গ্রে ডিভোর্স মানে ‘বয়স-উত্তীর্ণ বিবাহ বিচ্ছেদ’। বয়স ৫০-এর পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তার নামই গ্রে ডিভোর্স। সম্প্রতি সময়ে এই ডিভোর্সের চর্চা হচ্ছে সর্বত্র। কারণ বিশ্বের অন্যতম ধনী বিল গেটস, বিখ্যাত মিউজিসিয়ান এআর রহমানসহ আরও নামী-দামী তারকারা তাদের দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনেছেন ৫০ এর পরেই। বিশ্বের নজর আটকে যায় ওইসব ঘটনায়। অবাক হয়ে যান ভক্তরা। বিয়ের এত বছর পার করে কেনই বা ডিভোর্সের পথে হাটলেন এই দম্পতিরা। নানা প্রশ্ন ভাবিয়ে তোলে ভক্তদের মনে।
গ্রে ডিভোর্স সাধারণত মাঝবয়সী বা বয়স্ক যুগলের মধ্যেই ঘটে থাকে। দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটানোর পর নিজেদের তরুণ বয়স শেষ করে বিবাহ বিচ্ছেদের পথ বেছে নেন অনেক দম্পতি। সম্প্রতি গ্রে ডিভোর্সের প্রবণতা বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সামাজিক পরিবর্তনগুলোর কারণেই অধিকাংশ ডিভোর্স হচ্ছে। এর মধ্যে মতের অমিল, আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়া, কারো ওপর নির্ভরশীল না হওয়া, বৈবাহিক জীবনের প্রত্যাশা অপূরণ থেকে যাওয়াসহ অনেক কারণই থাকে। দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনের ইতি টানলে পরিবারের অন্যান্যদের ওপরও মানসিক প্রভাব পড়ে। সমাজে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। জীবনের গতিপথ বদলে যায়। যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নেতিবাচক হতে পারে।
গ্রে ডিভোর্স কেন হয়
বৈবাহিক অমিল
দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার পর অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অমিল তৈরি হয়। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা কমে যাওয়ায় সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। ৫০ বছর বয়সের পর, মানুষ অনেক সময় নিজেকে খুঁজে পেতে চায় এবং নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন দেখার চেষ্টা করে। এই পরিবর্তনগুলো মাঝে মাঝে একটি সম্পর্কের মধ্যে অমিল সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
বাচ্চাদের পেছনে মনোযোগ
অনেক প্রতিষ্ঠিত দম্পতি রয়েছেন, যারা নিজেদের সন্তানদের বড় করার জন্য একে অপরের সঙ্গে থাকতে বাধ্য ছিলেন। তাদের সন্তানরা বড় হয়ে গেলে সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তন ঘটে। কারণ তাদের সন্তানেরা বাবা-মায়ের জীবন থেকে দূরে চলে যায়। ঠিক সেই সময় বাবা-মায়েরা একাকী হয়ে পড়েন। তারা বুঝতে পারেন, তাদের মধ্যে কোনো মিল আর অবশিষ্ট নেই। একসঙ্গে থাকারও আর কোনো কারণ নেই। এতে সম্পর্ক শিথিল হয়ে যায়। অবশেষে বিচ্ছেদের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
গ্রে ডিভোর্সের অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। বিশেষত নারী-পুরুষ উভয়েই যদি পেশাগতভাবে সফল হন এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হন, তাহলে তারা সম্পর্কের জটিলতা কাটিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা চাইতে পারেন। পুরোনো যুগে যেখানে অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল, সেখানে বর্তমানে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি নিজের আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ নিতে পিছপা হন না।
স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত পরির্বতন
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যের সমস্যা হতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো একে অপরের প্রতি সহানুভূতি বা প্রেমের অনুভূতি কমিয়ে দিতে পারে। অন্যদিকে একে অপরের প্রতি শারীরিক বা মানসিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। অনেক সময়, বয়সের কারণে নিজের ব্যক্তিগত সুখ এবং স্বাধীনতার প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
