অপরাধ করলে শাস্তি হবে-এটাই বিশ্বের সব দেশের নিয়ম। আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে শাস্তির বিধান করা হয়। অপরাধ অনুযায়ী অপরাধীকে শাস্তি পেতে হয়। অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অপরাধীর অপরাধের তুলনায় বেশি শাস্তি হলে তা অমানবিক বলে গণ্য হয়।
সাধারণত অপরাধীকে কারাবন্দী করে শাস্তি দেওয়ার রীতি রয়েছে বিশ্বের সব দেশে। কারাবন্দী অবস্থায় অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয় কোনো কোনো কারাগারে। আবার কোনো কারাগারের অমানবিক নির্যাতন আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে অপরাধীকে সম্মুখীন হতে হয় কঠিন থেকে কঠিনতম পরিস্থিতির। অথচ আধুনিককালে কারাগারের নতুন নাম দেওয়া হচ্ছে ‘সংশোধনাগার’। যেখানে অপরাধীরা খারাপ কর্মের জন্য শাস্তি পাবে, আর সেই সঙ্গে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পাবে। তবে বিশ্বের কিছু দেশে কারাগারের বাস্তবিক চিত্র একেবারেই উল্টো। যা রীতিমতো মানবাধিকার বিবর্জিত। যেখানে থেকে অপরাধীরা সংশোধিত হন না, বরং পুনরায় অপরাধের দুনিয়ায় ফিরে যান কিংবা কারাগারের ভেতরেই অপরাধমূলক কাজ করতেই থাকেন, আবার কেউ কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে নিজের আত্মহুতিও দেন। এমন অমানবিক কারাগারের তালিকায় রয়েছে বিশ্বের ৫টি কারাগার। জানেন কি, বিশ্বের কোন কোন দেশে এর অবস্থান?
সাবানেতা কারাগার
সাবানেতা কারাগার ভেনেজুয়েলায় অবস্থিত। দেশটি সরকারবিরোধী আন্দোলন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য আগে থেকেই চর্চায় ছিল। ২০১৯ সালে বিশ্ব গণমাধ্যমে দেশটির বিভিন্ন খবর ছিল শিরোনামে। ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় জানা যায়, বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটে এই দেশেই। কারণ দেশটির শতকরা ৮০ ভাগ কারাগারই রয়েছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যা পরিচালনার ক্ষমতা রয়েছে সশস্ত্র কারাবন্দীদের কাছেই। এমনই এক জায়গা হচ্ছে সাবানেতা কারাগার। যার পরিস্থিতি ভয়ংকর বলে বিশ্ব গণমাধ্যমে জানা যায়। এই কারাগারে মাত্র ৭০০ জন বন্দীর ধারণক্ষমতা রয়েছে। অথচ সেখানে বন্দী রয়েছেন ৩,৭০০’র বেশি। শুধু তাই নয়, বন্দীর তুলনায় কারারক্ষীর সংখ্যা অত্যন্ত কম। প্রতি ১৫০ জন বন্দীর বিপরীতে মাত্র ১ জন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। তাই সেই কারাগারে মারামারি, রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে নিত্যদিনই। বন্দীদের লড়াইয়ে খুনোখুনি হয়ে গেলেও কারারক্ষীদের ভূমিকা থাকে নিরব। এই কারাগারে একাধিক শক্তিশালী অস্ত্রধারী গ্যাং রয়েছে। যাদের হাতেই রয়েছে পুরো কারাগারের নিয়ন্ত্রণ। তারা নতুন বন্দীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করেন। আদেশ পালন না করলে মারধর করেন। সমকক্ষ দুই গ্যাং রয়েছে, যারা নতুন বন্দীদের দলে নেওয়ার চেষ্টায় দাঙ্গা, মারমারি করেই যায়। ১৯৯৪ সালে এমনই এক ঘটনা ঘটে। ওই সময় বন্দীদের দাঙ্গার ঘটনায় ১০৮ জন বন্দী নিহত হন। কারাগারের ভেতর অনিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি যেন জীবন্ত নরকের চিত্র।
