প্রাচীনকাল থেকেই ডিসেম্বর জুড়ে পালিত হয় যেসব উৎসব


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪, ০৯:২৬ পিএম
প্রাচীনকাল থেকেই ডিসেম্বর জুড়ে পালিত হয় যেসব উৎসব

ডিসেম্বর বছরের শেষ মাস। এই মাসের গুরুত্ব থাকে বিশ্বজুড়ে। খিষ্ট্রান ধর্মাম্বলীদের বড় উত্সব ক্রিসমাস বা বড়দিনও এই মাসেই। যা বিশ্বজুড়ে বেশ ঘটা করেই পালিত হয়। তাই ডিসেম্বর মাস মানেই উত্সবমুখব বিশ্ব।

ডিসেম্বর মাসে উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি দেশে শীতকালীন অয়নকাল থাকে। আর দক্ষিণ গোলার্ধে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণের অংশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকায় থাকে গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল। উত্তর গোলার্ধে এই সময় দিনের আলো সবচেয়ে কম স্থায়ী হয়। আর দক্ষিণ গোলার্ধে দিনের আলো থাকে বেশি সময়। তবে ঋতুভেদে পার্থক্য থাকলেও ডিসেম্বরের উত্সব উদযাপনে কিন্তু পিছিয়ে থাকে না কোনো দেশই। বরং একেক দেশে একেক রীতিতে উদযাপিত হয় ডিসেম্বরের উৎসব। চলুন জেনে আসি, ডিসেম্বর জুড়ে বিশ্বের কোন কোন দেশে কী কী উত্সব উদযাপন হয়।

চীনের ডংঝি উৎসব

ডংঝি একটি চীনা উৎসব। এর অর্থ "শীতের আগমন"। এই উৎসবের উদ্ভব ঘটে হান রাজবংশের সময়কাল থেকেই। শীতকালীন অয়নকালের প্রথম দিন থেকে পরবর্তী ১৫ দিন ধরে চলে এই উৎসব। যা চীনের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ইয়িন এবং ইয়াং ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রীতি এবং ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে উৎসবটি উদযাপন হয়। দিন ছোট হলে ইয়াং শক্তি অর্থাৎ উষ্ণতার ঘাটতি দেখা দেয়। তাই ডংঝিতে, চীনারা ইয়াং জাতীয় খাবার অর্থাৎ গরম খাবার খান। এই খাবারের মধ্যে থাকে ট্যাংইউয়ান নামে আঠালো চালের বল জাতীয় খাবার। যা পুনর্মিলন এবং সমৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করা হয়। আরও থাকে চালের ময়ানে মোড়ানো মাংসের ডাম্পলিং। মাটন স্টু বা ভেড়ার মাংসের স্যুপ এবং বাবাও পরিজ। বাবাও পরিজ বীজ, বাদাম এবং শুকনো ফল দিয়ে তৈরি করা হয়।

ইরানের ইয়ালদা উৎসব

ইয়ালদা হলো পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো উৎসব। এটি শাব-ই ইয়ালদা বা জায়েশমেহর নামেও পরিচিত। এটি শীতকালীন অয়নকালের শুরুর দিকে উদযাপন হয়। যা ইরানি ক্যালেন্ডারে শীতের প্রথম দিন। ইয়ালদা নামটি পুরোনো সিরিয়াক শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ "জন্ম"। প্রাচীন পারস্যের জরথুস্ট্রবাদ ধর্মে, সূর্যদেবতা মিথ্রার পুনর্জন্ম পালনে এই উৎসব উদযাপন হয়। মিথ্রা পৃথিবীতে আলো, মঙ্গল এবং শক্তির প্রতীক। উৎসবটি জরথুস্ট্রবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য একটি ধর্ম, মিথ্রাইজম থেকে গ্রহণ করা হয়। ইসলামের আগের পারস্যে এই উত্সবটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইরানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জরথুস্ট্রবাদীরা এখনও এই উত্সব উদযাপন করে। এই উৎসবে বিভিন্ন ধরণের উপহার দেওয়া, গাছপালা দিয়ে ঘর সাজানোর রীতি ছিল। এমনকি এই উত্সব উপলক্ষে একদিনের জন্য দাসদের প্রভু বানানো হতো। পরবর্তী সময়ে রোমানরা শীতকালীন অয়নকালের উৎসব স্যাটার্নালিয়া পালনে এই প্রথাগুলো গ্রহণ করে। যা ক্রিসমাসের ঐতিহ্যেও যুক্ত হয়।

 

