নাটক বা সিনেমায় প্রেমিক যখন প্রেমিকার রূপের প্রশংসা করেন, তখন চোখে চোখ রেখেই মনের কথা প্রকাশ করেন। প্রশংসা বাক্য শুরুও হয় চোখ থেকেই। নব্বই দশকে টিভি বা সিনেমা পর্দায় এমনটি দেখা যেত। প্রেমিকার প্রশংসার সংলাপে কাজল চোখের বর্ণনা পাওয়া যেত। নায়িকার কাজল চোখের প্রেমে পড়েই শুরু হতো কাহিণী।
সিনেমা পর্দায় শুধু নয়, কাজল চোখের প্রেমে পড়েছেন কবি সাহিত্যিকরাও। নারীর কাজল কালো চোখের প্রশংসা পাওয়া গেছে বিভিন্ন কবির কবিতায় কিংবা সাহিত্যের পাতায়। কাব্যিক বাক্যে যেন নারীর কাজল চোখের প্রশংসায় পুরো সৌন্দর্যই ফুটে উঠতো।
নারীর সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ চোখ। সেই চোখে কাজলের ছোঁয়া পড়লে যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠে। কাজল প্রসাধনীর অন্যতম একটি। বরং অনেকে তো কাজলকে প্রসাধনী মানতেও রাজী নন। তাদের কাছে কাজল হচ্ছে বেসিক চাহিদা। যা প্রতিটি নারীর প্রতিদিনের সঙ্গী।
কর্মব্যস্ত নারী হোক কিংবা ঘরের গৃহিণী কাজল চোখেই নিজেকে দেখতে ভালোবাসেন। কোথাও বের হচ্ছেন, চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের ছোয়া তো থাকেই। মেয়েদের হাতব্যাগে অন্য প্রসাধনী থাকুক বা না থাকুক কাজল তো থাকবেই।
প্রিয় কাজলের চল কীভাবে এসেছে এটা কমবেশি সবারই জানা। যুগ যুগ আগ থেকেই নারীদের সাজ বলতেই ছিল এই কাজল। ওই সময় ঘরেই তামা পাত্রে পেতে নেওয়া হতো কাজল। সুতি কাপড়ের লম্বা ছোট একটা টুকরো পেঁচিয়ে ঘিয়ে ভেজানো হতো। এর এক অংশ বাইরে রেখে তাতে জ্বালানো হতো আগুন। তারপর একটা তামা পাত্র রশ্মির ওপর ধরে কালি জমানো হতো। সেই কালির ওপর সামান্য পরিমাণে তেল (কর্পূর, সরষে কিংবা নারকেল তেল) আর চন্দন মিশিয়ে তৈরি করা হতো কাজল। এরপর একটা কাপড়ের টুকরো ভাঁজ করে চিকন করে অথবা তুলা পেঁচিয়ে (কটনবাডের মতো করে) সেই কাজল চোখে লাগনো হতো।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পূর্বে পুরুষরাও কাজল বা সুরমা চোখের চারপাশে (ওপরে ও নিচের অংশে) ব্যবহার করতেন। কারণ এটি চোখের আশপাশকে ঠান্ডা রাখত। গরমের সময় চোখকে প্রশান্তি দিতেই এটি ব্যবহার হতো বেশি। ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। গোটা বিশ্বে নারীদের মেকআপের প্রধান প্রসাধনীর জায়গা করে নিয়েছে এই কাজল।
এখনও‘নজরটিকা’ হিসেবে কাজলের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। আগে ধারণা করা হতো, কপালের কালো কাজল শিশুকে সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। তবে এরপর এটি রীতিমতো নিয়ম হয়ে দাড়ায়। ধীরে ধীরে কাজল ব্যবহার হওয়া শুরু হয় সন্তানকে ‘খারাপ নজর থেকে রক্ষা করতে। যা এখনও প্রচলিত রয়েছে।
অনেক ঘটা করে কাজল তৈরি করার প্রচলন এখন নেই বললেই চলে। কারণ চুড়ি-ফিতার দোকান হোক বা কোনো মেকআপের ব্র্যান্ডের দোকানে গেলেই কাজল পাওয়া যাবে। এমনকি বাচ্চাদের নজর টিপ দেওয়ার জন্যও মিলবে কয়েক ধরণের কাজল।
ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, নারীদের প্রিয় কাজল নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরৗক্ষা চলেছে ১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত। ওই সময় মেকআপ বিশ্বে আলোড়ন ফেলে ‘স্মোকি আই’। যা এখনও ফ্যাশন দুনিয়ার অন্যতম মেকআপ টেকনিক। তবে ওই সময় নারীরা ভিন্নভাবে স্মোকি আই করতেন। তারা আগের রাতে কাজল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। সারা রাত কাজল ‘স্ক্যাটার্ড’ হয়ে সুন্দর করে ছড়িয়ে পড়ত চোখের ওপরে আর নিচের অংশে। পরদিন সেই কাজলের সাজ অক্ষুণ্ন রেখেই তৈরি হয়ে অনুষ্ঠানে যেতেন। এমনকি বিয়ের আগের রাতেও কনের চোখে মোটা করে কাজল পরার চল ছিল। বিয়ের দিন চোখকে সুন্দর দেখাতে এভাবেই করা হতো ‘স্মোকি আই’।
জানেন কি, চোখের ওপরের পাতায় কাজল ছড়িয়ে দেওয়া হতো ওই সময়। যা থেকে প্রচলন আসে চোখের ওপরের পাতা আইশ্যাডোর ব্যবহারের।
ষাটের দশকে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ড্রামাটিক ক্যাট আই। ওই সময় সিনেমার নায়িকা থেকে শুরু করে সাধারণ নারীরাও কাজল লাইনার দিয়ে ক্যাট আই একে নিতেন চোখের পাতায়। এরপর নব্বইয়ের দশকে এসে স্টাইলে একটু পাল্টে যায়। কাজল বা আইলাইনার কেবল চোখের ওপরের পাতায় লাগানো হয়। ওই সময় এই স্টাইলই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আর বর্তমানে সব স্টাইলেরই চল রয়েছে। নিজের পছন্দমতোই কাজলের ব্যবহার করছে মেয়েরা। পোশাকের সঙ্গে সাজের সামঞ্জস্য রাখতে কখনো করছেন ক্যাট আই, আবার কখনো করছেন স্মোকি। আবার একদম সাধারণ লুকেও কাজল ব্যবহার করছেন অনেকে।
এভাবেই মেকআপ দুনিয়ায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে এসেছে কাজল। সেই কাজল তৈরি করে এখন হাজার কোটি টাকা লাভবান হচ্ছে বিশ্বখ্যাত ইন্ডাস্ট্রিগুলো। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও কালার কসমেটিকের (কাজল, লিপস্টিক, লিপগ্লস, আইশ্যাডো ইত্যাদি) মার্কেটের ২৫ শতাংশ কাজলের দখলে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি ‘ভোগ ইন্ডিয়া’র প্রতিবেদনে জানায়, ২০১০ থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে গড়ে প্রতিবছর ২৯ শতাংশ করে বেড়েছে কাজল ইন্ডাস্ট্রি। ২০১০ সালে ভারতে কাজল ছিল মাত্র ২৫০ কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। ২০১৫ সালে তা প্রায় ৯০০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে। আর এখন কাজল ভারতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি।
দেশের বাজারেও এখন ব্যতীক্রম হবে না। কারণ বাঙালি নারীদের মেকআপের প্রথম পছন্দই কাজল। শুধু কালো নয়, ভিন্ন ভিন্ন রঙের কাজল আর আইলাইনার পাওয়া যাচ্ছে দেশের বাজারে। যা নারীদের আরও আকৃষ্ট করছে। ফ্যাশন ট্রেন্ডে রঙিন কাজলের ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। তাই বলাবাহুল্য দেশের বাজারে কাজল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কোনো সমীক্ষা না থাকলেও কাজলের চাহিদা দেখেই বোঝা যায় লাভের মাত্রা কতটা হতে পারে।