সামাজিক পরিবর্তন
বর্তমানে সমাজে বিয়ের পর বিচ্ছেদকে নেতিবাচক ভাবনা হিসাবে দেখা হয় না। বিশেষত উন্নত দেশগুলোর মধ্যে, ৫০ বছরের পরেও যদি কেউ নিজের জীবন নতুনভাবে সাজাতে চায়, তবে সে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অনেক সামাজিক কাঠামো এবং সংস্কৃতিগত পরিবর্তন এই প্রক্রিয়াকে সহজতর করেছে।
গ্রে ডিভোর্সের কারণে যে প্রভাব পড়ে
মানসিক প্রভাব
গ্রে ডিভোর্সের পরে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি মানসিক দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং একাকীত্বের শিকার হন। দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকার পর, জীবনের এই নতুন অধ্যায় মেনে নেওয়া তাদের জন্য সহজ হতে পারে না। বিশেষত যদি তারা একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে চলেন। তবে বিচ্ছেদের পর একাকী অনুভূতি তাদের মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
পারিবারিক প্রভাব
বয়স্ক দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ তাদের সন্তানদের জন্যও কঠিন হতে পারে। যদিও সন্তানেরা বড় হয়ে যায় এবং তাদের জীবনযাত্রা আলাদা হয়ে যায়। তবুও তারা বাবা-মায়ের সম্পর্কের বিচ্ছেদে প্রভাবিত হতে পারে। এই সময় সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে বা তারা তাদের বাবা-মায়ের প্রতি ক্ষোভ বা দুঃখের অনুভূতি অনুভব করতে পারে। অনেক সময় সম্পর্কের বিচ্ছেদের ফলে সন্তানদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে যারা বিবাহিত জীবনের স্থিতিশীলতার দিকে লক্ষ্য রাখেন।
আর্থিক প্রভাব
গ্রে ডিভোর্সের কারণে অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক সংকট তৈরি হতে পারে। বিশেষত যদি এক বা উভয় পক্ষের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে তাদের জীবনযাত্রা প্রভাবিত হতে পারে। সেভিংস এবং সম্পত্তি ভাগাভাগি করার বিষয়গুলো আইনি জটিলতা তৈরি করতে পারে। এছাড়া পেনশন এবং বীমা বিষয়ক সমস্যা তৈরি হতে পারে। যা আর্থিক সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।
সামাজিক প্রভাব
গ্রে ডিভোর্স সমাজে এক ধরনের পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। আগেরদিনে সমাজে বয়স্ক যুগলের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ একটি বিরল ঘটনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি সাধারণ বিষয়। সামাজিক মনোভাব বদলানোর ফলে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি নিজেদের জন্য নতুন জীবন শুরু করতে উৎসাহিত হন। তবে কিছু সমাজে এখনও বিচ্ছেদকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়।, যার ফলে কিছু লোক সামাজিক বিচার-প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন।
গ্রে ডিভোর্সের প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সীমাবদ্ধ নয়, এটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্তরেও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। তাই মধ্য বয়সে বা বয়স্ক অবস্থায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। যার সমাধান করতে, সঠিক পরামর্শ এবং সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌথ পরিবারের কাঠামো ভেঙে যে নিউক্লিয়াস থেকে নিউক্লিয়াসতর পরিবারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সমাজ তার প্রভাবও পড়ছে যৌথ জীবনের ক্ষেত্রে। তাই গ্রে ডিভোর্সের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর হতে পারে সঠিক কাউন্সিলিং। সম্পর্কের শুরু থেকেই আর্থিক পরিকল্পনা আর বোঝাপড়া দরকার। কোনো বিচ্ছেদই কাঙ্ক্ষিত হয়। সেখানে গ্রে ডিভোর্সের বাড়াবাড়িতে বেশ চিন্তিত সমাজের বিশিষ্টজনরা।