকেও নিয়ে আসে। এছাড়াও পুরান ঢাকার দিলখুশ আজোয়া, দিলবাহার আজোয়া শরবতে রয়েছে রাজকীয় স্বাদ।
এদিকে বনানী, গুলশান, সিদ্ধেশ্বরী, বেইলি রোড, খিলগাঁও এলাকার শরবতের আয়োজনে দেখা যায় আধুনিকতার ছোঁয়া। বনানীর বুস্ট জুস, ধানমন্ডির ঠান্ডা গরম, সিদ্ধেশ্বরীর ক্যাফে গেলেটেরিয়া, মোহাম্মদপুর টাউন হলের সিঙ্গাপুর জুস কর্নারের মতো দোকানে রয়েছে শরবতের বৈচিত্র্য। যেখানে পাওয়া যায় ক্র্যানবেরি, ব্লু বেরি, স্ট্রবেরির শরবত। লালমাটিয়ায় বিটরুটের শরবত, খিলগাঁওয়ে ডাবের পানি ও শাঁস মেশানো কোকোনাট শ্ল্যাসও এখন বেশ জনপ্রিয়।
ইফতারে খেজুর, দুধ, বাদাম বা ফলের শরবত বানানো হয়। এই আয়োজনে আরও যুক্ত হয়েছে চিয়া সিড, ইসবগুল ও পুদিনাপাতা। মৌসুমের একেক ফলের শরবতের স্বাদেও ভিন্নতা পাওয়া যায়। বাঙ্গি, তরমুজ, আনারস, পেঁপে, আপেল,কমলার শরবতও এখন রোজাদারদের বেশ পছন্দ। এছাড়াও শরবতের পাশাপাশি মিল্ক শেক, চকলেট মিল্ক শেক, স্ট্রবেরি শেকও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলের শরবতে রয়েছে বৈচিত্র্য। বরিশাল ও খুলনার মানুষেরা ইফতারে পোলাওয়ের চাল, আখের গুড়, নারকেল বাটা দিয়ে শরবত বানান। যার নাম মলিদা শরবত। আর সিলেটের মানুষের কাছে প্রিয় হচ্ছে চিড়ার শরবত। এদিকে বগুড়ায় ইফতার আয়োজনে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে টক দই দিয়ে বানানো ঘোল।
এভাবেই সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে বৈচিত্র্য এসেছে শরবতের আয়োজনে। ভোজনরসিকরাও নিত্যনতুন শরবত পানে তৃপ্তি পেতে ছুটে যান বিভিন্ন স্থানে। ইফতার আয়োজনে এই শরবত যেন আরও অমৃত হয়ে ওঠে।