মা-মেয়ের সম্পর্ক নিবিড় হয়। শুধু মা মেয়ে কেনো প্রতিটি সন্তান আর মায়ের সম্পর্ক মধুরতম। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু প্রতিটি মানুষই যেহেতু সতন্ত্র তাই মা- সন্তানের মধ্যেও কখনো কখনো বৈরিতা চলে আসে। আবার সেটা ঠিকও হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে মা-মেয়ের সম্পর্কটুকু যেনো বিশেষকিছু। এটা গভীর হয় তেমনি বৈপরীত্যও থাকে। আজ চলুন জেনে নিই সেরকম কিছু বিষয়।
কেন হয় সমস্যাগুলো
মায়ের প্রতি নির্ভরতা দিয়েই শুরু হয় একটি মেয়ের শিশুকাল। তাই মায়ের প্রতি তীব্র ভালবাসাও মেয়ের মনে থাকে, সেই সঙ্গে থাকে আনুগত্য। টিনএজ পার হতে হতে এই আনুগত্যে কখনো ফাটল ধরতে থাকে। এর পেছনে থাকে নানা কারণ। কখনো দেখা যায় মায়ের চেয়ে বাবার প্রতি মেয়ের আনুগত্য ও ভালবাসা তার বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে। বাবাকেই সে মনে করছে নিজের ‘হিরো’। তখন বাবা-মায়ের মধ্যে কোনো মতবিরোধ হলে মেয়ে বিনা দ্বিধায় বাবাকেই সমর্থন করে।
কখনো আবার মেয়ে যত বয়ঃসন্ধির দিকে এগোয় বা বের হতে থাকে- তখন স্বাধীনচেতা ভাব চলে আসে। মায়েরা সেটাকে সুনজরে দেখেন না। মনে করে মেয়ে অবাধ্য, স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। তখন মায়েরা কড়া শাসনের চেষ্টা করেন। তখনই মায়ের সঙ্গে মানসিক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। মেয়ে তখন প্রতিবাদী হয়, অবাধ্য হয়। মা ভাবে ইচ্ছে করেই সে অগ্রাহ্য করছে মাকে।
স্কুল পেরিয়ে সদ্য কলেজে পা রাখা মেয়ের জীবনযাত্রা বদলাতে থাকে। অনেকটা সময় কাটে বাইরে, বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বাড়তে থাকে, খুঁজে পায় নিজের নতুন জগত্। ফলে মেয়েটা অনেক বেশি বুঁদ হয়ে থাকে তার নিজস্ব জগতে। শুরু হয় মায়েদের ক্ষোভ এবং বঞ্চনার বোধ। আদরে বড় করা মেয়েটি মাকে ভুলে যাচ্ছে? মনে হয় মেয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শুরু হয় মা-মেয়ের ভুল বোঝাবুঝি। ভালোবাসায় ভরা সম্পর্কটিতে পারষ্পরিক ঘৃণাও চলে আসে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি না বুঝে মেয়ের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কে দূরত্ব বাড়তে থাকে। মায়ের মনে আসে মেয়েকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা।
নতুন প্রজন্মের ধ্যানধারণা, দৃষ্টিকোণ যে অন্যরকম, এটা মা বুঝতেই পারেন না। আবার অন্যদিকে মায়ের সঙ্গে যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক, মা যে কখনো তার শত্রু হতে পারে না- মেয়ে সেটা বুঝে উঠতে পারে না। ফলে দুপক্ষেই ক্ষোভ জমতে থাকে। চিরাচরিত স্নেহ-মমতার বাইরে মায়ের কাছ থেকে শাসন আর অভিযোগের চাপে সম্পর্কে সব ভালবাসা, আবেগ হারাতে থাকে। এটাই হয়ে যায় মা-মেয়ের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় টানাপোড়েনের জায়গা। আরও সমস্যা হয় যখন মেয়ের কোনো প্রেম বা সম্পর্কের বিষয় মা জানতে পারে। সে বিষয়টাকে একবারেই ভালোভাবে নিতে পারে না। মা সম্পর্কবিরোধী হতে থাকে, আর মেয়ে আরও বেশি সম্পর্কে অনঢ় থেকে অবাধ্য হতে চেষ্টা করে।