রিকার্স আইল্যান্ড
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে অনেকটাই উন্নত। কিন্তু এখানেও রয়েছে ভয়ংকরতম কারাগার। রিকার্স আইল্যান্ড দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম কারাগার। অল্প মেয়াদে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত অর্থাত্ ১ বছরের কম মেয়াদে সাজা পাওয়া আসামিরা এবং বিচারকার্য চলছে এরকম আসামিদের এই কারাগারে রাখা হয়। ছোটোখাট অপরাধে অভিযুক্ত হলেও কারাগারের নির্মম পরিবেশের কারণে অনেক অপরাধীকে বেশি সময় সাজা ভোগ করতে হয়। এই কারাগারের ভয়াবহ দিক হলো, হিংস্র পুলিশ অফিসার ও কারারক্ষীরা। এরা বন্দীদের ওপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। কালিফ ব্রাউডারের উপর নির্যাতন রিকার্স আইল্যান্ডের সবচেয়ে হিংস্র ঘটনা। ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ফাঁস হয়। এরপরই তীব্র সমালোচনায় পড়ে কারাগারটি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে কালিফ ব্রাউডারকে কারাগারে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান ছিল। কারাগারে থাকাকালীন কারারক্ষীরাসহ আসামিদের গ্যাং ব্রাউডারের ওপর নির্যাতন চালায়। যার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ পায়। ১ বছর নিমর্ম নির্যাতনের পর তাকে নির্জন কারাবাসেও থাকতে হয়। দুই বছর সেখানে থাকেন এবং কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। অবশেষে চলমান মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু বিনা অপরাধে কালিফ ব্রাউডার নির্যাতন সহ্য করেন। ২০০৯ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর প্রতিবেদনে জানা যায়, মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে কারাকর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ৭টি শারীরিক নির্যাতনের মামলা করেছে বন্দীদের পরিবার। এরপরই বিশ্বের চোখ পড়ে এই কারাগারে। ২০১৩ সালে আরও একটি প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, সর্বশেষ ১ বছরে এই কারাগারে বন্দী শতাধিক আহত হন এবং হাসপাতালে চিকিত্সা নেন।
ইউএসপি ফ্লোরেন্স অ্যাডম্যাক্স
যুক্তরাষ্ট্রের আরও একটি কারাগার হচ্ছে ইউএসপি ফ্লোরেন্স অ্যাডম্যাক্স। দেশটির কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের ফ্লোরেন্সে অবস্থিত এটি। এটি অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংবলিত কারাগার। দেশের সবচেয়ে দাগী, হিংস্র এবং অবাধ্য আসামিদের জন্যই এটি নির্মিত হয়েছে। দেশটির হাই-প্রোফাইল বন্দীদের এখানে রাখা হয়। এর নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। ধূর্ত বন্দীরাও এখানে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করতে পারেন না। এই কারাগার আরও বেশি অমানবিক। বন্দীদের সেলে ৪ ইঞ্চি প্রস্থের জানালা থাকে। নিজস্ব সেলের বাইরে মাত্র ১ ঘণ্টা থাকার সুযোগ পান বন্দীরা। এই সময় দুজনের অধিক বন্দী একসঙ্গে কথা বলার অনুমতি পান না। কারা কর্তৃপক্ষ জানান, এই কারাগারে শারীরিক নয়, বরং মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং অবাধ্য বন্দীদের বশে আনা হয়। এই কারাগার অনেক বেশি রক্ষণশীল। তাই বেশি তথ্য প্রকাশিত হয় না। তবে কারাগারে বন্দীদের ওপর অতিমাত্রায় মানসিক নির্যাতন হয় এবং নির্যাতনের বিষণ্ণতায় প্রতিবছরই এখানে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই চলছে।