পেরু ও ইকুয়েডরের কাপক রাইমি উৎসব

কাপক রাইমি উৎসবটি পালিত হয় পেরু এবং ইকুয়েডরে। এসব দেশের কিছু মানুষ এই উৎসব উদযাপন করে। কাপক রাইমি অর্থ ‍‍`রাজ ভোজ‍‍`। এই উৎসবের উদ্ভব ঘটে ইনকা সাম্রাজ্যের সময়কালে। ইনকারা দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একটি বড় অংশ। তারা ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে। ওই সময় এই উৎসব সূর্যদেবতা ইন্তির সম্মানে উদযাপন করা হতো। এই উৎসব শীতকালীন অয়নকালে উদযাপিত হতো। যা ইনকা নববর্ষের প্রথম দিন। ডিসেম্বরের ২১ তারিখের আশপাশের সপ্তাহগুলোতেই পালিত হতো এই উৎসব। পশু বলি দেওয়া, চিচা দে জোরা (ভুট্টার বিয়ার) পান করা, কোকা পাতা চিবিয়ে খাওয়া এবং নাচের মাধ্যমে কাপক রাইমি উৎসব উদযাপন হতো। পশু বলির পর ছাই সংগ্রহ করে তা  নদীতে ফেলা হতো। কারণ সেই ছাই সৃষ্টির দেবতা বিরাকোচাকে উৎসর্গ করা হতো। এই সময় তরুণদের ইনকা সাম্রাজ্যের যোদ্ধা হিসেবে দীক্ষাও দেওয়া হতো। শুধু তাই নয়, ৭ বছর বয়সী বালকদের প্রথমবারের মতো ট্রাউজার বা ফুল প্যান্টস উপহার দেওয়া হতো। আর মেয়েদের দেওয়া হতো ফিতা বা চুল সাজানোর  অলঙ্কার। এই বয়সেই বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তবে রাজকীয় পরিবারের ছেলেরা কানের দুল পেত। যা রাজ বংশের প্রতীক হতো। উত্সবের এই অংশকে ওয়ারাচিকুয়ি বলা হতো।

এদিকে গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরের মাসে কাপক রাইমি কামাই কুইল্লা উদযাপন করতেন ইনকারা। যা ছিল চাঁদের উৎসব। ইন্তি ছিল তাদের সূর্যদেবতা। আর তেমনি কুইল্লা তাদের চন্দ্রদেবী। গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরে নতুন চাঁদ ওঠা পর্যন্ত এর উদযাপন হতো।

আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম-ফসল উৎসব

আফ্রিকার দক্ষিণে অধিকাংশ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল পালন করা হয় প্রথম-ফসল উৎসব হিসেবে। ফসল কাটার ঋতু শুরুর সময় এটি। এই উৎসবটি একেক সম্প্রদায়ের কাছে একেক নামে পরিচিত। যেমন ভাকা সম্প্রদায়ের কাছে ইংকুবে, নেডেবেলে সম্প্রদায়ের কাছে ইনক্সওয়ালা, সোয়াজি সম্প্রদায়ের কাছে ইনকওয়ালা, এবং জুলু সম্প্রদায়ের কাছে উমখোসি ওকওয়েশওয়ামা নামে পরিচিত এই উত্সব। পরিবারের প্রধান বছরের প্রথম ফসলের স্বাদ গ্রহণ করেন। এরপরই পরিবার অন্যরা ফসল খাওয়ার অনুমতি পান। এক্ষেত্রে জাতির শাসক প্রথম ফসল আস্বাদন করে থাকেন। এরপর পশু বলি দেওয়া হয় এবং শাসক একটি কলাবশ (বুনো লাউ) থেঁতলে দেন। এরপরই প্রজারা ফসলের স্বাদ ভোগ করতে পারেন। তবে ১৮৭৯ সালে জুলুদের সঙ্গে যুদ্ধ হলে ভূখণ্ড দখলের পর উৎসবটি নিষিদ্ধ হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালে জুলু জাতির রাজা গুডউইল জুয়েলিথিনি এই উৎসব পুনরায় চালু করেন। সেই সময় থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার নোঙ্গোমার এনয়োকেনি রাজপ্রাসাদে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর। উৎসবটি ছয় দিন ধরে উদযাপন হয়। রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যোদ্ধারা তার জমির আগাছা পরিষ্কার করে। তাদের বিশ্বাস, প্রথম ফসলের উৎসবে আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং কোনো কিছু নতুন করে শুরু করার সময়।

আফ্রো আমেরিকানদের আধুনিক উৎসব ‍‍`কোয়ানজা‍‍`-র উদ্ভব ঘটে ওই প্রাচীন উৎসব থেকেই। তারা প্রতিবছর ২৬ ডিসেম্বর থেকে নতুন বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত এই উৎসব উদযাপন করেন। "কোয়ানজা" মানে "প্রথম ফসল"। ১৯৬৬ সালে এই উত্সবটি ধারণা প্রথম দেন ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক মাওলানা রন কারেঙ্গা।

 

সূত্র: বিবিসি

Link copied!