বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্র। আর এই মাসের শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। এটি শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় বছরের শেষ দিন নয়, বরং এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য উৎসব। যা আনন্দ-বেদনা, বিদায় ও বরণ, বিশ্বাস ও উৎসবের এক মিলনক্ষেত্র।
চৈত্র সংক্রান্তির আনুষ্ঠানিকতায় গ্রামীণ জীবনের ছাপ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। এটি মূলত বাংলার লোকজ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দিনের আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসব হাজার বছরের সংস্কার ও কল্পনার মিশেলে গড়ে উঠেছে।
চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব মূলত কৃষিনির্ভর সমাজে গড়ে ওঠা এক প্রাচীন লোকায়ত রীতি। ফসল তোলার সময় শেষ হয়ে আসে এই সময়ে। পুরাতন বছরকে বিদায় জানানো ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে নানা আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
গ্রামীণ মেলা ও গানবাজনা
চৈত্র সংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে সংক্রান্তির মেলা। গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত এই মেলাগুলোতে লোকশিল্প, হস্তশিল্প, পিঠা-পায়েস ও নানান ঐতিহ্যবাহী পণ্যের সমাহার ঘটে। বাউল, জারী, পালাগান ইত্যাদি গানে ভরপুর হয়ে ওঠে পরিবেশ।
বসন্ত ও গ্রীষ্মের মিলন
এই সময় প্রকৃতিতে এক ধরনের রুক্ষতা আর উষ্ণতা বিরাজ করে। গ্রীষ্মের সূচনায় মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও জীবনধারায় পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায় চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ রান্নাবান্নায় — যেমন ‘চৈত্র সেলামি’ বা ‘চৈত্র ভোজ’। অনেকে এদিনে তেঁতো খাওয়ার রীতিও মানেন, যা শরীর থেকে বিষাক্ততা দূর করার লোকবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত।
দান ও পূজা-পার্বণ
চৈত্র সংক্রান্তিতে অনেকেই বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শিব, কালী, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পূজা করে থাকেন। বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত হয় গাজনের মেলা ও শিবের গাজন। এটি মূলত এক ধরণের আধ্যাত্মিক উৎসব, যা শরীর ও মনের পরিশুদ্ধি সাধনের লক্ষ্যেই আয়োজিত হয়। এছাড়া দান করা, গরীবদের খাওয়ানো, পুরোনো কাপড় বিতরণ ইত্যাদি প্রথাও প্রচলিত।
নতুন শস্য ও রান্নার আয়োজন
চৈত্র সংক্রান্তিতে অনেক পরিবারে নতুন ধান থেকে তৈরি চিড়া-মুড়ি, মোয়া, পায়েস ইত্যাদি রান্না করা হয়। এটি মূলত নতুন ফসলের উৎসব, যেখানে কৃষক পরিবারের আনন্দঘন মুহূর্ত কাটে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতি
চৈত্র সংক্রান্তি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সামাজিক মিলনমেলা। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে গ্রামে দেখা যায় আত্মীয়স্বজনের আগমন, পুরনো বন্ধুদের মিলনমেলা, স্থানীয় যুবকদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ইত্যাদি। মেয়েদের মধ্যে নতুন পোশাক পরার রেওয়াজ, পিঠা বানানোর প্রতিযোগিতা, বাচ্চাদের জন্য খেলনা কেনাসহ সব মিলিয়ে একটি আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
নগরজীবনে চৈত্র সংক্রান্তি
গ্রামীণ জীবনে চৈত্র সংক্রান্তির উদযাপন বেশি হলেও শহুরে জীবনেও এর প্রভাব দেখা যায়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে আয়োজন করে লোকগানের অনুষ্ঠান, নাটক, হস্তশিল্প প্রদর্শনী ও পিঠা উৎসব। চারুকলা অনুষদের শোভাযাত্রার প্রস্তুতির একটা বড় অংশও এই সময় সম্পন্ন হয়।
সংক্রান্তি শব্দের অর্থই হলো পরিবর্তন বা রূপান্তর। চৈত্র সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে একটি বছর শেষ হয় এবং নতুন বছরের আগমনের অপেক্ষায় মানুষ থাকে। এই বিদায় মুহূর্তটি আত্মোপলব্ধি, আত্মশুদ্ধি এবং ভবিষ্যতের ভালো কামনার প্রতীক হয়ে ওঠে। এই দিনে অনেকে স্নান করে শুদ্ধ হয়, পূজা করে, মনের মধ্যে পাপবোধ ও ত্রুটিগুলো সংশোধনের প্রতিজ্ঞা নেয়। আনন্দ, দান, মিলন, শুদ্ধি আর সাংস্কৃতিক চর্চার এক অনন্য মিলনমেলায় পরিণত হয় চৈত্র সংক্রান্তি।