![](https://www.rupalibangladesh.com/media/imgAll/2024August/67acbe90dd348-prison1.jpg)
পেটাক আইল্যান্ড প্রিজন
রাশিয়া বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর একটি। এই দেশেও রয়েছে ভয়ংনক কারাগারের সন্ধান। যার নাম পেটাক আইল্যান্ড প্রিজন। রাশিয়ার ভোলগডা অঞ্চলে হোয়াইট লেকের মাঝে এটি অবস্থিত। দেশটির সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং বিপদজনক সন্ত্রাসীদের এই কারাগারে রাখা হয়। একে ‘রাশিয়ার আলকাত্রাজ’ও বলা হয়। যা অনেক বেশি সুরক্ষিত। তবে এটি বিশ্বের সবচেয়ে অমানবিক কারাগার বলেও সুপরিচিত। বন্দীরা এখানে ছোট্ট ঘরে অবস্থান করেন। যা পাখির বাসার মতোই হয়। সেখানেও ২ জন বন্দী অবস্থান করেন। দিনরাত একই স্থানে পড়ে থেকে মানসিকভাবে বিষণ্ণ হয়ে ওঠেন বন্দীরা। বছরে দুই বার সর্বোচ্চ দুজন অতিথির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। তাও সময় থাকে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট। সপ্তাহে মাত্র একবার ৫ মিনিটের জন্য গোসলের সুযোগ পান। শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে একাকী যাপনেরও সাজা ভোগ করতে হয়। যেখানে ছোট অন্ধকার ঘরে ১৫ দিন একটানা বন্ধ থাকেন। অধিকাংশ বন্দীই এখানে মানসিক সমস্যায় ভোগেন। তাদের চিকিত্সায় মানসিক চিকিত্সকেরও ব্যবস্থা রয়েছে কারাগারে।
ব্যাং ক্বং প্রিজন
পর্যটকদের পছন্দের শহর থাইল্যান্ড। এই শহরেও রয়েছে ভয়ংকর কারাগার। যার নাম ব্যাংক্কং প্রিজন। কারাবন্দীদের বিনা কারণে কিংবা সামান্য ভুল ত্রুটির জন্যও নির্মম সাজা দেওয়া হয় এই কারাগারে। সেই সঙ্গে শারীরিক নির্যাতনের কুখ্যাতি তো রয়েছেই। জানা যায়, ১৯৩০ সালে স্থাপিত এই কারাগারে থাইল্যান্ডের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদেরকে রাখা হয়। এর ধারণক্ষমতা ৩ হাজার। কিন্তু ৮ হাজারেরও বেশি কারাবন্দী এখানে রয়েছেন। এই কারাগার স্বল্প অর্থায়নে পরিচালিত হয়। সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়া অর্থের বড় অংশ খরচ হয় কারাকর্তৃপক্ষের ভরণপোষণে। বাকি অর্থে কারাবন্দীদের ন্যূনতম মানবিক সুযোগসুবিধা দেয়াও হয় না। প্রতিদিন একবেলা ভাত আর স্যুপ খেতে পারেন বন্দীরা। আর বাকি সময় নিজেদের অর্থের বিনিময়ে কারাগারের ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। যারা খাবার কিনতে সক্ষম নয় তারা ধনী বন্দীদের দাসী হয়ে কাজ করেন এবং প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে খাবার কিনে খান। এই কারাগারের পরিবেশও নিম্নমানের। শৌচাগারগুলোর পাইপ আটকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ইঁদুর আর তেলাপোকার আধিপত্য এখানে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও নেই। এতে ভয়াবহ রোগেও আক্রান্ত হন বন্দীরা। এছাড়াও কারাগারের হিংস্র কারারক্ষীর দল নারী-পুরুষ বন্দীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করেন। নিমর্ম নির্যাতনে এক গর্ভবতীর গর্ভপাতেরও ঘটনা ঘটে এই কারাগারে।