এরপর মেয়ে যখন স্বাবলম্বী হয়, চাকরিজীবনে ঢোকে- তখনও এই দূরত্ব চলতে থাকে। দেখা যায়, সে মায়ের থেকে তথা পুরো পরিবার থেকে আলাদা থাকতে শুরু করে। এমনকি মায়ের ন্যূনতম খোঁজ রাখারও কোনো চেষ্টা করে না। তাকে আর্থিক সহায়তা, উৎসব উপলক্ষ্যে এক হওয়ারও কোনো তাগিদ তার মধ্যে থাকে না।
মা-বাবা যদি ডিভোর্সের মাধ্যমে আলাদা থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের প্রতি মেয়েদের আলাদা ক্ষোভ বা রাগ থাকে। মেয়ে যদি আইন মতে মায়ের সঙ্গে থাকে বা যেকোনো একজনের সঙ্গে থাকে তবে তার বেপরোয়া হওয়ার ভয় বেশি থাকে। অবাধ স্বাধীনতায় ডুবে থাকে। যখন তখন বাইরে থাকা, বাসায় বন্ধু নিয়ে এসে মায়ের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারে।
কিছু সমাধান
মেয়ের বয়স কম, তাই মাকেই সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। রাগ, বিদ্বেষ বা অভিমান - কোনোটাই জমিয়ে তোলা ঠিক নয়। সংঘাতের কারণগুলো খুঁজে নির্মূল করুন। সেজন্য মেয়েটিকে বোঝার পাশাপাশি নতুন সময় ও বয়সকে বোঝার চেষ্টা করুন। নিজের পুরনো ধ্যানধারণা ও বিচারভঙ্গি কিছুটা বদলান, খোলামেলা আলোচনা করুন। মেয়ের শুধু অভিভাবক নয়, তার চেয়ে বেশি বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। একঘেঁয়ে, উপদেশ আর অনুশাসনের বদলে সহযোগিতা ও সমর্থনের মাধ্যমে মেয়ের বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব অর্জন করুন। বকাঝকা করে যা বোঝাতে পারবেন না, বন্ধুত্বপূর্ণ কথায় তা বুঝবে।
- মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বা জেদ এড়িয়ে চলুন। মনে আঘাত দিয়ে কথা বলা, চিৎকার-চেঁচামেচি ইত্যাদিতে যতটা সম্ভব পাল্টা উত্তর না দেওয়ার চেষ্টা করুন। সাময়িকভাবে বিভিন্ন আচরণে বুঝিয়ে দিন আপনার কাছে এ রকম আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। ভালো মুডে থাকলে মাকে বলুন যে তার এ ধরনের আচরণে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।
- নিজের মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য আগে নিজেকে স্বাবলম্বীর চেষ্টা করুন। পড়ালেখার মাধ্যমে ভিত্তি শক্তিশালী করা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ উপায়। আর্থিক বা সামাজিক স্বাবলম্বন আপনার পথচলা অনেক সহজ করে দেবে।
- মায়ের সঙ্গে জেদ করে দ্রুত কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেবেন না। এই যেমন হুট করে বিয়ে করে ফেলা, বাসা থেকে চলে যাওয়া, পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়া। মনে রাখবেন, আপনার সিদ্ধান্তের খেসারত শুধু আপনাকেই দিতে হবে।
- বড় কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলে রাগারাগি না করে দৃঢ়ভাবে আপনার মতামত জানান। এক্ষেত্রে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে প্রয়োজনে কথা বলুন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা বাড়ান।
- মায়ের মানসিক কর্তৃত্বপরায়ণতা সীমাবদ্ধতা হিসেবে মেনে নিয়ে নিজের মনের খেয়াল রাখুন। ভালোলাগার বিষয়গুলো চর্চা করুন, মানুষের সঙ্গে মিশুন, প্রকৃতির কাছে যান, বই পড়ুন, নিজেকে সমৃদ্ধ করুন।