আরবি ১২ মাসের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ হচ্ছে জিলহজ মাস। এটি হজ পালনের মাস। আত্মত্যাগের মাস। পবিত্র কোরআনে এই মাসের ফজিলতের কথা বর্ণিত রয়েছে। বিশেষ করে এ মাসের প্রথম ১০ দিন প্রত্যেক মুসলমানদের কাছেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এ মাসের প্রথম ১০ রাতের কথা উল্লেখ করেছেন- ‘শপথ ফজর-কালের এবং ১০ রাতের’। (আল ফাজর : ১-২) মুফাসসিরিনদের মতে, ওই ১০ রাত বলতে জিলহজের প্রথম ১০ দিনকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
জিলহজ মাসে মুসলিম উম্মাহর বিশেষ দু’টি ইবাদত করে থাকেন। পশু কোরবানির মাধ্যমে আত্মত্যাগ করেন। আর হজ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে থাকেন। তাছাড়াও এই মাসের প্রথম ১০ দিনের আমল বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় আল্লাহ তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় ও ফজিলতপূর্ণ।
হাদিসে রাসূল সা:-জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের গুরুত্বের কথা জানিয়েছেন। ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত নবী সা: বলেছেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমলই উত্তম নয়।’ তারা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী সা: বললেন, ‘জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ছাড়া যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়েও জিহাদে যায় ও কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।’ (সহিহ বুখারি-৯৬৯)
তাই জিলহজ মাসের প্রথম ১০দিন বিশেষ কিছু আমল করলে প্রত্যেক মুসলিম বেশি নেকি লাভ করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবেন। এই সময় মুসলিমরা তাদের গুণহা মাফের জন্য়ও আমল করতে পারেন।
তাকবির ও তাসবিহ পড়া
বছরের প্রতিটা দিনই তাকবির ও তাসবিহ করা উত্তম। তবে জিলহজের প্রথম ১০ দিন তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবিহ (সুবহান আল্লাহ) পড়া সুন্নত।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এ ১০ দিনের নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পাঠ করো।’ (মুসনাদে আহমদ-৫৪৪৬)
সিয়াম পালন ও নফল ইবাদত
জিলহজের প্রথম ১০দিন সিয়াম পালন করা উত্তর। মুসলিমরা এই সময় রোজা রাখতে পারেন। আর রাতে নফল ইবাদত করতে পারেন। হাদিস শরিফে রাসূল সা: এই ১০ দিনের প্রতিটি রোজাকে পুরো বছরের রোজার সমতুল্য বলেছেন। সেই সঙ্গে রাতের নফল ইবাদতকে শবেকদরের ইবাদতের সমতুল্য বলেছেন।
আবু বকর ইবনে নাফি আল বাসরি রাহ. ... আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যে দিনসমূহের ইবাদত আল্লাহর কাছে জিলহজ মাসের ১০ দিনের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়। এর প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য। এর প্রতিটি রাতের ইবাদত লায়লাতুল কদরের ইবাদতের সমতুল্য।’ (তিরমিজি-৭৫৮, ইবনে মাজাহ-১৭২৮)
আরাফার দিনের রোজা
জিলহজের প্রথম ১০ দিন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বড় একটি কারণ হলো ইয়াওমে আরাফাহ। যা পুরো বছরের সবচেয়ে গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ দিন। হজরত কাতাদাহ রা: বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘আরাফার দিনের একটি রোজার দ্বারা পূর্বের ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায় এবং আশুরার রোজার দ্বারাও পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (তিরমিজি-১৫৭, মুসনাদে আহমদ-২২৫৩৫)
অন্যদিকে আরাফায় অবস্থানকারী হাজীদের জন্য রোজা রাখা মুস্তাহাব নয়। কেননা, মহানবী সা: রোজাবিহীন অবস্থায় আরাফায় অবস্থান করেছিলেন।
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব রহ. থেকে বর্ণিত, আয়িশা রা: বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আরাফাহ দিবসের তুলনায় এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তায়ালা সর্বাধিক লোককে দোজখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তায়ালা নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে মালায়িকার সামনে গৌরব করেন ও বলেন, তারা কী উদ্দেশে সমবেত হয়েছে (বা তারা কী চায়)?’ (সহিহ মুসলিম-৩১৭৯)
চাঁদ দেখার পর বিশেষ আমল
জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানির পশু জবাই করা পর্যন্ত কোরবানি আদায়কারীকে বিশেষ একটি আমল করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে নখ, চুল ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম কাটায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটি মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি এ নিয়ম পালন করবে, হাজীদের সঙ্গে এটুকু সাদৃশ্য গ্রহণ করায় সে সওয়াবের অধিকারী হবে।
উবাইদুল্লাহ ইবনে মুআজ আম্বারি রাহ. ... নবী এর সহধর্মিণী উম্মে সালামা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির কাছে কোরবানির পশু আছে সে যেন জিলহজের নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।’ (মুসলিম-৪৯৫৯, আবু দাউদ-২৭৮২)
তাকবিরে তাশরিক
জিলহজ মাসের পাঁচ দিন তাকবিরে তাশরিক আদায় করা আদায় করা। তাকবিরে তাশরিক হলো- `আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ অর্থ : ’আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহ জন্য।’
৯ জিলহজ ফজর নামাজের পর থেকে শুরু করে তাকবিরে তাশরিক শেষ হবে ১৩ জিলহজ আসার নামাজের পর। পাঁচ দিন ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর এটি পড়া ওয়াজিব। তাকবিরে তাশরিক পুরুষরা উচ্চ স্বরে আর নারীরা স্বশব্দে পড়বে। অর্থাৎ নারীদের তাকবিরের শব্দ যেন (গাইরে মাহরাম) অন্য লোকে না শোনে।
তাকবিরে তাশরিক নিয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করো’। (সূরা আল-বাকারা-২০৩)
হজ এবং ওমরাহ সম্পাদন করা
হজ এবং ওমরাহ পালন করা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারাস্বরূপ আর কবুল হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ (বুখারি-১৭৭৩, মুসলিম-৩৩৫৫)
কোরবানি করা
জিলহজ মাসের ১০ তম দিনে পশু কোরবানির মাধ্যমে আত্মত্যাগের কথাও বলা রয়েছে। এর ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, হজরত জায়েদ বিন আরকাম রা: থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোরবানি, ইহা কী? তিনি বললেন ‘তোমাদেন পিতা ইবরাহিম আ:-এর সুন্নত’। সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? রাসূল সা: বললেন, ‘প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে’। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ভেড়ার পশমের বিনিময়ে? রাসূল সা: বললেন, ‘ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি পাওয়া যাবে। (ইবনে মাজাহ-৩১২৭)। তাই সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিমের জন্য় কোরবানি করা ওয়াজিব।