• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

একসঙ্গে কি দুজনকে ভালোবাসা যায়


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২৪, ০৯:৩০ এএম
একসঙ্গে কি দুজনকে ভালোবাসা যায়

মাধবী (ছদ্মনাম) বন্ধুত্ব সম্পর্কে গোপনে বিয়ে করেছিলেন প্রবাসী শফিককে। ফোনে চার বছরের সম্পর্ক তার। দুই বছর আগে স্বামী মারা যাওয়া সংসারে আছে তার তিনটি সন্তানও। কিন্তু হঠাৎ করেই তার ভালো লাগতে শুরু করল এক বছরের ছোট চুপচাপ স্বভাবের ইউসুফকে।

মাধবীর মনে হতে থাকল, ঠিক এমন একটি ছেলেকেই খুঁজছিলেন জীবনে। তবে তিনি শফিককেও ভালোবাসেন। তার মতে, দুজনকেই তিনি ভালোবাসেন এবং সম্মান করেন। কাউকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ।

পরে মাধবী শফিককে হারানোর ভয়ে ইউসুফকে ছেড়ে দেন। 

অনেকেই বলেন প্রেম স্বর্গীয়। তবে প্রেমের সম্পর্ক যতটা মধুর, ঠিক ততটাই জটিল। সাধারণত মন দেওয়া-নেওয়ার এই সম্পর্কটি একজনের সঙ্গে হয়ে থাকে। তবে একজনের সঙ্গে সম্পর্কে থাকাকালীন আরেকজনের প্রতিও ভালোবাসা অনুভব করা মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।

একাধিক নারী বা পুরুষসঙ্গ নিয়ে সিনেমা, সিরিয়াল কম হয় না। তবে বাস্তবেও যে এরকম ঘটনা ঘটে না, এমন নয়। অনেককেই আমরা বলতে শুনি, ‘আমি একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসি’। আর সেই কথাশুনে আমরা ধরেই নেই যে, এরকম একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসছে তার চরিত্রগত সমস্যা রয়েছে।

এই যে একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে থাকাকালীন আরেকজনকে ভালোবাসা বা তার প্রতিও প্রেম অনুভূত হওয়ার বিষয়টি, এটি কি স্বাভাবিক? অদ্ভুত এ অনুভূতির নাম কী? কেন হয় এমনটা?

মনোবিদরা মনে করেন,  একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসাতে কোনো ভুল নেই। 

তাদের মতে, ভালোবাসা অনেকটা প্রিয় খাবারের মতো। চকোলেট এবং স্ট্রবেরি দুটোই খেতে আলাদা, কিন্তু স্বাদে অপূর্ব। তাহলে যে চকোলেট ভালোবাসে সেকি স্ট্রবেরি খাবে না? 

প্রেম ও আকর্ষণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মনোবিদরা বলেন, ‘‘আকর্ষণ অত্যন্ত জৈবিক এক অভিজ্ঞতা”।  

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হয় এসব প্রশ্নের উত্তর।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক  থাকাকালীন অন্যের প্রতি ভালোবাসা অনুভূত হওয়া বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘পলিঅ্যামোরি’। এক্ষেত্রে ব্যক্তির একাধিক জনের প্রতি সমান অনুভূতি কাজ করবে। তিনি মনে করতে থাকবেন, তিনি এই একাধিক জনকেই ভালোবাসেন, সম্মান করেন এবং কাউকেই ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পলিঅ্যামোরির ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্ক মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে না, হৃদয়ঘটিত অনুভূতিটাই মুখ্য। ব্যক্তি যখন তার সঙ্গীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভালোবাসা না পান, তখন তিনি অন্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং সেটিও একসময় প্রেমের সম্পর্কে  মোড় নেয়।

নারী-পুরুষ দুজনের ক্ষেত্রেই পলিঅ্যামোরি দেখা যেতে পারে। পলিঅ্যামোরিকে অনেকেই পরকীয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। পরকীয়ার সঙ্গে এর মূল পার্থক্য হলো, পরকীয়ায় হয়তো একজনকেই ভালোবাসা হয় আর পলিঅ্যামোরিতে দুজনকেই ব্যক্তি ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন। এই সমস্যার ক্ষেত্রে নেই কোনো লিঙ্গ, নেই কোনো বয়স।

কিছু মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, মূলত একাকীত্ব, সঙ্গীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব থেকে পলিঅ্যামোরি দেখা দেয়। এই মানসিক একাকীত্ব মধ্যবয়সে দেখা দিতে পারে। তাই মধ্যবয়সে পলিঅ্যামোরির সম্মুখীন হওয়ার হার বেশি। বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত সবার মধ্যেই এটি দেখা দিতে পারে।

এই বিষয়টি স্বাভাবিক কি না প্রশ্ন করা হলে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “প্রথমত এটি আমাদের এখানে সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে আপনার সঙ্গীদেরকে ঠকানো হয়, যা নৈতিকভাবেও ঠিক নয়। তবে কখন কার প্রতি ভালোবাসা অনুভূত হয় সেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। সবার মানসিক জোর একরকম না থাকার কারণে একটি সম্পর্কে থেকে অপর একটি সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে লুকিয়ে সম্পর্কগুলো জিইয়ে রাখতে হয়।

এই অনুভূতি আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারে। শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভেঙে যায় সম্পর্ক। যদি এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যান তবে নিজেকে প্রশ্ন করুন যদি আপনার সঙ্গীরা জানতে পারেন তবে কী ফলাফল হবে, সামাজিকভাবে আপনার গ্রহণযোগ্যতা কতখানি থাকবে।”

হেলাল উদ্দিন আহমেদের পরামর্শ, “অনেকে নিজের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। হয়তো বলতে পারেন ভালোবাসার ওপর তো আর হাত নেই কারো। একটি সম্পর্কে থেকে অন্য কাউকে পছন্দ করা শুরু করতেই পারেন। তবে এটি স্বাভাবিক হিসেবে না নেওয়াই শ্রেয়। একই সময়ে একাধিক জনকে মনে জায়গা দেওয়ার বিষয়ে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “অনেকে পলিঅ্যামোরিতে ভুগছেন তা বুঝতেই পারেন না। তবে যতদিনে বুঝতে পারেন ততদিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়। মনোজগতের পরিবর্তনে কখন, কোন কারণে, কার প্রতি কী অনুভূতি আসে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে এর ফলাফল জীবনকে করে তোলে বিপর্যস্ত।”

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে, “এটি সমাধানযোগ্য মানসিক সমস্যা। পলিঅ্যামোরির লক্ষণ নিজের মধ্যে দেখলে একজন মনোরোগ কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হতে পারেন। অন্যান্য মানসিক রোগের মতো এ সমস্যার কোনো ওষুধ নেই। তবে সঠিক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব অনেকখানি। যদি আপনার সঙ্গী বা পরিচিত কারো মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয় তবে তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন।”
 

Link copied!