চৈত্র সংক্রান্তি বাংলা বছরের শেষদিন। এরপরই শুরু হচ্ছে বাংলার নতুন বছর ১৪৩১ সাল। চৈত্র সংক্রান্তির আনন্দ শেষ করেই নতুন বছরকে বরণ করা হবে। ১৪ এপ্রিল বা পহেলা বৈশাখ থেকে বাংলা ক্যালেন্ডারে নতুন বছর শুরু হচ্ছে। রাজধানীরসহ সারাদেশে নানা আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করে নেবে বাঙালিরা।
বাংলার নতুন বছর বাঙালিদের জন্য বিশেষ উত্সবের দিন। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের জন্য দিনটি আরও বেশি আনন্দের। কর্মব্যস্তজীবনে নতুন হালখাতা খোলার দিন। বাংলার ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে হালখাতার দিন হিসেবেও উদযাপন করে। ব্যবসার পুরোনো হিসেব চুকিয়ে নতুন করে হিসেবের খাতা খোলাই হচ্ছে হালখাতা। যেখানে আগামী একবছরের সব হিসেব লিখে রাখা হবে। তাই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিশেষ অংশে জড়িয়ে রয়েছে এই হালখাতা।
যেভাবে এলো হালখাতা
ইতিহাস বলছে, মোঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই উদযাপন করা হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। বাংলার নতুন বছরকে বরণ করতে দিনটি উদযাপনের প্রথা শুরু হয়। সেই সময় থেকেই ব্যবসার হিসেব করার জন্য হালখাতার প্রথা চালু হয়।
হাল মানে নতুন, হালখাতা অর্থাত্ নতুন খাতা। পুরনো বছরের সব হিসেব মিটিয়ে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় নতুন খাতায় হিসেব-নিকেশ করা। মোঘল আমলে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে প্রজারা খাজনা পরিশোধ করতেন। বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন জমিদাররা। সেই থেকেই হালখাতা প্রচলন শুরু হয়।
বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই হালখাতা। নতুন বছরের হালখাতা খোলার এই দিনটি ব্যবসায়ীরা বেশ ঝাঁকজমকভাবেই উদযাপন করে। সনাতন ধর্মাম্বলীর ব্যবসায়ীরা লক্ষ্মী-গণেশের পুজো করে এই দিনে। এরপর দোকানে আসা ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান। হালখাতা মানেই রকমারি মিষ্টিভরা বাক্স আর সঙ্গে বিচিত্র সব ছবি দিয়ে সজ্জিত বাংলা ক্যালেন্ডার।
রাজধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানেই ব্যবসায়ীরা এখনও হালখাতা উত্সব পালন করেন। কিন্তু আগের থেকে এখনকার দিনে হালখাতার উদযাপন অনেকটাই কমে গেছে। এখন শুধুমাত্র, স্বর্ণব্যবসায়ীরাই হালখাতা উদযাপন করেন। আর অন্যান্য ব্যবসায়ীরা নতুন বছরে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধই রাখেন।
লাল কাপড়ে মোড়ানো বা বাঁধাই করা মোটা খাতাটিই একসময় ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার ব্যবসায়িক সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করতো। অধিকাংশ দোকানেই হালখাতা উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রণ পত্র ছাপিয়ে ক্রেতাদের দাওয়াত দেওয়া হতো। বিশেষ উপহার আর মিষ্টি খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। দিনে দিনে এই রীতি অনেকটাই বিলীনের পথে। তবে এ সময়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপণ্য কম্পিউটার দখল করে নিয়েছে এ খাতার জায়গা। এখন ডিজিটাল মার্কেটিং এবং অনলাইন শপিংয়ের রাজত্বে নতুন বছরের হালখাতার রীতি অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম নববর্ষের হালখাতর রীতি থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আগে দোকানিরা খাতায় হিসেব লিখে রাখতেন। বছর শেষে ওই খাত বন্ধ করে নতুন খাতা খোলা হত। তখনই হালখাতা উপলক্ষে বিশেষ মিষ্টিমুখের আয়োজন করতেন। কিন্তু এখন যুগ বদলাচ্ছে। খাতার হিসেব না করে এখন কম্পিউটারেই ব্যবসার হিসেব রাখেন দোকানিরা। খাতার ব্যবহারও কমে যাচ্ছে।
এদিকে নববর্ষ উপলক্ষে দোকান পরিষ্কার করে, ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হতো। ব্যবসার উন্নতির উদ্দেশ্যে দোকানে দোকানে লক্ষ্মী গণেশের পুজো করা হতো। হালখাতা খোলার আগে মন্দিরে নিয়ে পুজো করানো হতো। খাতার প্রথম পাতায় সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ব এঁকে দিতেন পুরোহিতরা। সনাতন হিন্দুধর্মে স্বস্তিক চিহ্ন বিশেষ মঙ্গল বার্তা বহন করে। তাই যে কোনও পুজো বা শুভ অনুষ্ঠানে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক এঁকে দেওয়া হয়। এরপরই দোকানে ক্রেতাদের অপেক্ষায় থাকতেন ব্যবসায়ীরা। যে ক্রেতারাই দোকানে আসতেন তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।
বর্তমান সময়ের ব্যবসায়ীরা জানান, ঐতিহ্যের চিরচেনা হাতে লেখা খাতার ব্যবহার এখন বেশি দেখা যায় না। এখন কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার হিসাব রাখা হয়। ক্যাশিয়ারের পাশে থাকা চিরচেনা লাল কাপড় কিংবা কাগজে মোড়ানো হিসাবের হালখাতার বইটিও এখন আর চোখে পড়ে না।